ক্যাটাগরি: মত দ্বিমত

খাদ্য, নৈতিকতা ও নেতৃত্ব: জাতিকে আলোর পথে নিতে যাঁরা নিঃশব্দে কাজ করছেন

সুইডিশ ভাষায় কিছু শব্দ রয়েছে যেগুলোর মধ্যে এক ধরনের অন্তর্নিহিত শক্তি ও গভীর তাৎপর্য লুকিয়ে থাকে। এমনই একটি শব্দ ‘livsmedel’—অর্থাৎ ‘জীবনের উপকরণ’। শব্দটি শুধু খাদ্য বোঝায় না, বোঝায় এমন কিছু যা আমাদের পুষ্টি দেয়, শক্তি জোগায়, এবং মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার সামর্থ্য গড়ে তোলে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আজকের বাজারে আমরা যে খাদ্য কিনছি—তা কি সত্যিই জীবনের উপকরণ? নাকি সেগুলো এমন কিছু, যা ধীরে ধীরে আমাদের ঠেলে দিচ্ছে রোগব্যাধি, ক্লান্তি, নির্ভরশীলতা আর নিঃশব্দ বিষক্রিয়ার দিকে?

আমরা প্রায়ই বলি, সুইডেন এমন একটি দেশ যেখানে গুণমান (quality) পরিমাণের (quantity) চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ‘লগোম’—অর্থাৎ পরিমিতিবোধ—এখানে একপ্রকার সাংস্কৃতিক বিশ্বাস। কিন্তু বাস্তবে, খাদ্যের ক্ষেত্রে আমরা এমন এক বৈশ্বিক ব্যবস্থার অংশ হয়ে পড়েছি, যেখানে ‘লগোম’-এর জায়গা দখল করে নিয়েছে—‘যত সস্তা সম্ভব’, ‘যত দীর্ঘ সময় সংরক্ষণযোগ্য’, এবং ‘শিল্পের সুবিধার জন্য যতটা সম্ভব প্রক্রিয়াজাত’ এই নীতিগুলো।

আজ আমরা সুইডেনে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে যে খাবার আমদানি করছি, তা দেখতে যতই ঝকঝকে হোক না কেন, তার পুষ্টিমান প্রায়শই শূন্য। এসব খাবারে থাকে সংরক্ষণের রাসায়নিক, কৃত্রিম রং, স্বাদ বাড়ানোর উপাদান, ফিলার—আরও কত কী! এই তালিকা শুধু দীর্ঘ নয়, দিনে দিনে আরও দীর্ঘতর হচ্ছে। শিল্পোন্নত দেশ হওয়া সত্ত্বেও সুইডেন কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে। তারা বলছে—livsmedel, এই শব্দটির প্রকৃত মর্যাদা আমাদের ফিরিয়ে আনতেই হবে।

অথচ বাংলাদেশের মতো দেশে এখনো এমন কোনো সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না, যা দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার—‘ভেজালমুক্ত ভাতে-মাছে বাঙালির বাঙালিত্ব’—পুনরুদ্ধারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের নিজেদের জিজ্ঞেস করতে হবে—আমরা কী চাই? এমন খাদ্য যা সত্যিকার অর্থে আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, নাকি এমন কিছু, যা ধীরে ধীরে আমাদের ভেতর থেকে ভেঙে দেয়?

এখানেই আসে স্বনির্ভরতার প্রসঙ্গ। আমাদের সাহস করে বলতে হবে—নিজের খাদ্য নিজেই উৎপাদন করতে না পারলে, স্বাধীনতা অর্থহীন। মহামারির সময় আমরা এক ঝলক দেখেছিলাম—যখন বিশ্বব্যাপী সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, তখন কীভাবে খাদ্যনিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।

আজকের পৃথিবীতে, যেখানে যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে, সেখানে নিজের খাদ্য নিজে উৎপাদনের সক্ষমতা শুধু যুক্তিসঙ্গত নয়—জীবনের জন্য অপরিহার্য। আমাদের দরকার এমন খাবার যা শুধু পেট ভরে না, আমাদের বিশ্বাস, স্বাস্থ্য ও মর্যাদাও রক্ষা করে। আমাদের দরকার নিরাপদ খাবার। প্রকৃত খাবার। এমন খাবার, যার উৎস আমরা জানি—আর যেটি কেবল আহার নয়, এক ধরনের আশ্বাস।

আমি সুদূর প্রবাসে বসে যখন এ রকম একজন মাটি-কেন্দ্রিক, বিজ্ঞানমনস্ক, দেশপ্রেমিক মানুষের কর্মযজ্ঞ দেখি, তখন এক প্রশ্ন আমাকে তাড়া করে ফেরে—দেশের মানুষ কেন এমন একজন সম্পদকে চিনতে ব্যর্থ হচ্ছে? কেন এমন একজন দূরদর্শী কৃষিবিজ্ঞানীর আলোর রেখা আমরা জাতীয় নীতিতে পরিণত করতে পারছি না?

খাদ্যই উন্নয়নের মূল: কৃষকের পাশে ড. আলী আফজাল এবং একটি জাতির কৃতজ্ঞতা

যেহেতু জীবন ধারণের সবকিছুই শুরু হয় খাদ্য দিয়ে। খাদ্য শুধু আমাদের শরীরের জ্বালানি নয়—এটি মনের বিকাশ, সৃজনশীলতা এবং উন্নয়নের ভিত্তি। পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত না হলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মক্ষমতা ও সমাজব্যবস্থার ভিত্তি ভেঙে পড়ে। একজন রাজনীতিবিদ হোন বা প্রকৌশলী, শিক্ষক হোন বা সেনা সদস্য—সবার অস্তিত্বের পেছনে নির্ভরতা এক জায়গাতেই খাদ্য।

কিন্তু যে মানুষগুলো প্রতিদিন আমাদের এই খাদ্যের নিশ্চয়তা দেন—কৃষক, খামারী, মৎস্যজীবী ও গ্রামীণ পরিশ্রমজীবী জনগোষ্ঠী—তাঁদের অবদান আজও সমাজ ও রাষ্ট্রে ন্যায্য সম্মান পায় না। বরং অবহেলা, অনিশ্চয়তা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের চাপে তাঁরা পিছিয়ে থাকেন। এই বাস্তবতায় একজন মানুষ দীর্ঘদিন ধরে নিরবে, কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি মাগুরার সন্তান, আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত কৃষিবিজ্ঞানী, সফল উদ্যোক্তা এবং দূরদর্শী সমাজগঠক—ড. মো. আলী আফজাল।

একজন কৃষকের সন্তান থেকে কৃষি-নেতা হওয়ার গল্প

১৯৬৭ সালের ২২ মার্চ মাগুরার মোহাম্মদপুর উপজেলার বালিদিয়া গ্রামে জন্ম নেওয়া ড. আফজালের শিকড় পল্লির মাটিতে। কৃষকের সন্তান হিসেবে তিনি জানতেন, কৃষির প্রকৃত সমস্যা কী, এবং সেগুলোর সমাধান কোন পথে সম্ভব। শিক্ষা ও গবেষণায় অসাধারণ কৃতিত্ব অর্জনের পর তিনি শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন এবং ২০ বছর ধরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে (BARI) কাজ করেন প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে। এ সময় তিনি ২২টি নতুন ফসল উদ্ভাবন করেন এবং ৮২টিরও বেশি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। কিন্তু তিনি শুধু গবেষণাগারে সীমাবদ্ধ থাকেননি। গবেষণাকে মাঠে, কৃষকের হাতে, অর্থনৈতিক বাস্তবতায় রূপ দিতে চেয়েছিলেন। সেই চিন্তা থেকেই ২০০৯ সালে মাত্র ৩০ হাজার টাকা নিয়ে ৫ জন সহকর্মীকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন Krishibid Group Bangladesh (KGB)—যা আজ দেশের অন্যতম বৃহৎ কৃষি-ভিত্তিক শিল্পগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে।

এক ছাতার নিচে কৃষির পূর্ণ সমাধান

বর্তমানে KGB-এর অধীনে ৩৩টি কোম্পানি রয়েছে যা মাটি ও বীজের গুণমান, সার, কীটনাশক, আধুনিক যন্ত্রপাতি, পশুখাদ্য, দুগ্ধজাত পণ্য, মাছ-মাংস উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের সাথে যুক্ত। কৃষকদের জন্য এটি একটি বাস্তব “ওয়ান-স্টপ সার্ভিস” ব্যবস্থা, যা তাদের শুধু প্রযুক্তিগত সহায়তা নয়—আর্থিক সুরক্ষা ও আত্মবিশ্বাসও দিচ্ছে।

KGB-তে বর্তমানে ৬৫০০ জন বিনিয়োগকারী রয়েছেন, যাঁদের অনেকেই সরাসরি কৃষক বা কৃষক পরিবারের সদস্য। গত দুই দশকে এই বিনিয়োগকারীদের গড় বার্ষিক রিটার্ন ১৯%, যেখানে মোট Tk ২৫০ কোটি বিনিয়োগের বিপরীতে Tk ৩১৫ কোটি ফেরত দেওয়া হয়েছে—এটাই প্রমাণ করে, এই উদ্যোগ শুধুমাত্র ব্যবসায়িক নয়, এটি একটি সামাজিক বিনিয়োগ ও কৃষক-ক্ষমতায়নের মডেল।

স্থানীয় উদ্যোগ, বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি

ড. আফজাল শুধু বাংলাদেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে কাজ করেছেন। তিনি তাইওয়ান, অস্ট্রেলিয়া ও সিরিয়া-তে কাজ করেছেন উন্নত ফসল উদ্ভাবন এবং খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে, যা তাঁর দর্শনে এক বৈশ্বিক মাত্রা এনেছে। তিনি বুঝতে পেরেছেন—যে জাতি খাদ্যে স্বনির্ভর নয়, সে কখনো স্বাধীন নয়।

রাজনীতির আহ্বান: নীতির মানুষকে নেতৃত্বে চাই

যদিও ড. আলী আফজাল এখনো সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হননি, কিন্তু আমাদের সমাজে আজ এমন নেতৃত্বের অভাব গভীরভাবে অনুভূত হয়—যেখানে জ্ঞান, সততা ও জনসেবার মানসিকতা একত্রে থাকে। তাঁর মতো মানুষদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করা মানে হলো নীতিনির্ভর উন্নয়ন নিশ্চিত করা। আমরা চাই, আগামী দিনে তিনি বাংলাদেশের কৃষিনীতি নির্মাণ ও বাস্তবায়নে সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দিন—এমনকি ভবিষ্যতের একজন যোগ্য ও জনমুখী কৃষিমন্ত্রী হিসেবেও তাঁর অংশগ্রহণ দেশ ও জাতির জন্য আশীর্বাদ হবে।

একজন মানুষের পেছনে একটি জাতির স্বপ্ন

ড. আফজাল আজ শুধুমাত্র একজন সফল ব্যক্তি নন, তিনি একটি দর্শনের প্রতীক—যে দর্শন বলে: “কৃষক যদি বাঁচে, দেশ বাঁচে। খাদ্য যদি নিরাপদ হয়, জাতি সুস্থ থাকে।” আমি সুদূর প্রবাসে বসে যখন এ রকম একজন মাটি-কেন্দ্রিক, বিজ্ঞানমনস্ক, দেশপ্রেমিক মানুষের কর্মযজ্ঞ দেখি, তখন এক প্রশ্ন আমাকে তাড়া করে ফেরে—দেশের মানুষ কেন এমন একজন সম্পদকে চিনতে ব্যর্থ হচ্ছে? কেন এমন একজন দূরদর্শী কৃষিবিজ্ঞানীর আলোর রেখা আমরা জাতীয় নীতিতে পরিণত করতে পারছি না?

আমি বহু বছর বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি। এখন, সুইডেনের মতো শীতল আবহাওয়ায়, কঠিন বাস্তবতার মধ্যেও কৃষিকাজে নিজেকে যুক্ত রেখেছি—শুধু একটি বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য:
“খাদ্য কেবল পেট ভরানোর মাধ্যম নয়; এটি সভ্যতা ও নৈতিকতার বিষয়।” নিরাপদ খাদ্য মানে সুস্থ জাতি, আর ভেজাল মানে বিপর্যয়।

বাংলাদেশে ড. আলী আফজালের মতো একজন বিজ্ঞানী ও সংগঠক থাকা সত্ত্বেও, আমরা আজও কেন নিরাপদ ও ভেজালমুক্ত খাদ্যের জন্য হাহাকার করছি? কেন এখনও কৃষকের ঘাম ও পরিশ্রম যথাযথ সম্মান পাচ্ছে না? কেন জাতি তার প্রকৃত নায়ক ও পথপ্রদর্শককে চিনতে এত বিলম্ব করছে? এই প্রশ্নগুলো শুধুমাত্র প্রশ্ন নয়; এগুলো সময়ের কাছে আমাদের দায়। জবাব চাই, জাগরণ চাই। জাগো বাংলাদেশ, জাগো!

আমি ১৯৮৬ সাল থেকে আমার বড় ভাই প্রফেসর ড. মান্নান মৃধাকে দেখছি—তিনি কেবল একজন শিক্ষাবিদ নন, বরং নিবেদিত সমাজসেবক ও গবেষক, যিনি দেশের শিক্ষা ও গ্রামীণ উন্নয়নে অগ্রদূত। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি দেশের গ্রামীণ কৃষকদের পাশে থেকে মাঠ পর্যায়ের গবেষণামূলক কাজ করে যাচ্ছেন। তার নেতৃত্বে এলাকার প্রথম গবাদি ফার্ম গড়ে উঠেছে, মাছচাষসহ বিভিন্ন কৃষি প্রযুক্তির উন্নয়ন হয়েছে। তার গবেষণার মূল লক্ষ্য সঠিক চাষাবাদ পদ্ধতি প্রচলন ও কৃষকের জীবনমান উন্নয়ন।

তাঁর কাজের কেন্দ্রবিন্দু শুধুমাত্র কৃষি নয়; তিনি সমাজের প্রান্তিক শ্রেণীর ক্ষমতায়নে দৃঢ় বিশ্বাসী। এলাকার শিশুশিক্ষা থেকে শুরু করে সকল স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রান্তিক কৃষকদের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে তিনি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। অসংখ্য শিক্ষার্থী ও গবেষকের তিনি পথপ্রদর্শক, যারা দেশের কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়নে অবদান রাখছেন।

একই লক্ষ্য নিয়ে তিনি আজও নিরলস পরিশ্রম করছেন—বাংলাদেশী মানুষের জীবনে মৌলিক পরিবর্তন আনা, তাদের ভাগ্যে নতুন আলো জ্বালানো, এবং একটি উন্নত, মানবিক ও সম্মানজনক সমাজ গড়ে তোলা, যেখানে প্রতিটি কৃষক ও গ্রামীণ জনগণ সুশিক্ষিত, স্বাবলম্বী ও মর্যাদাবান জীবন যাপন করবে।

আমরা ড. মান্নান মৃধা ও ড. আলী আফজালের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই। প্রার্থনা করি তারা দীর্ঘদিন সুস্থ ও সক্রিয় থাকুন, কৃষক ও দেশের মানুষের পাশে থেকে জাতিকে আলোর পথে নিয়ে যান। যেন বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুর মুখে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের হাসি ফুটে ওঠে—এটাই আমাদের সম্মিলিত আশা ও স্বপ্ন।

রহমান মৃধা
গবেষক, লেখক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com

কাফি

শেয়ার করুন:-
শেয়ার