ক্যাটাগরি: অর্থনীতি

কাগজে চামড়ার দাম বাড়লেও বাজারে বাড়েনি, হতাশ মৌসুমি ব্যবসায়ীরা

এবারের ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করতে না পেরে রাস্তায় ফেলে রাখা বা পুঁতে ফেলার ঘটনা গত বছরের তুলনায় কম হলেও, কাঁচা চামড়ার ন্যায্য দাম না পাওয়ার অভিযোগ এবারও ছিল তীব্র। ছোট মৌসুমি ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, ফড়িয়াদের কাছে জিম্মি হয়ে তারা কম দামে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন।

অন্যদিকে, আড়তদারেরা বলছেন, লবণ মাখানো ছাড়া কাঁচা চামড়ার নির্ধারিত কোনো দাম নেই। অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী না জেনে নিম্নমানের চামড়া কিনেছেন বলেই তারা কাঙ্ক্ষিত দামে বিক্রি করতে পারেননি। তবে আড়তের মালিকদের দাবি, এমন ঘটনা খুব কমই ঘটেছে।

চামড়ার নির্ধারিত ও প্রকৃত বাজার মূল্য:
এ বছর ঢাকায় প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম ৬০-৬৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল, যা গত বছর ছিল ৫৫-৬০ টাকা। ঢাকার বাইরে এই দাম ছিল ৫৫-৬০ টাকা (গত বছর ৫০-৫৫ টাকা)। খাসির লবণযুক্ত চামড়া প্রতি বর্গফুট ২২-২৭ টাকা এবং বকরির চামড়া ২০-২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল।

এছাড়া, ঢাকায় কাঁচা চামড়ার সর্বনিম্ন দাম ১ হাজার ৩৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে সর্বনিম্ন ১ হাজার ১৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। নির্ধারিত দাম অনুযায়ী, ঢাকায় মাঝারি আকারের গরুর ২৫ বর্গফুটের একটি লবণযুক্ত চামড়ার দাম হওয়ার কথা ছিল ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬২৫ টাকা।

তবে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, পুরান ঢাকার পোস্তাসহ বিভিন্ন এলাকার তথ্য অনুসারে, ঈদের দিন লবণ ছাড়া বড় ও মাঝারি গরুর কাঁচা চামড়া বিক্রি হয়েছে ৭০০ থেকে ৯০০ টাকায়। তুলনামূলক ছোট ও কিছুটা খারাপ মানের চামড়ার দাম ছিল মাত্র ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা। ঢাকার বাইরে এই দাম আরও কম ছিল।

মৌসুমি ব্যবসায়ীরা হতাশ:
সরকার নির্ধারিত দাম না পেয়ে খুলনা, যশোর, ঝিনাইদহসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা হতাশ হয়েছেন। ঝিনাইদহের মৌসুমি কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী ফিজার মোল্লা বলেন, “আড়তদারেরা মাত্র ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় চামড়া কিনছেন। নির্দিষ্ট কিছু ব্যবসায়ীর হাতে চামড়ার ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ থাকায় আমরা সিন্ডিকেটের ফাঁদে পড়েছি।”

ফেনীর পরশুরামে কোরবানির গরুর চামড়া নদীতে ফেলার অভিযোগে রোববার রাতে শুক্কুর আলী (৪৩) নামে এক মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়। শুক্কুর আলী জানিয়েছেন, ৬০০ টাকা দিয়ে চামড়া কিনে বিক্রি করতে না পারায় তিনি তা নদীতে ফেলে দিয়েছেন। দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র ৩০০ থেকে ৬০০ টাকায়, আর ছাগলের চামড়া মাত্র ১০ টাকায়। অনেকে ছাগলের চামড়ার দাম না পেয়ে নদীতে ফেলে দিয়েছেন বলেও খবর পাওয়া গেছে।

আড়তদার ও সরকারের বক্তব্য:
ঢাকার পোস্তা এলাকায় কাঁচা চামড়ার আড়তদারদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সভাপতি মঞ্জুরুল হাসান বলেন, “চামড়ার দাম না পাওয়ার মূল কারণ সময়মতো লবণ দিয়ে সংরক্ষণ না করা। এতে অনেক চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে। নষ্ট চামড়ার জন্য আড়তদারেরা ভালো চামড়ার দাম দেবেন কীভাবে?”

ঢাকার আড়তদারদের দাবি, লবণ ছাড়া ভালো মানের এক পিস চামড়া ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকায় কেনেন তাঁরা। লবণযুক্ত হলে কিনবেন ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায়।

মৌসুমি ব্যবসায়ীদের চামড়ার দাম না পাওয়ার বিষয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, “আমরা যে দাম নির্ধারণ করেছিলাম, তা লবণসহ চামড়ার দাম। অভিজ্ঞতাহীন কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী চামড়া নিয়ে আধা পচা করে ফেলছে। আধা পচা চামড়া ৭০০-৮০০ টাকা বিক্রি হলেও তো অনেক বেশি।”

কেনাবেচা ও সংরক্ষণ পরিস্থিতি:
সারা দেশ থেকে ঢাকায় কাঁচা চামড়া পরিবহনে সরকার ১০ দিনের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এই নিষেধাজ্ঞা মেনে গতকাল পর্যন্ত ঢাকার বাইরে থেকে পোস্তার আড়ত কিংবা সাভারের ট্যানারিগুলোতে চামড়া আসেনি। বিএইচএসএমএ সূত্রে জানা যায়, ঈদের দিন থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত চার দিনে ঢাকার পোস্তায় মাত্র ৮০ হাজার পিস চামড়া সংরক্ষণ করা হয়েছে। আড়তদারেরা রাজধানীর ভেতর থেকে কাঁচা চামড়া কিনে নিজেরা লবণ দিয়ে এগুলো সংরক্ষণ করেছেন। সরকার-নির্ধারিত সময় শেষে ১৭ তারিখ থেকে লবণযুক্ত চামড়া কেনা শুরু হবে। আড়তদারদের পাশাপাশি ট্যানারিগুলোও নিজেদের চামড়া কেনা শুরু করবে।

২৫ লাখের বেশি চামড়া সংরক্ষণ:
গত বছর দেশে মোট ১ কোটি ৪ লাখ গরু, ছাগল ও মহিষ কোরবানি হয়েছিল। এ বছর তা কিছুটা কমতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার কোরবানির তথ্য সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে। এবার দুই সিটিতে মাত্র ৬ লাখ ৩২ হাজার ৮৩৪টি কোরবানি হয়েছে, যা গত বছরের অর্ধেক।

তবে, কোরবানির সংখ্যা যা-ই হোক, এবার ট্যানারির মালিকদের ৮০-৯০ লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য রয়েছে। এর বিপরীতে সরকারের দেওয়া লবণ দিয়ে সারা দেশে এখন পর্যন্ত ২৫ লাখের বেশি চামড়া সংরক্ষণের হিসাব পাওয়া গেছে।

তথ্য অনুসারে, চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলার মাদ্রাসা, এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিং কোরবানির ৭ লাখ ৭৪ হাজার গরু, মহিষ ও ছাগলের চামড়া সংগ্রহ করে লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করেছে। খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় ৩ লাখ ২৬ হাজার ৭৯৪ পিস গরু, মহিষ ও ছাগলের চামড়া সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এছাড়া বরিশাল বিভাগে ১ লাখ ৬৭ হাজার, রংপুর বিভাগে ২ লাখ ৮১ হাজার, রাজশাহী বিভাগে ২ লাখ ৮৭ হাজার এবং সিলেট বিভাগে ২ লাখ ৯ হাজার চামড়া সংরক্ষণ করা হয়েছে। সাভারের ট্যানারিপল্লিতে ৩ লাখ ৮৬ হাজার চামড়া সংরক্ষণ করা হয়েছে।

দাম নির্ধারণ বর্গফুটে, বিক্রি পিসে:
চামড়ার দাম বর্গফুটে নির্ধারণ হলেও বিক্রি হয় সাধারণত পিস হিসাবে। মৌসুমি ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে আড়তদার ও ট্যানারির মালিক সবাই পিস হিসাবেই চামড়া কেনেন। এক্ষেত্রে ছোট-বড় চামড়ার দামে কিছুটা পার্থক্য হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পোস্তার একজন আড়ত মালিক জানান, “আমরা দীর্ঘ দিন ধরে ব্যবসা করছি। চামড়া দেখলে অনুমান করতে পারি কত ফুট হবে। সে অনুসারেই দামদর করে চামড়া কিনে থাকি। সাধারণত ২ লাখ টাকা দামের গরুর চামড়া ২৭ থেকে ২৮ বর্গফুট হয়। লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করা হলে তার দাম আসে ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা।”

শেয়ার করুন:-
শেয়ার