ক্যাটাগরি: অর্থনীতি

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যে ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি

নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবার রুটি ও বিস্কুটের ওপর উচ্চ ভ্যাট অব্যাহত রাখায় দরিদ্র মধ্যবিত্ত ও শিক্ষার্থীদের ওপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি এবং এই বৈষম্যমূলক করনীতির পুনর্বিবেচনার দাবিতে এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। ইয়ুথ পলিসি নেটওয়ার্ক (ওয়াইপিএন) আয়োজিত ‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা ও ভ্যাট’ শীর্ষক এই সেমিনারে বক্তারা সরকারের বর্তমান করনীতি দরিদ্র মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলছে বলে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) মিলনায়তনে এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।

সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান। ইআরএফের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইয়ুথ পলিসি নেটওয়ার্কের হেড অব রিসার্চ কে এম ইমরুল হাসান। আলোচনায় অংশ নেন দৈনিক প্রথম আলোর সহকারী বার্তা সম্পাদক পার্থ সংকর সাহা, ওয়াইপিএন-এর ফিল্ড কো-অর্ডিনেটর মো. আকবর হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী তাপসী রাবেয়া এবং বাংলাদেশ ব্রেড অ্যান্ড বিস্কুট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুর রহমান ভূঁইয়া। সেমিনারটি সমাপ্তি ঘোষণা করেন সভাপতি দৌলত আক্তার মালা।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে ইয়ুথ পলিসি নেটওয়ার্কের হেড অব রিসার্চ কে এম ইমরুল হাসান বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, দেশে ৯ শতাংশেরও বেশি মূল্যস্ফীতি, যুব বেকারত্ব এবং আয় বৈষম্য বিদ্যমান। তিনি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখান যে, পূর্ববর্তী বাজেট থেকে বিস্কুট ও পাউরুটির ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭.৫ শতাংশ করা হয়েছে, যা বর্তমান বাজেটেও অব্যাহত আছে।

তিনি ওয়াইপিএনের গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে বলেন, তাদের জরিপে নিম্ন আয়ের (১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা মাসিক আয়) মানুষের মধ্যে ৬০ শতাংশ সকালের খাবার বাদ দেন এবং ৩.৫ শতাংশ দুপুর বা বিকালের খাবারও বাদ দিতে বাধ্য হন। ৮৮ শতাংশ নিম্ন আয়ের মানুষ প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে রুটি-বিস্কুট গ্রহণ করেন, যা তাদের জন্য ভাতের সস্তা বিকল্প। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের ১৫ শতাংশ মনে করেন, এই ভ্যাট আসলে অনেক অতিরিক্ত।

তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, ভ্যাটের কারণে হয় বিস্কুট ও পাউরুটির আকার ছোট হয়ে যাচ্ছে অথবা দাম বেড়ে যাচ্ছে, যা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। তিনি বলেন, ৭০ শতাংশ মানুষের প্রত্যাশা ছিল আসন্ন বাজেটে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ইতিবাচক কিছু থাকবে, কিন্তু এই ভ্যাট আরোপে তাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। তিনি অবিলম্বে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি জানান।

ওয়াইপিএন-এর ফিল্ড কো-অর্ডিনেটর মো. আকবর হোসেন তার ফলোআপ গবেষণার তথ্য তুলে ধরে বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, খুলনা, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষার্থী, রিকশাচালক, দিনমজুর, পোশাক শ্রমিক এবং ডেলিভারি ম্যানদের ওপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, বিস্কুট ও ব্রেড এখন আর নাস্তার খাবার নয়, বরং দরিদ্র মানুষের একবেলার নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবার হয়ে উঠেছে।

তার গবেষণা অনুযায়ী, ৬৮ শতাংশ মানুষ প্যাকেটজাত বিস্কুট খায় এবং ৬৫ শতাংশ মানুষ প্যাকেটজাত বিস্কুট ক্রয়ে প্রতিদিন ন্যূনতম ৩০ টাকা খরচ করে। ৭০ শতাংশ খুচরা বিক্রেতা জানিয়েছেন যে, ভ্যাট বৃদ্ধির কারণে তাদের দোকানে প্যাকেটজাত বিস্কুট ও ব্রেডের বিক্রি কমে গেছে।

তিনি বলেন, সরকার রুটি ও বিস্কুট থেকে বছরে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহ করে, অথচ এই করের কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তায় মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।

আকবর হোসেন শ্রীলঙ্কা, ভারত ও নেপালের উদাহরণ দিয়ে বলেন, সেসব দেশে রুটি ও বিস্কুটে কোনো ভ্যাট নেই অথবা থাকলেও তা ২-৩ শতাংশের বেশি নয়। তিনি অবিলম্বে রুটি ও বিস্কুটের ওপর থেকে ভ্যাট কমানোর বা শূন্য করার দাবি জানান এবং এনবিআরকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পুষ্টিকর পণ্যের একটি তালিকা তৈরি করে সেগুলোকে ভ্যাটমুক্ত রাখার পরামর্শ দেন।

তিনি বিলাসী পণ্য যেমন আইসক্রিম, চকলেট, স্যালমন ফিশ ও পাস্তায় ভ্যাট কমানোর তীব্র সমালোচনা করে বলেন, “আপনি চকলেট খান ট্যাক্স ফ্রিতে, কিন্তু যখন ব্রেড কিনবেন তখন তাকে ট্যাক্স দিতে হবে।”

দৈনিক প্রথম আলোর সহকারী বার্তা সম্পাদক পার্থ সংকর সাহা ওয়াইপিএন-এর গবেষণার প্রশংসা করে বলেন, সাধারণ মানুষ যদিও অনেক জটিল রিপোর্ট পড়েন না, তবে এই ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর ভ্যাটের বিষয়টি তাদের কাছে অত্যন্ত আগ্রহের, বিশেষত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের কাছে।

তিনি বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্যের কথা উল্লেখ করে বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও এই ধরনের করনীতির কারণে দেশে আরও ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে অতি দরিদ্র হতে পারে। তিনি পুনর্ব্যক্ত করেন যে, ৭০ শতাংশ মানুষের আশা ছিল যে এই বাজেটে তাদের প্রত্যাশা পূরণ হবে, কিন্তু সম্ভবত তা হয়নি। তিনি সাধারণ মানুষের প্রতি সহনশীল হওয়ার জন্য কর ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী তাপসী রাবেয়া সাংবিধানিক ও মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে এই করনীতির সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানে সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ এবং রাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষ্য একটি শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা কায়েম করা। অথচ, এখনো দেশের ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের ওপর ভ্যাট তাদের জন্য অতিরিক্ত বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, রুটি-বিস্কুট দরিদ্র মানুষের জন্য ন্যূনতম খাবার, এর চেয়ে নিচে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

তাপসী রাবেয়া বলেন, এই ভ্যাট শুধু ‘খাদ্য অধিকার’ নয়, ‘স্বাস্থ্য অধিকার’ও লঙ্ঘন করছে। তিনি জুলহাস উদ্দিন মামলার উদাহরণ টেনে বলেন, যেখানে চিকিৎসা সেবার ওপর ভ্যাট আরোপকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়েছিল, কারণ এটি জীবন ধারণের অধিকার লঙ্ঘন করে।

তিনি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদগুলির কথা উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশ সেগুলোর পক্ষভুক্ত, যেখানে খাদ্য একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত। তিনি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দরিদ্রবান্ধব করনীতি প্রণয়নের আহ্বান জানান, যা দরিদ্র মানুষের ওপর করের বোঝা চাপাবে না এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যে নামমাত্র বা শূন্য ভ্যাট রাখবে।

বাংলাদেশ ব্রেড অ্যান্ড বিস্কুট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুর রহমান ভূঁইয়া ওয়াইপিএন-এর গবেষণার ফলাফলের সাথে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, পূর্বে যখন রুটি-বিস্কুটে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছিল, তখন অ্যাসোসিয়েশন আন্দোলন করেছিল এবং এনবিআর চেয়ারম্যানের সাথে দুবার বৈঠক করে ভ্যাট ৭.৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল। তিনি বলেন, তারা সরকারের কাছে সবসময় রুটি-বিস্কুটকে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য হিসেবে গণ্য করে শূন্য ভ্যাট রাখার দাবি জানিয়ে আসছেন। শফিকুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, যদি শূন্য ভ্যাট সম্ভব না হয়, তবে সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ ভ্যাট রাখা উচিত, যা এফবিসিসিআইও সুপারিশ করেছিল। তিনি এনবিআর চেয়ারম্যানের প্রতি এই দাবিগুলো গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার আহ্বান জানান।

প্রধান অতিথি আবদুর রহমান খান, এনবিআর চেয়ারম্যান, ওয়াইপিএন-এর গবেষণা ফলাফলকে ‘সম্পূর্ণ সঠিক’ বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে রুটি ও কলা খেয়ে তাৎক্ষণিক শক্তি পাওয়ার কথা জানান, যা নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবারের গুরুত্ব তুলে ধরে।

তিনি স্বীকার করেন যে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর ভ্যাট আরোপ করা উচিত কিনা, তা নিয়ে একটি মৌলিক বিতর্ক সবসময়ই থাকবে। এনবিআর চেয়ারম্যান করনীতি প্রণয়নের জটিলতা ব্যাখ্যা করে বলেন, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার শর্ত, বিশেষ করে ২০২৬ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি, তাদের মাথায় রাখতে হয়। তিনি স্বীকার করেন যে, সহজে রাজস্ব আদায়ের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর কর আরোপ একটি ‘বদভ্যাস’ হতে পারে। তবে তিনি দেশের জন্য রাজস্ব সংগ্রহের গুরুত্ব এবং ঋণনির্ভরতা কমানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।

চেয়ারম্যান উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বিশ্বের সর্বনিম্নগুলোর মধ্যে একটি। তিনি পুনর্ব্যক্ত করেন যে, রুটি-বিস্কুটের ওপর ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে ৭.৫ শতাংশে কমিয়ে আনা হয়েছিল, যখন সরকার বুঝতে পেরেছিল যে এটি দরিদ্র মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। তিনি মেনে নেন যে, আদর্শ ভ্যাট ব্যবস্থায় (যেখানে ইনপুট ক্রেডিট সুবিধা থাকে) ৭.৫ শতাংশ ভ্যাটও অযৌক্তিক, এবং সিস্টেমের প্রক্রিয়াগত ও ডিজিটাইজেশনের ত্রুটির কারণে এমনটা হচ্ছে।

সেমিনারে সব বক্তা সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, তারা যেন নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের ওপর আরোপিত ভ্যাট পুনর্বিবেচনা করেন। একটি জনবান্ধব ও ন্যায়ভিত্তিক করনীতি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নতি এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অপরিহার্য বলে মত দেন তারা।

কাফি

শেয়ার করুন:-
শেয়ার