মত দ্বিমত
বিবেকহীনতার বাজারে সৎ থাকা মানেই ব্যর্থতা

বাংলাদেশের সমাজে যখন অনৈতিকতা ধীরে ধীরে স্বাভাবিকতায় পরিণত হচ্ছে, তখন একজন বিবেকবান মানুষের জীবন হয়ে ওঠে এক নিঃশব্দ প্রতিরোধের গল্প। চারপাশের মানুষ যখন “স্মার্টনেস” আর “চালাকির” আড়ালে প্রতারণাকে সাজিয়ে তুলে, তখন সত্যকে ধারণ করা এক ধরনের সামাজিক আত্মদহন। এই দেশে আজ পিতা সন্তানের পরীক্ষার ফল নিয়ে যতটা উদ্বিগ্ন, সন্তানের সততা নিয়ে ততটা নন। শিক্ষক হয়েও অনেকে নীতিকথার চেয়ে নোটবিক্রিকে গুরুত্ব দেন। ব্যবসায়ীরা ভেজালকে ‘কৌশল’ হিসেবে উপস্থাপন করেন। রাজনীতি হয়ে উঠেছে জনসেবার নয়, লোভ ও প্রভাব বিস্তারের খেলা। আর এইসব ভিড়ের ভেতরে যে ক’জন মানুষ এখনো সত্য বলার সাহস রাখেন, ন্যায় পথে চলার চেষ্টা করেন—তাঁদের সমাজ ‘বোকার রাজ্যে রাজা’ বলেই গণ্য করে।
কিন্তু একজন বিবেকবান মানুষের যন্ত্রণা শুরু হয় অন্য জায়গা থেকে। তিনি ভুল করলে, সেটা মেনে নিতে পারেন না—নিজেকে বারবার প্রশ্ন করেন, “আমি তখন একটু সাহস দেখালে কী হতো?” অন্যরা ভুল ভুলে যায়, কিন্তু বিবেক তাকে ভুলতে দেয় না। প্রিয় মানুষদের ভুল দেখেও চুপ থাকতে হয় তাঁকে—কারণ যাকে ভালোবাসেন, তার পথভ্রষ্টতা দেখেও কিছু করতে না পারার অসহায়তা জ্বালায় হৃদয়কে। আবার যখন তিনি সত্য বলেন, সতর্ক করেন, তখন তাঁর কথাগুলো বাতাসে মিলিয়ে যায়—উল্টো মানুষ হাসে, বলে, “এই আদর্শ দিয়ে পেট চলে?” ফলে সমাজের অস্বীকৃতি আর কটাক্ষ তাকে ধীরে ধীরে নিঃশব্দ করে দেয়।
সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা আসে তখন, যখন ভুলের ফলস্বরূপ তার প্রিয়জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়—কারো চাকরি চলে যায়, কারো সম্মান ধুলায় মিশে যায়, কেউ হয়তো অপরাধের দায়ে আইনের মুখোমুখি হয়। অথচ তিনি নিজে সেই ভুলের অংশ ছিলেন না—তবুও ভালোবাসার টানে, মানবিকতার দায়ে তাঁর কষ্টও কম হয় না। এই সহভোগিতা হয়তো কারও চোখে পড়বে না, কিন্তু ভিতরে ভিতরে তা ক্ষয় করে তাঁর মনকে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এই লড়াই চলে—অবশেষে এক ক্লান্তি এসে চেপে বসে তাঁর হৃদয়ের উপর। কেউ খোঁজ নেয় না, “তুমি কেমন আছো?” সমাজ ধরে নেয়, তিনি তো ঠিকই আছেন—কারণ তিনি চিৎকার করেন না। কিন্তু ভেতরে চলে এক নীরব অবসাদ, যে বিষণ্ণতায় কথা বলে না, শুধু হ্রাস করে মানুষের আলো।
এমন অসংখ্য মানুষ আছেন যারা বিদেশে পরিশ্রম করে উপার্জন করতে পারেন, কিন্তু দেশে ফিরে সৎ পথে আয় করতে গেলে লজ্জায় পড়েন। কারণ আমাদের সমাজ পদবি দেখে, পেশা নয়। প্রবাসে ক্লিনারের কাজও সম্মানের, দেশে চায়ের দোকান দিলে উপহাস। অথচ মূল প্রশ্ন হওয়া উচিত ছিল—“এই আয় কি সৎভাবে হয়েছে?” তা না হয়ে আমরা জিজ্ঞেস করি—“এই আয় কি অনেক হয়েছে?” আমরা ভদ্রতার মুখোশে লুকিয়ে দুর্নীতিকে মর্যাদা দিই, আর সততাকে দারিদ্র্যের প্রতীক বানিয়ে ফেলি।
এই মানসিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সহজ নয়। কারণ সমাজ প্রতিনিয়ত বলে, “সবাই করে, তুমিই বা বাদ যাবে কেন?” কিন্তু এখানে ভুলটা স্পষ্ট—যদি সবাই ভুল করে, তাতে কি ভুলটা সঠিক হয়ে যায়? যদি সবাই ঘুষ নেয়, তবুও একজন যখন না বলেন, তখনই সমাজে পরিবর্তনের প্রথম স্পন্দন শুরু হয়। একজন ব্যাংক কর্মকর্তা যদি প্রতিদিনের ‘স্পিড মানি’র লোভে না পড়ে, তিনিই তো নীতির পক্ষে দাঁড়ালেন।
সমাজের সম্মান এখন আর নীতির ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় না, বরং কার গাড়ি কত দামি, কে কত বড় অফিসে কাজ করে—তা দিয়েই সম্মান মাপা হয়। একজন সৎ মুদি দোকানদারকে দেখা হয় তাচ্ছিল্যের চোখে, অথচ এক দুর্নীতিবাজ ঠিকাদারকে আমরা নিমন্ত্রণ করি, হাসিমুখে গ্রহণ করি। শিক্ষা আমাদের ডিগ্রি দেয়, কিন্তু শ্রমের মর্যাদা শেখায় না—ফলে একজন তরুণ ফ্রিল্যান্সারও আত্মীয়স্বজনের চোখে “বেকার” হয়ে যায়, যদিও সে কারও ঘুষ খায় না, নিজের পরিশ্রমেই বাঁচে।
যদি সত্যিই চাই, সমাজ বদলাতে, তাহলে নতুন প্রজন্মকে চোখে দেখাতে হবে মূল্যবোধ। বাবারা যদি ঘরে ঘুষ দিয়ে, মিথ্যা বলে সন্তানদের ‘সৎ হও’ বলেন, তবে তা কার্যকর হবে না। একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী, একজন কৃষক, একজন সৎ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা—তাঁরাই যেন হোন শিশুদের রোল মডেল। বইয়ে নয়, জীবনের গল্পে শেখাতে হবে, সততা মানে দুর্বলতা নয়—সততা মানে সাহস।
এবং সেই সাহসী মানুষদের সামনে আনতে হবে—যাঁরা আড়ালে থেকে বাঁচেন সত্যের শক্তিতে। মিডিয়া ও সামাজিক প্ল্যাটফর্মে তাঁদের গল্প ভাইরাল করতে হবে, যেন তরুণরা বুঝতে পারে—এই পথও সম্ভব। একজন সরকারি কর্মকর্তা যদি ঘুষের সব প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন, তাঁকেই বানাতে হবে জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। একজন শিক্ষক যদি নিয়মমাফিক সময়মতো ক্লাস নেন, তিনিই হোন রোল মডেল।
কারণ যদি সৎ মানুষরা লজ্জা পায়, মুখ লুকিয়ে থাকে, তবে দুর্নীতির জয় অনিবার্য। সমাজের ভিত রক্ষা করতে হলে, সৎ মানুষদের আত্মমর্যাদা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। মাথা উঁচু করে বলতে হবে—“আমি ছোট আয় করি, কিন্তু কারও টাকা খাই না।” সেটাই বড় গৌরব, সেটাই আসল স্বাধীনতা।
এমন কিছু মানুষ ইতিমধ্যেই আছেন আমাদের চারপাশে। যেমন, ঢাকার মিরপুরে আলতাফ হোসেন—একজন চা-ওয়ালা, যিনি অতিরিক্ত এক পয়সাও নেন না। একদিন তার দোকানের সামনে এক মানিব্যাগ পড়ে থাকে—ভিতরে চল্লিশ হাজার টাকা। সবাই বলেছিল, রেখে দাও। কিন্তু তিনি তা ফেরত দেন, খুঁজে বের করে। তাঁর দোকানে এখন দ্বিগুণ কাস্টমার—কারণ মানুষ বিশ্বাস করতে চায়, সৎ মানুষ আজও আছে। আলতাফ বলেন, “টাকা দিয়ে ইজ্জত কেনা যায় না, কিন্তু ইজ্জত থাকলে টাকা আসবেই।”
আছে রুনা আক্তার—একজন গ্রামের তরুণী, যিনি ইউটিউব দেখে ফ্রিল্যান্সিং শিখে এখন ১৫ নারীর কর্মসংস্থান করেছেন। প্রথমে কাঁথা সেলাই করে ডেটার টাকা জোগাড় করতে হতো, কিন্তু কখনো অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি হননি। তিনি বলেন, “আমি শুধু টাকা নয়, মানসিক শান্তিও চাই। সৎভাবে উপার্জনই আমাকে রাতে নিশ্চিন্ত ঘুম দেয়।”
আছে রফিকুল ইসলাম—পাবলিক সার্ভিসে উত্তীর্ণ হয়েও ঘুষ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ফিরে গেছেন নিজের গ্রামে। এখন তিনি অর্গানিক কৃষিকাজ করেন, অন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেন। তাঁর প্রতিষ্ঠান ‘সততা কৃষি’ শুধু ব্যবসা নয়, এক আন্দোলনের নাম। তিনি বলেন, “আমি রাষ্ট্রের চাকরি করিনি, কিন্তু সমাজের জন্য কিছু করছি—সেটা আমার কাছে অনেক বড়।”
এইসব গল্প তাঁদের জন্য, যারা মনে করেন, “সবাই চুরি করলে আমিও করব কেন?” কিংবা যারা এখনো দ্বিধায় আছেন, সত্যের পথ ধরবেন কি না। এইসব মানুষদের দেখে মনে হয়—সৎ থেকেও সম্ভব, মাথা উঁচু করে বাঁচা যায়।
কারণ সৎ উপার্জন কখনো ছোট নয়। তা ছোট আয় হতে পারে, কিন্তু তাতে থাকে ঘুম, থাকে গর্ব, থাকে আত্মমর্যাদা। আমরা যদি সম্মান দিই ছোট কাজকে, সাহস দিই সৎ মানুষদের, শ্রদ্ধা করি নিজের বিবেককে—তবে সমাজও আমাদের প্রতিদান দেবে।
বিবেক হারালে শুধু একজন ব্যক্তি নয়, একটি সমাজ হারিয়ে যায়। আর যখন একজন সৎ মানুষ নিজের দুর্বলতা ভুলে মাথা তুলে দাঁড়ান, তখন সমাজের ভিত নড়ে না—তা আরও শক্ত হয়।
কিন্তু এই সত্য-নিষ্ঠ জীবন সবসময় বাহবা পায় না। সমাজ প্রায়শই এই মানুষদের উদাহরণ বানিয়ে রাখে, অনুসরণ করার জন্য নয়—দেখিয়ে দেওয়ার জন্য যে “ভালো থাকলেও ভালো থাকা যায় না।” যারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করে চাকরি হারায়, যারা ঘুষ নেয় না বলে বদলি হয়, যারা সৎ পথে থাকায় উন্নতির পথ আটকে যায়—তাদের আমরা কেবল করুণার চোখে দেখি। অথচ করুণা নয়, তাঁদের প্রাপ্য ছিল শ্রদ্ধা। কারণ তাঁরা হেরে গেলেও তাঁদের অবস্থান ভুল ছিল না। তাঁরাই বলেন, “আমি আপস করিনি,” আর এই কথাটিই একদিন আমাদের সন্তানদের গর্বের উপাখ্যান হয়ে উঠতে পারে।
একটা শিশু যখন দেখে, তার বাবা সৎ থেকেও পিছিয়ে পড়ে, তার শিক্ষক ঘুষ না নিয়ে গরিব থাকে, তখন সে প্রশ্ন করে, “বাবা, সৎ হলে যদি এমন হয়, তবে আমি হব কেন?” তখন আমরা যদি শুধু বলি, “তুই শুধু নিজের বিবেকটা ঠিক রাখ”—তা যথেষ্ট নয়। আমাদেরকে সমাজের কাঠামোকেই এমনভাবে গড়তে হবে, যাতে সৎ থাকাটাও সফলতার উপায় হিসেবে প্রতিভাত হয়। নচেত আগামী প্রজন্ম আরও বেশি আত্মকেন্দ্রিক ও সুবিধাবাদী হয়ে উঠবে, যারা ভাববে—“আমার লাভই চূড়ান্ত সত্য।”
তাই এখন সময় সৎ মানুষের নীরবতা ভাঙার। তাঁদের গল্প শুধু পরিবারে নয়, জাতির সামনে তুলে ধরার। সাংবাদিক, শিক্ষক, সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা—সবার দায়িত্ব একটাই হওয়া উচিত: নায়ক বানাতে হবে সত্যবাদীদের। সিনেমার পর্দায় চোর যদি স্টাইলিশ হয়, বাস্তব জীবনের সৎ মানুষকে আমরা যদি উপহাস করি, তাহলে তরুণেরা কার পথ অনুসরণ করবে? পরিবর্তন আনতে হলে আমাদেরকে নতুন কল্পনা তৈরি করতে হবে—যেখানে নৈতিকতা দুর্বলতা নয়, বীরত্ব। যেখানে অর্থ নয়, শ্রদ্ধাই চূড়ান্ত মাপকাঠি।
অনেকে বলেন, এই দেশে কিছুই হবে না। অনেকে বলেন, “ব্যবস্থা’টাই এমন।” কিন্তু এই ব্যবস্থাটা গঠিত হয় আমাদের চুপচাপ মেনে নেওয়া থেকে। আমরা যদি একবার নির্ভয়ে বলি, “না”—তবে সেই ব্যবস্থাও বদলায়। একজন বাসচালক যদি বাড়তি ভাড়া না নেন, একজন ছাত্র যদি প্রশ্ন ফাঁস হওয়া সত্ত্বেও পরীক্ষা না দেয়, একজন সাংবাদিক যদি গোপন ডিল প্রত্যাখ্যান করেন—তবে আমাদের সন্তানরা জানবে, বিকল্প পথও আছে।
সেই বিকল্প পথ সহজ নয়—এটা জানি। তবে এই পথেই শান্তি আছে। কারণ রাত শেষে একজন মানুষ যখন আয়নায় তাকান, আর নিজের চোখে নিজের ভয়ের চিহ্ন না খুঁজে পান, তখন তিনি জানেন—তাঁর জীবন ছোট হতে পারে, কিন্তু তা সঠিক। যেখানে টাকা, পদবি, খ্যাতি—সবই একদিন ফুরিয়ে যাবে, সেখানে একমাত্র অবিনাশী জিনিসটি হলো আত্মমর্যাদা।
তাই এই লেখাটি শুধু কষ্টের নয়, এক অনুরোধেরও। যদি আপনি এখনো সততার পথ বেছে নিচ্ছেন, কিংবা নিতে চান, তবে জানবেন—আপনি একা নন। সমাজের চারপাশে ছড়িয়ে আছেন আরও অনেকে, যারা চুপচাপ, দৃঢ়ভবে সত্যকে ধারণ করে আছেন। আপনাকে কেবল তাঁদের খুঁজে নিতে হবে। এই নীরব সেনানিরা মুখর হয়ে উঠলেই সমাজ বদলায়।
আমরা চাই এমন একটি সমাজ, যেখানে একজন কর্মচারি ঘুষ না নিয়ে বাড়ি ফিরলে স্ত্রী বলেন, “তোমার সততাই আমার গর্ব।” যেখানে একটি শিশুকে প্রশ্ন করা হয় না, “তোমার বাবা কী করেন?” বরং বলা হয়, “তোমার বাবা কেমন মানুষ?” যেখানে আয় নয়, আয়বিধি বড় কথা। আর যেখানে একজন মানুষের বিবেক, তাঁর পেশা নয়, মানুষ হওয়াটাকেই সংজ্ঞায়িত করে।
একটি সমাজে যেখানে নৈতিকতা বিসর্জন দেওয়া যেন সাফল্যের সবচেয়ে সহজ রাস্তা, সেখানে বিবেক নিয়ে বেঁচে থাকা মানে এক ধরণের নিঃশব্দ, অদৃশ্য যন্ত্রণা বয়ে বেড়ানো। এ এক পাঁচ স্তরের গভীর অনুভূতির গল্প, একজন বিবেকবান মানুষের যাত্রা কেবল নৈতিক সিদ্ধান্তের নয় — এটি এক অন্তর্গত যন্ত্রণারও। এই যাত্রা সাধারণত পাঁচটি স্তরে গঠিত হয়। প্রথমত, অনুশোচনা—নিজের পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত বা ভুল আচরণের জন্য অন্তরদহন। দ্বিতীয়ত, অসহায়ত্ব—প্রিয়জনের ভুল দেখেও কার্যত কিছু করতে না পারার বেদনা। তৃতীয়ত, হতাশা—নিরন্তর সতর্কতা সত্ত্বেও সমাজের শ্রবণহীনতা ও উপহাস। চতুর্থত, সহভোগিতা—ভুল না করেও ভালোবাসার মানুষদের কষ্টে মানসিক যন্ত্রণাভোগ। আর পঞ্চম স্তরে আসে বিষণ্ণতা ও ক্লান্তি—ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া এক অভ্যন্তরীণ মৃত্যু, যা সমাজ কখনো দেখে না, জানতেও চায় না, যা বাংলাদেশের বহু মানুষ নীরবে বহন করে যাচ্ছেন।
এই লেখাটি শেষ হচ্ছে, কিন্তু যে প্রশ্নটি শুরুতে ছিল, তা থেকে যাচ্ছে—আপনি কি সত্যিই ভাবেন, সততা দিয়ে বাঁচা যায় না? নাকি আপনি এখন একটু হলেও অনুভব করছেন, যে বাঁচা মানে কেবল আয় নয়—বাঁচা মানে হৃদয় নিয়ে বাঁচা?
যদি উত্তর হয় ‘হ্যাঁ’, তাহলে আপনি নিজেই এক সম্ভাবনার নাম।
লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন

মত দ্বিমত
যোগ্যতা, নিষ্ঠা ও সততা: সত্যিকারের গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি

গণতন্ত্র শব্দটি উচ্চারণ করা যত সহজ, তার নৈতিক ভার বহন করা ততটাই কঠিন। আমরা প্রায়শই গণতন্ত্রকে বুঝি একটি নির্বাচনী পদ্ধতি হিসেবে—যেখানে জনগণ ভোট দেয়, সরকার গঠিত হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠতা নির্ধারণ করে নীতি। কিন্তু এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা যদি গড়ে ওঠে অসৎ, প্রভাবশালী কিংবা অর্থবিত্তনির্ভর প্রার্থীদের মধ্যে, যারা জনগণের প্রতিনিধিত্ব নয় বরং ক্ষমতার ভাগাভাগি করতে আসে—তবে সেটি গণতন্ত্রের বিজয় নয়, বরং তার পরাজয়।
নির্বাচন তখন কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা হয়ে দাঁড়ায়, যেখানে ভোটের বাক্সে পড়ে থাকে মানুষের প্রত্যাশা, অথচ উত্থিত হয় দুর্নীতির দাপট, গোষ্ঠীস্বার্থের বিভাজন আর নৈতিক শূন্যতা। কেবল ভোট গ্রহণের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয় না—যদি সেই ভোটে জনগণের সামনে প্রকৃত পছন্দ না থাকে, যদি প্রার্থী বাছাই হয় অনৈতিক, দলীয় সুবিধা ও টাকার বিনিময়ে—তবে গণতন্ত্রের ভিত নিজেই ধসে পড়ে।
একটি মানচিত্র রাষ্ট্র হতে পারে মাত্র কাগজে-কলমে, কিন্তু একটি জাতিকে গণতান্ত্রিক করতে হলে চাই এমন নেতৃত্ব, যারা জনগণের হৃদয় থেকে উঠে আসে। চাই এমন নেতৃত্ব, যার ভিত্তি নীতিতে, দায়বদ্ধতায় ও মানবিকতায় গাঁথা। কারণ গণতন্ত্র কেবল ভোটের সংখ্যা নয়—গণতন্ত্র মানে মানুষের প্রতি আস্থা, নৈতিকতার প্রতি শ্রদ্ধা, এবং ভবিষ্যতের প্রতি প্রতিশ্রুতি।
গণতন্ত্রের কথা যখন বলি, তখন আমাদের চোখে ভেসে ওঠে ব্যালট বাক্স, ভোটার সারি, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন, কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সরকার গঠনের আনুষ্ঠানিক রূপরেখা। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই দৃশ্যপটটি কি যথেষ্ট?
একটি ভোটগ্রহণ যদি নিয়মমাফিক, শান্তিপূর্ণ ও সময়মতো অনুষ্ঠিত হয়, তবু যদি সেই নির্বাচনে প্রার্থী নির্বাচনের প্রক্রিয়া হয় অনৈতিক, স্বার্থান্বেষী এবং পুঁজিশ্রেণিনির্ভর, তাহলে সেই গণতন্ত্রের ভিত কতটা দৃঢ়? গণতন্ত্র কি কেবল সেই কাঠামো, যেখানে টাকার জোর, গোষ্ঠীর ক্ষমতা ও দলীয় আনুগত্যই মনোনয়নের মানদণ্ড হয়ে দাঁড়ায়? তাহলে সেখানে জনগণের ভূমিকা কী? একজন ভোটার কি শুধু সংখ্যার অংক, না কি তিনি জাতির নৈতিক ভবিষ্যতের রচয়িতা? নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় যদি জনগণের সামনে প্রকৃত বিকল্প না থাকে—যদি প্রার্থী বাছাই হয় সৎ, যোগ্য ও দায়বদ্ধতার ভিত্তিতে নয়, বরং দুর্নীতি, ভয় এবং ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতায়—তাহলে সেই গণতন্ত্র একটি নিঃসাড় প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়।
রাষ্ট্র গঠন করা যায় সীমান্ত টেনে, পতাকা টাঙিয়ে, সংবিধান লিখে। কিন্তু একটি জাতিকে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক জাতিতে রূপ দিতে হলে চাই নৈতিকতা, যোগ্যতা ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ নেতৃত্ব। চাই এমন নেতৃত্ব, যারা জনগণের ভালোবাসা অর্জন করে; যারা ব্যালট পায় ভয় দেখিয়ে নয়, আস্থা জাগিয়ে। কারণ গণতন্ত্র মানে কেবল সরকার গঠন নয়—গণতন্ত্র মানে মানুষের মর্যাদা, ভবিষ্যতের প্রতি নৈতিক দায়, আর নেতৃত্বের চরিত্রের ওপর জাতির বিশ্বাস স্থাপন।
কেমন প্রার্থী চাই—জনগণের প্রতিনিধি না হলে কিসের গণতন্ত্র? গণতন্ত্র কেবল সংখ্যার খেলা নয়, এটি হলো বিশ্বাস ও প্রতিনিধিত্বের পবিত্র চুক্তি।
কিন্তু সেই চুক্তি তখনই অর্থহীন হয়ে যায়, যখন নির্বাচনে দাঁড়ানো প্রার্থীরা জনগণের প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন না—বরং হয়ে ওঠেন দল, ধনিকশ্রেণি বা গোষ্ঠীস্বার্থের বাহক।
প্রকৃত গণতন্ত্র চায় মানবিক, বিবেকবান, এবং দায়িত্বশীল নেতৃত্ব—যেখানে একজন প্রার্থীর পরিচয় হবে তাঁর মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সততা, জবাবদিহি ও জনসেবার মানসিকতা দিয়ে।
একজন যোগ্য প্রার্থীর মধ্যে থাকতে হবে:
• জনগণের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠবার সাহস,
• এলাকার সমস্যা বোঝার জ্ঞান ও আন্তরিকতা,
• সংসদে গিয়ে নীতিনির্ধারণে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার সক্ষমতা,
• এবং—সবচেয়ে জরুরি—নিজেকে দেশ ও মানুষের সেবায় উৎসর্গ করার অটল মানসিকতা।
তিনি জনপ্রিয় নন, হবেন প্রাসঙ্গিক। তিনি বড় পোস্টারে নয়, থাকবেন মানুষের বিশ্বাসে। তাঁর পরিচয় হবে না কোনো মিডিয়া-মেড প্রভাবশালী নেতা হিসেবে, বরং তিনি হবেন আস্থা, সততা ও সক্রিয় দায়বদ্ধতার প্রতীক।
তিনি দলীয় সিদ্ধান্তে মনোনীত হবেন না, তাঁকে মনোনীত করবে জনতার বিবেক। এবং এটি কোনো কল্পলোকের আকাশকুসুম ভাবনা নয়—এটি আমাদের ন্যায্য দাবি। জনগণের দাবি, গণতন্ত্রের দাবি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দাবি। কারণ, যদি প্রতিনিধি না হন জনগণেরই, তবে তিনি কিসের প্রতিনিধি?
যদি তাঁর হৃদয়ে না থাকে মানুষের জন্য ব্যথা, তবে তাঁর হাতে ব্যালট তুলে দেওয়া মানে নিজেদের ভাগ্য নিজ হাতে নষ্ট করা। গণতন্ত্রকে যদি সত্যিকারের গণতন্ত্র করতে হয়, তাহলে নেতা হতে হবে আদর্শের, প্রতিশ্রুতির, এবং সেবার প্রতীক—ক্ষমতার নয়।
ভয়মুক্ত ভোটাধিকার—গণতন্ত্রের প্রাণস্পন্দন। একটি সত্যিকারের গণতন্ত্রের মূলে আছে ভোটারদের ভয়মুক্ত ও স্বাধীন নির্বাচনাধিকারের মর্যাদা। কোনো নাগরিক যেন কোনো ভয়, হুমকি, দমনে বা লোভ-প্রলোভনে আটকা পড়ে ভোট দিতে বাধ্য না হয়—এটাই হতে হবে আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অপরিহার্য শর্ত। ভোটার যখন ভোট দেয়, তখন তাঁর হাতে থাকতে হবে একটি শক্তিশালী অস্ত্র—বিবেকের স্বাধীনতা ও গর্বের অনুভূতি। ভোট হতে হবে ভয়ভীতির নয়, বরং নিশ্চিত বিশ্বাসের প্রকাশ। আমাদের সবাইকে নিশ্চিত করতে হবে যে, ভোটারের পছন্দের ওজন আছে, তাঁর ভোটের প্রতি শ্রদ্ধা আছে, এবং তাঁর ভোটই নির্ধারণ করে দেশের ভবিষ্যৎ পথচলা। কেউ যেন না বলে—“আমার ভোট কোনো কিছু বদলাতে পারে না।”
ভোটের আগে ছড়িয়ে পড়তে হবে ভয়ের নয়, আত্মবিশ্বাস ও উৎসাহের জোয়ার। ঘরে ঘরে, কমিউনিটি থেকে শুরু করে সমাজের সর্বত্র যেন শোনা যায়—“আমি ভোট দেব কারণ আমি বিশ্বাস করি।” এমন বিশ্বাস গড়ে তোলার জন্য দরকার এমন প্রার্থী, যাঁরা সত্যিকার অর্থে জনগণের আস্থা অর্জন করেছেন, যাঁরা ভোটারের স্বপ্ন ও প্রত্যাশার প্রতিফলন। ভয়মুক্ত ভোটাধিকার হলে গণতন্ত্র বাঁচে, শক্তিশালী হয়, এবং মানুষের প্রত্যাশা বাস্তবায়ন হয়। এটাই হবে আমাদের ন্যায্য অধিকার, আমাদের জাতির গৌরব।
এই অচল অবস্থা থেকে উত্তরণের পাঁচটি রূপান্তরমূলক পথ;
গণতন্ত্রের বর্তমান সংকট কোনো সাময়িক সমস্যা নয়—এটি একটি নৈতিক, কাঠামোগত ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয়।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণ চাইলে শুধু প্রতিরক্ষা নয়—পুনর্নির্মাণ করতে হবে গণতন্ত্রকে, গড়ে তুলতে হবে এমন এক কাঠামো যা নেতৃত্বে আনে সততা, প্রজ্ঞা ও জনকল্যাণ। এ জন্য জরুরি পাঁচটি নির্ভুল ও অনিবার্য পরিবর্তন—যা একযোগে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নাগরিক অংশগ্রহণকে নতুন করে গড়ে তুলবে:
১. নৈতিক নীতিমালা-ভিত্তিক মনোনয়ন প্রক্রিয়া: রাজনীতিতে নৈতিক ফিল্টার চাই।
রাজনৈতিক দলগুলোকে আর আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেওয়ার অবকাশ নেই। তাদের অবশ্যই এখনই যৌথভাবে একটি ন্যূনতম নৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, যার ভিত্তিতে মনোনয়ন দেওয়া হবে। অতীতে দুর্নীতি, সহিংসতা বা ক্ষমতার অপব্যবহারে জড়িত—এমন কেউ মনোনয়নের যোগ্য হতে পারেন না। নৈতিকতা আর দলীয় আনুগত্যকে এক পাল্লায় তোলা যাবে না। এই শর্তটি হতে হবে অনড়, অচলযোগ্য এবং সর্বজনগ্রাহ্য।
২. নির্বাচন কমিশনের তথ্য যাচাই ও সর্বজনীন উন্মোচন: গোপন নয়, স্বচ্ছতা চাই।
নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব শুধু ভোট আয়োজন নয়, নির্বাচনের নৈতিক কাঠামো নিশ্চিত করাও তার কাজ। প্রার্থীদের আর্থিক, সামাজিক ও আইনগত পটভূমি—সহ সব তথ্য কঠোরভাবে যাচাই করতে হবে। এবং তা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে, যাতে ভোটাররা অন্ধ নয়, সচেতনভাবে ভোট দিতে পারেন। ভোটার যেন জানেন—আমি যাকে ভোট দিচ্ছি, সে কে? তাঁর অতীত কী? তাঁর জনসেবা কতটা প্রমাণিত?
৩. “Public Scrutiny Platform”: জনগণের হাতে নেতার হিসাব চাই।
একটি স্বাধীন ও সর্বজনসম্পৃক্ত “Public Scrutiny Platform” গঠনের আহ্বান জানাতে হবে, যেখানে সাধারণ মানুষ, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজ মিলে প্রার্থীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই করতে পারবে। এটি হবে নাগরিক পর্যায়ে একটি জবাবদিহিমূলক শক্তি, যেখান থেকে কেউ রেহাই পাবে না। রাজনীতিকে বাঁচাতে হলে—নেতাদেরও মানুষের সামনে দাঁড়াতে হবে খোলা হাতে ও খোলা চোখে।
৪. রাজনৈতিক শিক্ষা পাঠ্যক্রমে সংযুক্তি: সচেতন নাগরিক ছাড়া গণতন্ত্র অর্থহীন।
রাজনৈতিক অশিক্ষা গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শত্রু। আজ আমাদের দরকার রাজনৈতিক সাক্ষরতা (Political Literacy)—যাতে নতুন প্রজন্ম বুঝে তাদের অধিকার, দায়িত্ব ও রাষ্ট্রের কাঠামো। এই বিষয়টি মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রমেই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যেন ছাত্রছাত্রীরা বড় হয়ে কেবল পাস নয়, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পরীক্ষায়—নাগরিকত্বে—পাস করতে পারে।
৫. তরুণ সমাজ ও শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে নৈতিক জাগরণ: নেতৃত্ব ফিরিয়ে আনুক তার আসল রূপ।
এই সময়ের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তরুণদের বিবেক ও তাদের প্রশ্ন করার সাহস। তাঁরা শুধু ভোটার হয়ে থাকবে না—হবে পরিবর্তনের মূল চালক। তাঁরা প্রচার চালাক, বিতর্কে যুক্ত হোক, সৎ প্রার্থীর জন্য গণজোয়ার তৈরি করুক—এভাবেই শুরু হবে নতুন ধারার রাজনীতি। নেতৃত্ব কেবল অভিজ্ঞতায় নয়—নৈতিকতাতেও জন্ম নিতে পারে, এবং সেই জন্ম দিতে পারে আজকের শিক্ষার্থী, আজকের তরুণ, আজকের সোচ্চার নাগরিক। এই পাঁচটি স্তম্ভ দিয়েই গড়ে উঠতে পারে একটি নৈতিক, জবাবদিহিমূলক ও মানবিক গণতন্ত্র। এটা কোনো স্বপ্ন নয়, এটা এখন সময়ের দাবি। এবং এই দাবির পক্ষে দাঁড়ানোর সাহস আজ আমাদের সবার থাকা উচিত। আমরা কী চাই—সুন্দর নির্বাচন, না সৎ নির্বাচন?
আমরা যেন আর কেবল “সুষ্ঠু নির্বাচন চাই” এই নিরাপদ বাক্যে আটকে না থাকি। আমরা বলি—“আমরা চাই এমন নির্বাচন, যেখানে প্রার্থীরা হবেন নৈতিক, যোগ্য ও জনগণের সত্যিকারের প্রতিনিধি।” আমরা আর “কম খারাপ” কে বেছে নেওয়ার সংস্কৃতি চাই না। আমরা চাই, “সেরা মানুষটি”—সততার প্রতীক, জনসেবার সৈনিক, মানুষের আশা ও আস্থার বাহক—তাঁর হাতে তুলে দিতে দায়িত্ব।
এই সিদ্ধান্ত শুধু রাজনৈতিক নয়, এটি নৈতিক।এটি কেবল একটি ভোট নয়—এটি একটি জাতির আত্মাকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই। গণতন্ত্রের সৌন্দর্য তখনই ফুটে ওঠে, যখন তা কেবল নিয়ম নয়—প্রতিটি মানুষের মঙ্গলচিন্তার আঙিনায় দাঁড়ায়। এবং সেই গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ তখনই উজ্জ্বল, যখন নেতৃত্বের ভিত্তি হয় সততা, দায়িত্ব ও ভালোবাসা। গণতন্ত্র মানে কেবল ব্যালট নয়—এটি বিবেকের প্রতি শ্রদ্ধা, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, এবং সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর সাহস।
রাজনীতি যদি সৎ মানুষের জায়গা না হয়, তবে অসৎ মানুষের আসন নিশ্চিত হয়। যেখানে ভালো মানুষ চুপ থাকে, সেখানেই দুর্নীতি কথা বলে। এখনই সময়—নির্বাচনের নামে চলা প্রহসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর। এখনই সময়—যোগ্যতা, নিষ্ঠা ও সততার পক্ষে কণ্ঠ মেলানোর। গণতন্ত্রকে রক্ষা করার একটাই উপায়— তাকে নৈতিকতা দিয়ে পূর্ণ করা, মানুষ দিয়ে অর্থবহ করা, এবং বিবেক দিয়ে পরিচালিত করা।
রহমান মৃধা
লেখক ও গবেষক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
rahman.mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
খাদ্য, নৈতিকতা ও নেতৃত্ব: জাতিকে আলোর পথে নিতে যাঁরা নিঃশব্দে কাজ করছেন

সুইডিশ ভাষায় কিছু শব্দ রয়েছে যেগুলোর মধ্যে এক ধরনের অন্তর্নিহিত শক্তি ও গভীর তাৎপর্য লুকিয়ে থাকে। এমনই একটি শব্দ ‘livsmedel’—অর্থাৎ ‘জীবনের উপকরণ’। শব্দটি শুধু খাদ্য বোঝায় না, বোঝায় এমন কিছু যা আমাদের পুষ্টি দেয়, শক্তি জোগায়, এবং মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার সামর্থ্য গড়ে তোলে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আজকের বাজারে আমরা যে খাদ্য কিনছি—তা কি সত্যিই জীবনের উপকরণ? নাকি সেগুলো এমন কিছু, যা ধীরে ধীরে আমাদের ঠেলে দিচ্ছে রোগব্যাধি, ক্লান্তি, নির্ভরশীলতা আর নিঃশব্দ বিষক্রিয়ার দিকে?
আমরা প্রায়ই বলি, সুইডেন এমন একটি দেশ যেখানে গুণমান (quality) পরিমাণের (quantity) চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ‘লগোম’—অর্থাৎ পরিমিতিবোধ—এখানে একপ্রকার সাংস্কৃতিক বিশ্বাস। কিন্তু বাস্তবে, খাদ্যের ক্ষেত্রে আমরা এমন এক বৈশ্বিক ব্যবস্থার অংশ হয়ে পড়েছি, যেখানে ‘লগোম’-এর জায়গা দখল করে নিয়েছে—‘যত সস্তা সম্ভব’, ‘যত দীর্ঘ সময় সংরক্ষণযোগ্য’, এবং ‘শিল্পের সুবিধার জন্য যতটা সম্ভব প্রক্রিয়াজাত’ এই নীতিগুলো।
আজ আমরা সুইডেনে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে যে খাবার আমদানি করছি, তা দেখতে যতই ঝকঝকে হোক না কেন, তার পুষ্টিমান প্রায়শই শূন্য। এসব খাবারে থাকে সংরক্ষণের রাসায়নিক, কৃত্রিম রং, স্বাদ বাড়ানোর উপাদান, ফিলার—আরও কত কী! এই তালিকা শুধু দীর্ঘ নয়, দিনে দিনে আরও দীর্ঘতর হচ্ছে। শিল্পোন্নত দেশ হওয়া সত্ত্বেও সুইডেন কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে। তারা বলছে—livsmedel, এই শব্দটির প্রকৃত মর্যাদা আমাদের ফিরিয়ে আনতেই হবে।
অথচ বাংলাদেশের মতো দেশে এখনো এমন কোনো সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না, যা দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার—‘ভেজালমুক্ত ভাতে-মাছে বাঙালির বাঙালিত্ব’—পুনরুদ্ধারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের নিজেদের জিজ্ঞেস করতে হবে—আমরা কী চাই? এমন খাদ্য যা সত্যিকার অর্থে আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, নাকি এমন কিছু, যা ধীরে ধীরে আমাদের ভেতর থেকে ভেঙে দেয়?
এখানেই আসে স্বনির্ভরতার প্রসঙ্গ। আমাদের সাহস করে বলতে হবে—নিজের খাদ্য নিজেই উৎপাদন করতে না পারলে, স্বাধীনতা অর্থহীন। মহামারির সময় আমরা এক ঝলক দেখেছিলাম—যখন বিশ্বব্যাপী সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, তখন কীভাবে খাদ্যনিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
আজকের পৃথিবীতে, যেখানে যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে, সেখানে নিজের খাদ্য নিজে উৎপাদনের সক্ষমতা শুধু যুক্তিসঙ্গত নয়—জীবনের জন্য অপরিহার্য। আমাদের দরকার এমন খাবার যা শুধু পেট ভরে না, আমাদের বিশ্বাস, স্বাস্থ্য ও মর্যাদাও রক্ষা করে। আমাদের দরকার নিরাপদ খাবার। প্রকৃত খাবার। এমন খাবার, যার উৎস আমরা জানি—আর যেটি কেবল আহার নয়, এক ধরনের আশ্বাস।
আমি সুদূর প্রবাসে বসে যখন এ রকম একজন মাটি-কেন্দ্রিক, বিজ্ঞানমনস্ক, দেশপ্রেমিক মানুষের কর্মযজ্ঞ দেখি, তখন এক প্রশ্ন আমাকে তাড়া করে ফেরে—দেশের মানুষ কেন এমন একজন সম্পদকে চিনতে ব্যর্থ হচ্ছে? কেন এমন একজন দূরদর্শী কৃষিবিজ্ঞানীর আলোর রেখা আমরা জাতীয় নীতিতে পরিণত করতে পারছি না?
খাদ্যই উন্নয়নের মূল: কৃষকের পাশে ড. আলী আফজাল এবং একটি জাতির কৃতজ্ঞতা
যেহেতু জীবন ধারণের সবকিছুই শুরু হয় খাদ্য দিয়ে। খাদ্য শুধু আমাদের শরীরের জ্বালানি নয়—এটি মনের বিকাশ, সৃজনশীলতা এবং উন্নয়নের ভিত্তি। পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত না হলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মক্ষমতা ও সমাজব্যবস্থার ভিত্তি ভেঙে পড়ে। একজন রাজনীতিবিদ হোন বা প্রকৌশলী, শিক্ষক হোন বা সেনা সদস্য—সবার অস্তিত্বের পেছনে নির্ভরতা এক জায়গাতেই খাদ্য।
কিন্তু যে মানুষগুলো প্রতিদিন আমাদের এই খাদ্যের নিশ্চয়তা দেন—কৃষক, খামারী, মৎস্যজীবী ও গ্রামীণ পরিশ্রমজীবী জনগোষ্ঠী—তাঁদের অবদান আজও সমাজ ও রাষ্ট্রে ন্যায্য সম্মান পায় না। বরং অবহেলা, অনিশ্চয়তা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের চাপে তাঁরা পিছিয়ে থাকেন। এই বাস্তবতায় একজন মানুষ দীর্ঘদিন ধরে নিরবে, কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি মাগুরার সন্তান, আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত কৃষিবিজ্ঞানী, সফল উদ্যোক্তা এবং দূরদর্শী সমাজগঠক—ড. মো. আলী আফজাল।
একজন কৃষকের সন্তান থেকে কৃষি-নেতা হওয়ার গল্প
১৯৬৭ সালের ২২ মার্চ মাগুরার মোহাম্মদপুর উপজেলার বালিদিয়া গ্রামে জন্ম নেওয়া ড. আফজালের শিকড় পল্লির মাটিতে। কৃষকের সন্তান হিসেবে তিনি জানতেন, কৃষির প্রকৃত সমস্যা কী, এবং সেগুলোর সমাধান কোন পথে সম্ভব। শিক্ষা ও গবেষণায় অসাধারণ কৃতিত্ব অর্জনের পর তিনি শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন এবং ২০ বছর ধরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে (BARI) কাজ করেন প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে। এ সময় তিনি ২২টি নতুন ফসল উদ্ভাবন করেন এবং ৮২টিরও বেশি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। কিন্তু তিনি শুধু গবেষণাগারে সীমাবদ্ধ থাকেননি। গবেষণাকে মাঠে, কৃষকের হাতে, অর্থনৈতিক বাস্তবতায় রূপ দিতে চেয়েছিলেন। সেই চিন্তা থেকেই ২০০৯ সালে মাত্র ৩০ হাজার টাকা নিয়ে ৫ জন সহকর্মীকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন Krishibid Group Bangladesh (KGB)—যা আজ দেশের অন্যতম বৃহৎ কৃষি-ভিত্তিক শিল্পগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে।
এক ছাতার নিচে কৃষির পূর্ণ সমাধান
বর্তমানে KGB-এর অধীনে ৩৩টি কোম্পানি রয়েছে যা মাটি ও বীজের গুণমান, সার, কীটনাশক, আধুনিক যন্ত্রপাতি, পশুখাদ্য, দুগ্ধজাত পণ্য, মাছ-মাংস উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের সাথে যুক্ত। কৃষকদের জন্য এটি একটি বাস্তব “ওয়ান-স্টপ সার্ভিস” ব্যবস্থা, যা তাদের শুধু প্রযুক্তিগত সহায়তা নয়—আর্থিক সুরক্ষা ও আত্মবিশ্বাসও দিচ্ছে।
KGB-তে বর্তমানে ৬৫০০ জন বিনিয়োগকারী রয়েছেন, যাঁদের অনেকেই সরাসরি কৃষক বা কৃষক পরিবারের সদস্য। গত দুই দশকে এই বিনিয়োগকারীদের গড় বার্ষিক রিটার্ন ১৯%, যেখানে মোট Tk ২৫০ কোটি বিনিয়োগের বিপরীতে Tk ৩১৫ কোটি ফেরত দেওয়া হয়েছে—এটাই প্রমাণ করে, এই উদ্যোগ শুধুমাত্র ব্যবসায়িক নয়, এটি একটি সামাজিক বিনিয়োগ ও কৃষক-ক্ষমতায়নের মডেল।
স্থানীয় উদ্যোগ, বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি
ড. আফজাল শুধু বাংলাদেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে কাজ করেছেন। তিনি তাইওয়ান, অস্ট্রেলিয়া ও সিরিয়া-তে কাজ করেছেন উন্নত ফসল উদ্ভাবন এবং খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে, যা তাঁর দর্শনে এক বৈশ্বিক মাত্রা এনেছে। তিনি বুঝতে পেরেছেন—যে জাতি খাদ্যে স্বনির্ভর নয়, সে কখনো স্বাধীন নয়।
রাজনীতির আহ্বান: নীতির মানুষকে নেতৃত্বে চাই
যদিও ড. আলী আফজাল এখনো সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হননি, কিন্তু আমাদের সমাজে আজ এমন নেতৃত্বের অভাব গভীরভাবে অনুভূত হয়—যেখানে জ্ঞান, সততা ও জনসেবার মানসিকতা একত্রে থাকে। তাঁর মতো মানুষদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করা মানে হলো নীতিনির্ভর উন্নয়ন নিশ্চিত করা। আমরা চাই, আগামী দিনে তিনি বাংলাদেশের কৃষিনীতি নির্মাণ ও বাস্তবায়নে সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দিন—এমনকি ভবিষ্যতের একজন যোগ্য ও জনমুখী কৃষিমন্ত্রী হিসেবেও তাঁর অংশগ্রহণ দেশ ও জাতির জন্য আশীর্বাদ হবে।
একজন মানুষের পেছনে একটি জাতির স্বপ্ন
ড. আফজাল আজ শুধুমাত্র একজন সফল ব্যক্তি নন, তিনি একটি দর্শনের প্রতীক—যে দর্শন বলে: “কৃষক যদি বাঁচে, দেশ বাঁচে। খাদ্য যদি নিরাপদ হয়, জাতি সুস্থ থাকে।” আমি সুদূর প্রবাসে বসে যখন এ রকম একজন মাটি-কেন্দ্রিক, বিজ্ঞানমনস্ক, দেশপ্রেমিক মানুষের কর্মযজ্ঞ দেখি, তখন এক প্রশ্ন আমাকে তাড়া করে ফেরে—দেশের মানুষ কেন এমন একজন সম্পদকে চিনতে ব্যর্থ হচ্ছে? কেন এমন একজন দূরদর্শী কৃষিবিজ্ঞানীর আলোর রেখা আমরা জাতীয় নীতিতে পরিণত করতে পারছি না?
আমি বহু বছর বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি। এখন, সুইডেনের মতো শীতল আবহাওয়ায়, কঠিন বাস্তবতার মধ্যেও কৃষিকাজে নিজেকে যুক্ত রেখেছি—শুধু একটি বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য:
“খাদ্য কেবল পেট ভরানোর মাধ্যম নয়; এটি সভ্যতা ও নৈতিকতার বিষয়।” নিরাপদ খাদ্য মানে সুস্থ জাতি, আর ভেজাল মানে বিপর্যয়।
বাংলাদেশে ড. আলী আফজালের মতো একজন বিজ্ঞানী ও সংগঠক থাকা সত্ত্বেও, আমরা আজও কেন নিরাপদ ও ভেজালমুক্ত খাদ্যের জন্য হাহাকার করছি? কেন এখনও কৃষকের ঘাম ও পরিশ্রম যথাযথ সম্মান পাচ্ছে না? কেন জাতি তার প্রকৃত নায়ক ও পথপ্রদর্শককে চিনতে এত বিলম্ব করছে? এই প্রশ্নগুলো শুধুমাত্র প্রশ্ন নয়; এগুলো সময়ের কাছে আমাদের দায়। জবাব চাই, জাগরণ চাই। জাগো বাংলাদেশ, জাগো!
আমি ১৯৮৬ সাল থেকে আমার বড় ভাই প্রফেসর ড. মান্নান মৃধাকে দেখছি—তিনি কেবল একজন শিক্ষাবিদ নন, বরং নিবেদিত সমাজসেবক ও গবেষক, যিনি দেশের শিক্ষা ও গ্রামীণ উন্নয়নে অগ্রদূত। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি দেশের গ্রামীণ কৃষকদের পাশে থেকে মাঠ পর্যায়ের গবেষণামূলক কাজ করে যাচ্ছেন। তার নেতৃত্বে এলাকার প্রথম গবাদি ফার্ম গড়ে উঠেছে, মাছচাষসহ বিভিন্ন কৃষি প্রযুক্তির উন্নয়ন হয়েছে। তার গবেষণার মূল লক্ষ্য সঠিক চাষাবাদ পদ্ধতি প্রচলন ও কৃষকের জীবনমান উন্নয়ন।
তাঁর কাজের কেন্দ্রবিন্দু শুধুমাত্র কৃষি নয়; তিনি সমাজের প্রান্তিক শ্রেণীর ক্ষমতায়নে দৃঢ় বিশ্বাসী। এলাকার শিশুশিক্ষা থেকে শুরু করে সকল স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রান্তিক কৃষকদের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে তিনি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। অসংখ্য শিক্ষার্থী ও গবেষকের তিনি পথপ্রদর্শক, যারা দেশের কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়নে অবদান রাখছেন।
একই লক্ষ্য নিয়ে তিনি আজও নিরলস পরিশ্রম করছেন—বাংলাদেশী মানুষের জীবনে মৌলিক পরিবর্তন আনা, তাদের ভাগ্যে নতুন আলো জ্বালানো, এবং একটি উন্নত, মানবিক ও সম্মানজনক সমাজ গড়ে তোলা, যেখানে প্রতিটি কৃষক ও গ্রামীণ জনগণ সুশিক্ষিত, স্বাবলম্বী ও মর্যাদাবান জীবন যাপন করবে।
আমরা ড. মান্নান মৃধা ও ড. আলী আফজালের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই। প্রার্থনা করি তারা দীর্ঘদিন সুস্থ ও সক্রিয় থাকুন, কৃষক ও দেশের মানুষের পাশে থেকে জাতিকে আলোর পথে নিয়ে যান। যেন বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুর মুখে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের হাসি ফুটে ওঠে—এটাই আমাদের সম্মিলিত আশা ও স্বপ্ন।
রহমান মৃধা
গবেষক, লেখক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com
কাফি
মত দ্বিমত
তরুণদের আহ্বান: বৈষম্যের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রচিন্তা

একটি নৈতিক বিপ্লব, যা শুধু সরকার নয়-সমাজের বিবেককেও প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা এখন আর নিছক শ্রেণিকক্ষের পাঠেই সীমাবদ্ধ নয়। তারা রাস্তায়, চত্বরে, ডিজিটাল মাধ্যমে এবং গণমাধ্যমে জোরালো কণ্ঠে বলছে এ দেশের কাঠামোগত বৈষম্য, দুর্নীতি ও সুবিধাবাদ আর চলতে পারে না। এই তরুণদের নৈতিক জাগরণ কেবল একটি সরকারের পতনের প্রতীক নয়, বরং একটি নতুন রাষ্ট্রচিন্তার সূচনা।
এটা আর শুধু প্রতিবাদ নয়—এটা এক নৈতিক অভ্যুত্থান। রাজপথে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা কোনো দলীয় চেতনার বাহক নয়, বরং তারা এক দগ্ধ সমাজের বিবেক হয়ে উঠেছে। তাদের চোখে লজ্জা, প্রশ্ন, এবং জেগে ওঠা মূল্যবোধ—যা রাষ্ট্রের দীর্ঘকালীন বৈষম্য ও সুবিধাভোগী শ্রেণিকাঠামোর বিরুদ্ধে এক অনিবার্য প্রতিক্রিয়া। দুর্নীতির অন্ধকার গলিতে যখন ন্যায়বিচার নিঃশব্দে কাঁদে, তখন এই তরুণরাই বলে ওঠে: “আমরা চুপ থাকবো না।”
তারা আজ দাবি করছে এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থার, যেখানে শিক্ষক, কৃষক, গৃহকর্মী কিংবা ঝাড়ুদার—সবাই পাবেন সম্মান, নিরাপত্তা ও ন্যায্যতা। রাষ্ট্র যদি কেবল কিছু মানুষের সম্পদের পাহারাদার হয়ে থাকে, তবে সেটি আর জনতার রাষ্ট্র নয়। এই আন্দোলন সেই ব্যবধান ভাঙতে এসেছে—চেতনাকে বদলাতে, কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ জানাতে। এটি কোনো গুজবনির্ভর আবেগ নয়—এটা এক বিবেকসচেতন, তথ্যভিত্তিক বিপ্লব।
বছরের পর বছর ধরে একটি ক্ষুদ্র, শক্তিশালী শ্রেণি সরকারি প্রশাসন, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও অন্যান্য উচ্চপদে থেকে বিশেষ সুবিধা ভোগ করে আসছে। তাঁরা চাকরি চলাকালীন উচ্চ বেতন, নানা ভাতা এবং অবসরে প্রতীকী মূল্যে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় প্লট পাচ্ছেন। অথচ যারা শিক্ষকতা, চিকিৎসা, প্রকৌশল, কৃষিকাজ, শ্রম কিংবা সাধারণ সরকারি চাকরিতে দেশের প্রকৃত সেবা করে যাচ্ছেন—তাঁদের জন্য নেই সম্মানজনক অবসরজীবন কিংবা ন্যূনতম সামাজিক নিরাপত্তা।
এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে, তা পাঁচটি স্পষ্ট দাবিতে সংক্ষেপ করা যায়:
১. ঢাকার চাপ কমাতে সেনানিবাস, প্রশাসনিক ভবন ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পুনর্বাসন জরুরি। ঢাকা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ, যানজটপূর্ণ ও দূষিত শহর। অথচ এই শহরের কেন্দ্রস্থলেই অবস্থিত রয়েছে সেনানিবাস, মন্ত্রণালয়, সুপ্রিম কোর্ট, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মতো বহু দাপ্তরিক ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান, যা বিকল্প স্থানে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব।
এছাড়া, হাজার হাজার অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা—সেনাবাহিনী, পুলিশ, প্রশাসন, বিচার বিভাগসহ—বিশেষ সুবিধাসহ রাজধানীর অভিজাত এলাকায় বসবাস করছেন। তাঁদের জন্য রাজধানীর বাইরে আধুনিক ও সম্মানজনক আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে নাগরিক সুবিধা সবার জন্য উন্মুক্ত হয় এবং রাজধানীর ভারসাম্য রক্ষা পায়।
রাজধানীকে শুধু ‘ক্ষমতার কেন্দ্র’ না রেখে একটি বসবাসযোগ্য মানবিক শহর হিসেবে গড়ে তুলতে হলে, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানচ্যুতি এখন সময়ের দাবি।
২. পরিশ্রমজীবী মানুষ যেন আর বস্তিতে না বাস করেন। যারা বাস চালান, রাস্তায় ঝাড়ু দেন, বিভিন্ন সেবা দেন—তাঁরা যেন সারাজীবন কাজ করেও বস্তিতে বাস করতে বাধ্য না হন। এটি রাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনক। তাঁদের জন্য ন্যূনতম আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা ও অবসরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
৩. দুর্নীতি দমন সংস্থাগুলোকে ঘুষ ও রাজনৈতিক প্রভাবে দূষিত করে রাখা চলবে না। দুর্নীতি দমন কমিশন, আয়কর বিভাগ, ভূমি অফিসসহ সরকারি রাজস্ব ও জবাবদিহির সংস্থাগুলোর ভেতরে ঘুষ ও অবৈধ সমঝোতার চক্র গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীন, কার্যকর ও জনদায়িত্বশীল করতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসবে না।
৪. নৈতিক শিক্ষা দিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ শুরু করতে হবে। বিচার বিভাগ, প্রশাসন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অনৈতিকতা বাড়ছে। এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ কেবল আইন দিয়ে নয়—শুরু করতে হবে শিক্ষালয় থেকে। শিশুদের মধ্যে ন্যায়ের প্রতি বিশ্বাস, আত্মসংযম, দায়িত্ববোধ ও অসততার বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।
৫. যাঁরা সেবা দেন, তাঁরা যেন সম্মান ও নিরাপত্তা পান। অফিসের গাড়িচালক, বাসার সহকারী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী কিংবা কৃষক—যাঁরা নীরবে সেবা দিয়ে যান—তাঁরা যেন অবহেলার শিকার না হন। তাঁদের জন্য পেনশন, চিকিৎসা ও অবসরের সুনির্দিষ্ট নিশ্চয়তা থাকা উচিত। এই অবহেলা মানবিকতাবিরোধী এবং রাষ্ট্রীয় নীতির চরম ব্যর্থতা।
এই শিক্ষার্থী-নেতৃত্বাধীন আন্দোলন একটি মূল্যবোধভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণের ডাক দিয়েছে। এটি কেবল রাজনৈতিক নয়—এটি এক নৈতিক পুনর্জাগরণ। এখন সময় এই তরুণদের কণ্ঠস্বরকে সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করার। সময় এসেছে একটি বৈষম্যহীন, মানবিক ও ন্যায়ের বাংলাদেশ গড়ার।
এই আন্দোলন শুধু পাঁচটি দাবি পূরণের জন্য নয়—এটি রাষ্ট্রকে তার আয়নায় নিজের মুখ দেখানোর আহ্বান। আমরা কীভাবে এতদিন কিছু মানুষকে বিশেষ সুবিধার পাহাড়ে বসিয়ে রেখেছি, আর যারা প্রকৃত সেবা দিচ্ছেন, তাঁদের ঠেলে দিয়েছি অবহেলার প্রান্তে? তরুণরা সেই প্রশ্ন তুলছে, এবং সেই প্রশ্নের উত্তর না দেওয়া মানেই ভবিষ্যতের দায় এড়িয়ে যাওয়া।
এখন আর কেবল সরকারি নীতিমালার কসটিতে চলা চলবে না—চাই নতুন রাষ্ট্রচিন্তা, যেখানে মূল্যায়ন হবে সেবার ভিত্তিতে, সুবিধার নয়। এই আন্দোলনের অন্তরে যে নৈতিক সুর বাজছে, তা কোনো সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি বাংলাদেশের আত্মার গভীর থেকে উঠে আসা এক ধ্বনি—ন্যায়ের, মর্যাদার ও গণতন্ত্রের। যারা আজ রাস্তায় দাঁড়িয়েছে, তারা কেবল বিদ্রোহ করছে না—তারা আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে।
এখন সময় এসেছে কানে শোনা নয়—হৃদয়ে ধারণ করার। এই তরুণ কণ্ঠস্বর যদি অবহেলা করা হয়, তবে রাষ্ট্র শুধু একটি প্রজন্ম নয়—হারাবে নিজের ভবিষ্যৎ, মানচিত্র ও আত্মপরিচয়।
নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে চাই ন্যায়ের ভিত্তিতে মর্যাদা, চাই মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখা।
এই বিপ্লবের আত্মত্যাগ তখনই পূর্ণতা পাবে, যখন রাষ্ট্র নিজেই উচ্চারণ করবে— সবাই গুরুত্বপূর্ণ, কেবল সুবিধাভোগীরা নয়।
রহমান মৃধা
গবেষক, লেখক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
নিজেকে প্রশ্ন করে দেখো না?

ভুলের স্মৃতি, ভালো কাজের আহ্বান, এবং বিবেকের এক নীরব সংলাপ। নিজেকে ফিরে দেখা: ভুলের প্রতিচ্ছবি। আমার জীবনে ভুল ছিল। কিছু ভুল ছিল আবেগে, কিছু সিদ্ধান্তে, কিছু নীরবতায়। কিন্তু আমি কখনোই তাদের অস্বীকার করিনি। কারণ আমি বিশ্বাস করি— ভুলের স্বীকারোক্তিই আত্মশুদ্ধির প্রথম ধাপ।
এই ভুলগুলোকেই আমি আজ স্মরণ করি, যেন অন্যরা আমার পথে হেঁটে সেই একই গর্তে না পড়ে। আমার অভিজ্ঞতা হয়তো কারও জন্য সতর্কবার্তা হতে পারে।
ভালো কাজ: নিজেকে ছাপিয়ে অন্যের জন্য। আমার কিছু কাজ ছিল—যেগুলো শুধু আমার জন্য ছিল না। আমি চেয়েছি, যেন সেই কাজগুলো অন্যের জীবনেও আলো ফেলে। ভালো কাজের সার্থকতা তখনই, যখন তা শুধু নিজের আত্মতৃপ্তি নয়—অন্যের কল্যাণে রূপ নেয়।
আমার কিছু সিদ্ধান্ত হয়তো কাউকে সাহস জুগিয়েছে, কেউ হয়তো আমার লেখায় খুঁজে পেয়েছে নিজের আত্মপ্রত্যয়। এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই আমার জীবনের বড় অর্জন।
বিবেকের সাথে সংলাপ। আমরা কি বিবেকের সাথে কথা বলি? আমরা কি প্রতিদিনের কাজের পেছনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করি—“আমি সঠিকটা করলাম তো?” আমি এই সংলাপ করি—প্রতিদিন না হোক, প্রহরে প্রহরে নিজের ভেতরের সেই নীরব কণ্ঠস্বর শুনি। তাতে আমি সব সময় উত্তম হতে পারি না, কিন্তু আমি সচেতন থাকি।
আমরা যখন “হ্যাঁ” বলি, তখন কি তার পেছনে সাহস থাকে? আমরা যখন “না” বলি, তখন কি বিবেক খুশি থাকে? এই চিন্তা আমাদের নৈতিকতা গড়ে দেয়, মানবিকতা জাগায়।
নিজের জীবনের আলো অন্যের পথ দেখাতে পারে। এই লেখাটি শুধু আত্মজিজ্ঞাসা নয়—এটি একটি ডাকে, যেখানে আমি চাই, আমার জীবনের যাত্রা যদি অন্যকে একটু ভাবায়, একটু আলো দেয়—তবেই তা অর্থপূর্ণ। আমরা সবাই ভুল করি, কিন্তু সবাই যদি সেই ভুল থেকে কিছু শিখি এবং অন্যকে বলি—“এই পথে যেয়ো না”, তখন সমাজ বদলায়।
আমি চাই, আমার অভিজ্ঞতা, আমার শিক্ষা, আমার ছোট ছোট উপলব্ধি। তোমার জন্য বড় কোনো সত্যের চাবিকাঠি হয়ে উঠুক।
এক নিঃশব্দ আহ্বান: নিজেকে জানো, অন্যকে জানতে দাও। এই জীবন এক প্রশিক্ষণ, প্রতিদিন নিজেকে জানার। যেখানে ভুলেরা শুধু কষ্ট নয়, শিক্ষাও দেয়। যেখানে ভালো কাজ কেবল বাহবা পাওয়ার জন্য নয়, অন্যকে জাগিয়ে তোলার জন্য।
তুমি যদি নিজের গল্প বলতে পারো, তাহলে কেউ না কেউ একদিন বলবে “তোমার অভিজ্ঞতা আমাকে বদলে দিয়েছে।”
তাই আজকে বলি— নিজেকে প্রশ্ন করে দেখো না? হয়তো তোমার উত্তরই অন্য কারও জীবনের সবচেয়ে জরুরি আলো হতে পারে।
রহমান মৃধা
গবেষক, লেখক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com
মত দ্বিমত
গণতন্ত্রের সঠিক পথে: সংসদ নয়, স্থানীয় সরকার হোক উন্নয়নের প্রধান বাহক

বাংলাদেশের গণতন্ত্র আজ কঠিন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে আমরা সংবিধানে গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি নিয়ে এগোই, অন্যদিকে বাস্তবে রাজনৈতিক দখলদারিত্ব, পরিবারতন্ত্র, দলীয় চাঁদাবাজি এবং একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসনের বাস্তবতা আমাদের পথরোধ করে। নির্বাচন এখন আর গণরায় নয়—এটি হয়ে উঠেছে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার এক নিষ্ঠুর কৌশল। এই সংকট নিরসনে নির্বাচন পদ্ধতির কাঠামোগত পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি।
বিশ্বের বহু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ব্যবহৃত প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (PR) বা অনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ভিত্তিক পদ্ধতি বাংলাদেশের জন্য এখন একটি সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত বিকল্প। সুইডেনে আমার চার দশকের নাগরিক, গবেষক ও ভোটার অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি—কীভাবে PR ভিত্তিক সংসদীয় গণতন্ত্র একটি সমাজকে ন্যায়, শান্তি ও প্রগতির পথে নিয়ে যেতে পারে।
সুইডেনে কোনো একক দল সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় না, ফলে সরকার গঠনে জোট বাধ্যতামূলক। এতে গড়ে ওঠে রাজনৈতিক সহনশীলতা, আলোচনাভিত্তিক সংস্কৃতি ও পারস্পরিক দায়িত্ববোধ। প্রার্থী মনোনয়নে দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও জনমত প্রাধান্য পায়, ফলে পরিবারতন্ত্র ও আর্থিক দখলদারিত্ব দুর্বল হয়। শিক্ষক, নারী, অভিবাসী, শ্রমজীবী—সকলেই যোগ্যতার ভিত্তিতে সংসদে আসার সুযোগ পান। ঘুষের কোনো দরকার নেই; টিকিট কিনে মনোনয়ন নেওয়ার ব্যবস্থা নেই—যোগ্যতা ও জনসম্পৃক্ততাই এখানে আসল মূলধন।
এখানে সংসদ সদস্যদের কাজ সীমিত—তাঁরা কেবল নীতিনির্ধারণ ও আইন প্রণয়নের দায়িত্ব পালন করেন। বরাদ্দ, চাকরি বা ব্যক্তিগত সুপারিশে হস্তক্ষেপের এখতিয়ার তাঁদের নেই। এর ফলেই গড়ে উঠেছে জনগণের উপর আস্থা এবং নির্বাচনে ৮০-৯০ শতাংশ ভোটার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়।
বাংলাদেশের বাস্তবতা একেবারে উল্টো। এমপি পদটি হয়ে উঠেছে যেন একটি ‘বিনিয়োগের প্রজেক্ট’—যেখানে মনোনয়ন পেতে লাগে কোটি টাকার ঘুষ, যার উৎস দুর্নীতির অর্থও হতে পারে। এই অর্থ খরচ করে নির্বাচিত হওয়ার পর, এমপি-রা পরিণত হন স্থানীয় দানবে—তাঁরা বাজার কমিটি নিয়ন্ত্রণ করেন, সরকারি চাকরির সুপারিশ দেন, বরাদ্দ ভাগ করেন, এমনকি রাস্তার ইটের কন্ট্রাক্টেও হস্তক্ষেপ করেন। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় বিনিয়োগ তোলা—জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন নয়।
ভোটের মূল্যও এখানে নষ্ট। নির্বাচনের আগেই টাকা দিয়ে ভোট কেনা হয়, রাতের আঁধারে প্রশাসনের সহায়তায় ভোট সম্পন্ন হয়, এবং ভোটার জানেন—তাঁর ভোটের কোনো দাম নেই। ফলে গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে জনগণ। এ এক পরস্পরবিনাশী চক্র—জনগণের আশা মর্যাদাহীন হয়ে পড়ে, আর রাজনীতির মঞ্চ হয়ে ওঠে লুটপাটের কেন্দ্র।
এই চক্র ভাঙতে হলে দরকার দুটি কাঠামোগত রূপান্তর—একসাথে ও সমান্তরালভাবে।
প্রথমত, PR পদ্ধতিতে নির্বাচন চালু করতে হবে। এতে দলীয় তালিকায় স্থান পাবে যোগ্য, জনসম্পৃক্ত প্রার্থীরা—not আর্থিকভাবে প্রভাবশালীরা। মনোনয়ন বাণিজ্য লোপ পাবে, কারণ মনোনয়ন নির্ধারিত হবে অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। নির্বাচিত এমপি-রা কেবল আইন প্রণয়নের দায়িত্বে থাকবেন—তাঁরা আর তদবির, বরাদ্দ বণ্টন বা চাকরির সুপারিশে জড়াবেন না।
দ্বিতীয়ত, উন্নয়নের দায়িত্ব দিতে হবে স্থানীয় সরকারকে। বরাদ্দ, প্রকল্প বাস্তবায়ন ও নাগরিক সেবা পরিচালিত হবে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে। স্থানীয় উন্নয়ন হবে জনগণের বাস্তব চাহিদা অনুযায়ী—not কোনো এমপি’র ইচ্ছেমাফিক নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে। প্রশাসন হবে সহযোগী—কিন্তু নিয়ন্ত্রক নয়। এই দুই কাঠামো—PR ভিত্তিক সংসদ নির্বাচন এবং ক্ষমতাবান স্থানীয় সরকার—একসাথে চালু হলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রশাসনিক কাঠামোতে এক নতুন যুগের সূচনা হবে। প্রশাসন হবে সহযোগী—কিন্তু নিয়ন্ত্রক নয়। এবং শুধু এতটুকু যোগ করা জরুরি যে, প্রথমে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত—অথবা সম্ভব হলে, সুইডেনের মতো একই দিনে স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচন একসাথে করা উত্তম হবে। এতে সময়, খরচ এবং প্রশাসনিক জটিলতা কমবে, পাশাপাশি জনগণের অংশগ্রহণও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে। এতে করে জনগণ একসাথে দেশের ও নিজেদের এলাকার ভবিষ্যৎ নির্ধারণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।
উন্নয়ন মানে কেবল রাস্তা-ঘাট নয়; উন্নয়ন মানে মানুষের জীবনে ন্যায়, সেবা, এবং সুযোগের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা। কিন্তু যে সংসদ সদস্য কোটি টাকা খরচ করে নির্বাচিত হন, তিনি জনগণের উন্নয়নের জন্য কাজ করবেন কেন?—তাঁর প্রথম লক্ষ্য থাকে বিনিয়োগ ফেরত আনা। এই মানসিকতা বদলাতে পারে PR পদ্ধতি—যেখানে নেতৃত্ব মানে জনসম্পৃক্ততা, আর ক্ষমতা মানে দায়িত্ব।
এবার প্রশ্ন, PR পদ্ধতি আসলে কী?
প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (PR) বা অনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব হলো একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থা, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের শতকরা অনুপাতে সংসদে আসন পায়। কোনো দল যদি পায় ৩০% ভোট, তবে সে পায় ৩০% আসনও। এতে প্রতিটি ভোটের মূল্য থাকে, ভোট হারায় না।
বর্তমানের First-Past-The-Post (FPTP) পদ্ধতিতে শুধু সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থী জয়ী হন, বাকি সব ভোট ‘অদৃশ্য’ হয়ে যায়। এতে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বহীনতা, আস্থা সংকট এবং বিভাজনমূলক রাজনীতির বিস্তার ঘটে।
PR পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য:
ন্যায়বিচার ও সমঅধিকার নিশ্চিত হয়।
সংলাপ ও সহনশীলতা গড়ে ওঠে।
মনোনয়নে স্বচ্ছতা আসে।
ভোটার আস্থা ও অংশগ্রহণ বাড়ে।
নেতৃত্বে বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় বাস্তবতায় PR চালু করা আবশ্যক। কারণ FPTP পদ্ধতিতে—
বিরোধী কণ্ঠ দমন হয়,
ক্ষমতা পরিবার ও গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয়,
ভোটার আস্থা ক্ষয়ে যায়,
সংসদ হয়ে ওঠে গোষ্ঠীস্বার্থের প্ল্যাটফর্ম।
সুইডেনে PR পদ্ধতির সফল বাস্তবায়ন দেখেছি নিজ চোখে। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় বাধ্যতামূলক সংলাপ হয়। সংসদে আসে শিক্ষক, অভিবাসী, বাসচালকসহ সকল শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব। ভোটার অংশগ্রহণ থাকে ৮৫-৯০%। রাজনৈতিক পরিবেশ ভদ্র, যুক্তিনির্ভর এবং সহানুভূতিশীল।
তবে PR কোনো যাদুর কাঠি নয়। এটি কেবল একটি দরজা, যার ভেতর দিয়ে যেতে হলে প্রয়োজন:
রাজনৈতিক সদিচ্ছা,
জবাবদিহিতাপূর্ণ প্রশাসন,
স্বাধীন ও সাহসী মিডিয়া,
সচেতন নাগরিক সমাজ,
এবং জাতিগত আত্মসমালোচনার সক্ষমতা।
PR শুধুই যান্ত্রিক সংস্কার নয়; এটি একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব। ১৯৪৫ সালে হিরোশিমা ধ্বংস হওয়ার পর জাপান বলেছিল: ‘We shall not repeat the evil.’
আজ আমরা কি দাঁড়িয়ে বলতে পারি: ‘আমরা আর নিজেদের সন্তানদের হাতেই জাতিকে ধ্বংস হতে দেব না’?
আমরা কি গড়তে পারি এমন একটি বাংলাদেশ— যেখানে ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মা নিশ্চিন্তে বলতে পারে:
‘আমাদের রক্ত বৃথা যায়নি’?
যেখানে জুলাই মাস ফিরে আসবে স্বাধীনতার রোদের মতো— ভয়, গুম, দমন আর রক্ত নয়, বরং গণমানুষের গর্ব, মুক্তচিন্তা ও ভালোবাসার প্রতীক হয়ে। যেখানে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর হবে রক্তের নয়—মুক্তির জয়গান।
প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (PR) কেবল একটি ভোট গণনার পদ্ধতি নয়— এটি একটি পরিবর্তনের ঘোষণা, একটি নতুন মানসিকতার অভ্যুত্থান, একটি সাহসিকতার প্রতীক এবং এক মানবিক চেতনার পুনর্জন্ম।
যদি আমরা সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র চাই— যেখানে ক্ষমতা মানে দায়িত্ব, আর নেতৃত্ব মানে জনগণের সেবা, তাহলে PR পদ্ধতিই হবে আমাদের ভবিষ্যতের ভিত্তি।
এই মুহূর্তে প্রশ্ন একটাই— আপনি কি প্রস্তুত নিজের ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনের জন্য?
রহমান মৃধা, গবেষক, লেখক ও সাবেক পরিচালক, ফাইজার সুইডেন। Rahman.Mridha@gmail.com