ক্যাটাগরি: ধর্ম ও জীবন

ব্যবসা-বাণিজ্যে ইসলামের ৭ নির্দেশনা

ইসলামের নীতি ও নির্দেশনার আলোকে ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করলে একজন ব্যবসায়ী শুধুমাত্র দুনিয়াতেই নয় পরকালেও লাভবান হবেন নি:সন্দেহে। যারা সততা ও আমানতদারিতার সাথে ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করে নবিজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদের জন্য পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন। আবু সাইদ (রা.) থেকে বর্ণিত নবি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীরা আখেরাতে নাবিগণ, সিদ্দিকগণ ও শহীদগণের সঙ্গে থাকবে। (সুনানে তিরমিজি: ১২০৯)

এখানে আমরা ব্যবসা-বাণিজ্যে ইসলামের ৭টি নির্দেশনা তুলে ধরছি:
এক. ব্যবসায় কারো ক্ষতি করা যাবে না
মানুষের ক্ষতি হয় এমন সব পন্থাকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। সুতরাং ব্যবসা- বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। মানুষের উপকার করার মানসিকতা থাকতে হবে। কারও ক্ষতি যেন না হয় সেদিকে সজাগ থাকতে হবে।
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, কারো ক্ষতি করাও যাবে না, নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া যাবে না। (সুনানে ইবনে মাজাহ: ২৩৪১)

ব্যবসায় গ্রাহকের কাছ থেকে আমরা শুধু লাভ করছি তা নয়; বরং আমরা তাদের পণ্য ও সেবা প্রদান করছি। যদি আমরা যৌক্তিক লাভ করি এবং একচেটিয়া ব্যবসা না করি তবে সমাজের জন্য এটি একটি বড় সহায়তা। ভালো জিনিস যৌক্তিক দামে প্রদান করায় সমাজের মানুষ সন্তুষ্ট হবে, তাতে মহান আল্লাহও আমাদের ওপর সন্তুষ্ট হবেন। যখন ব্যবসায়ী ও গ্রাহক উভয় পক্ষ অনুভব করবে আমরা উপকৃত হয়েছি, তখন তাদের মধ্যে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হবে যা একটি সুগঠিত সমাজের জন্য প্রয়োজন। এতে উভয় পক্ষই পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার সাওয়াব পাবেন।

দুই. ধোঁকা, প্রতারণা ও ফাঁকিবাজি করা যাবে না
বেচাকেনার ক্ষেত্রে মন্দ জিনিস ভালো বলে চালিয়ে দেওয়া, ভালোর সঙ্গে মন্দের মিশ্রণ ঘটিয়ে ধোঁকা দেওয়া ইত্যাদি সম্পূর্ণ হারাম। বিখ্যাত সাহাবি হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসুল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বাজারে গিয়ে একজন বিক্রেতার স্তুপীকৃত খাদ্যপণ্যের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দেখলেন ভেতরের পণ্য ভেজা বা নিম্নমানের। এ অবস্থা দেখে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এটা কী করলে তুমি? লোকটি বললো, হে আল্লাহর রসুল! বৃষ্টি পড়ে ভিজে গিয়েছিল। রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ভেজা পণ্য তুমি ওপরে রাখলে না কেন? তাহলে ক্রেতারা দেখতে পেত। যে ধোঁকা দেয় সে আমার উম্মত নয়। (সহিহ মুসলিম: ১০২)

তিন. মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া যাবে না
ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রেই মিথ্যা নিন্দনীয় ও বড় ধরনের অপরাধ। কোনো মুসলমান সত্যের সঙ্গে মিথ্যার সংমিশ্রণ করতে পারে না। সত্য গোপন করতে পারে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা সত্যের সঙ্গে অসত্যের মিশ্রণ ঘটাবে না। জেনেশুনে সত্য গোপন করবে না। (সুরা বাকারা: ৪২)

একজন মুমিনের মধ্যে মিথ্যা ও খেয়ানতের দোষ থাকা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। একবার আল্লাহর রাসুলকে (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জিজ্ঞাসা করা হলো, একজন মুমিন দুর্বল হওয়া কি স্বাভাবিক? তিনি বললেন, হ্যাঁ, হতে পারে। আবারও জিজ্ঞাসা করা হলো, মুমিন কি কৃপণ হতে পারে? বললেন, হ্যাঁ। তারপর জিজ্ঞাসা করা হলো, একজন মুমিন মিথ্যুক হতে পারে? তিনি বললেন, না। (বাইহাকি, শুআবুল ঈমান: ৪৮১২)

চার. ওজনে কমবেশি করা যাবে না
অন্যকে দেয়ার সময় ওজনে কম দেওয়া আর নেওয়ার সময় বেশি করে নেয়া জঘন্য অপরাধ। মহান আল্লাহ বলেন, যারা পরিমাপে কম দেয় তাদের জন্য ধ্বংস। যারা লোকদের কাছ থেকে মেপে নেয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে আর যখন তাদেরকে মেপে দেয় অথবা ওজন করে দেয় তখন কম দেয়। (সুরা মুতাফফিফিন: ১-৩)

সুতরাং বেচাকেনার সময় কাউকে দেওয়ার সময় কম দেওয়া যাবে না। আপনি যে কাজটি নিজের জন্য পছন্দ করেন না, তা অন্যের জন্য কীভাবে পছন্দ করেন? যখন নিজের জন্য নেন তখন তো মাপে কম দিলে আপনি পছন্দ করবেন না। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আপনারা নিজের জন্য যা ভালোবাসেন তা অন্যের জন্যও ভালোবাসার আগ পর্যন্ত ইমানদার হতে পারবেন না। (সহিহ বুখারি: ১৩)

পাঁচ. পণ্য বিক্রির জন্য মিথ্যা শপথ করা যাবে না
মিথ্যা বলে বা মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রি করার পরিণতি খুবই ভয়াবহ। রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তিন ব্যক্তির সাথে কোনো ধরনের কথা বলবেন না, তাদের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করবেন না, তাদের পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। তাদের একজন হলো ওই ব্যক্তি যে তার ব্যবসার পণ্য মিথ্যা কসম খেয়ে বিক্রি করে। (সহিহ মুসলিম: ১০৬)

অন্য একটি হাদিসে এ দৃষ্টান্ত এভাবে তুলে ধরা হয়েছে, এক ব্যক্তি আসরের পর তার পণ্য সম্পর্কে কসম খেয়ে বলে, সে পণ্যটি এত এত মূল্যে কিনেছে, তার কথা ক্রেতা বিশ্বাস করে, অথচ সে মিথ্যুক। (সুনানে আবু দাউদ: ৩৪৭৪)

ছয়. ব্যবসার সাথে সুদ মেশানো যাবে না
সুদ একটি মারাত্মক অপরাধ। সুদ থেকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে। ব্যবসার নামে কোন প্রকার সুদে জড়িত হওয়া যাবে না। সুদের পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, যারা সুদ খায় তারা কেয়ামতের দিন দণ্ডায়মান হবে শয়তানের আসরে মোহাবিষ্টদের মতো। কারণ, তারা বলে ব্যবসাওতো সুদের মতো, অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন। (সুরা বাকারা: ২৭৫)

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান খায়রাতকে বর্ধিত করেন। (সুরা বাকারা: ২৭৬)

হাদিসে এসেছে, জাবের ইবন আব্দুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন যে, আল্লাহর রসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সুদ গ্রহণকারী, প্রদানকারী, হিসাবকারী এবং সাক্ষী সকলকে অভিশাপ দিয়েছেন এবং তিনি বলেন তারা সকলেই সমান। (সহিহ মুসলিম: ১৫৯৮)

সাত. মজুদদারি বা সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা যাবে না
অনেক অসাধু ব্যবসায়ী মজুদদারি বা সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে। এতে মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হয় এবং জনসাধারণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইসলামে মজুদদারি গর্হিত অপরাধ। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
শুধুমাত্র পাপী ব্যক্তিই মজুদদারি করে থাকে। (সহিহ মুসলিম: ১৬০৫)

লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া গাফুরিয়া মাখযানুল উলুম টঙ্গী গাজীপুর, খতিব, আউচপাড়া জামে মসজিদ টঙ্গী গাজীপুর

শেয়ার করুন:-
শেয়ার