নাতির বয়সি উপদেষ্টাদের দিয়ে অভিজ্ঞ সরকার হয় না—এই বক্তব্য ইতিহাসের প্রতি অবমাননা, তরুণদের প্রতি ঘৃণা। সম্প্রতি একজন জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদের মন্তব্য— ‘নাতির বয়সি উপদেষ্টাদের দিয়ে অভিজ্ঞ সরকার হয় না’— সমাজের বিভিন্ন স্তরে এক গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এমন বক্তব্য শুধু তরুণদের নেতৃত্বের যোগ্যতাকে খাটো করে দেখায় না, বরং এটি ইতিহাস, ত্যাগ এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনার মুখে এক নির্লজ্জ চপেটাঘাত।
ইতিহাস কি বলে?
বাংলাদেশের ইতিহাস মূলত তরুণদের হাত ধরেই রচিত হয়েছে। যাঁরা আজ ‘নাতির বয়সি’ বলে তুচ্ছ করছেন, তারাই অতীতে যুগান্তকারী আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি ছিলেন।
•১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন: স্কুল-কলেজের ছাত্ররাই রাজপথে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাদের ‘অভিজ্ঞতা’ ছিল না, ছিল আদর্শ।
•১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ: অসংখ্য তরুণ অস্ত্র হাতে দেশ রক্ষায় লড়েছে। শিশু মুক্তিযোদ্ধারাও জীবন বাজি রেখে রণাঙ্গনে নেমেছিল।
•১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন: তরুণ প্রজন্মের গণজাগরণই স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছে।
তাদের তখন কেউ ‘অভিজ্ঞ’ সার্টিফিকেট দেয়নি। তারা নিজেরাই নিজের সামর্থ্য প্রমাণ করেছেন রক্ত আর ত্যাগ দিয়ে।
একজন শিশু মুক্তিযোদ্ধার আত্মপ্রকাশ
এই বক্তব্যের প্রতিবাদে, আমি নিজেই একজন শিশু মুক্তিযোদ্ধা। কই কেউ তো ১৯৭১-এ আমাকে তখন বলেনি— ‘যুদ্ধে যেয়ো না, স্কুলে যাও!’ আজ ২০২৪-এর নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের জ্ঞান-যোগ্যতা, বিশ্বদর্শন, প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্লেষণ—সবকিছুকে অস্বীকার করে ‘নাতির বয়সি’ বলে উপেক্ষা করা কি সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধাচরণ নয়? এই প্রশ্ন শুধু একটি ব্যক্তিগত ক্ষোভ নয়—এটি একটি ঐতিহাসিক ও নৈতিক দাবি, যা গোটা জাতির পক্ষ থেকে উঠে এসেছে।
বিশ্বপরিপ্রেক্ষিত
বিশ্বজুড়ে তরুণ নেতৃত্ব ইতিহাস বদলে দিয়েছে।
•সানা মারিন (ফিনল্যান্ড) ৩৪ বছর বয়সে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।
•জাস্টিন ট্রুডো (কানাডা) ও ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ (ফ্রান্স) তরুণ বয়সেই নিজেদের যোগ্যতা দিয়ে রাষ্ট্র চালাচ্ছেন।
তাদের কেউ ‘নাতির বয়সি’ ছিল না—তারা ছিল যথার্থ নেতৃত্বের প্রতিচ্ছবি।
দেখেছেন সামাজিক প্রতিক্রিয়ায় তীব্র প্রতিঘাত?
এই বিতর্কিত বক্তব্যের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসংখ্য প্রতিবাদ উঠে এসেছে। কিছু উল্লেখযোগ্য মন্তব্য:
•তরুণদের অবদান অস্বীকার করা মানে ইতিহাসকে অস্বীকার করা।
•বয়স দিয়ে অভিজ্ঞতা মাপা যায় না; নেতৃত্ব আসে চেতনা ও দক্ষতা থেকে।
•এই বক্তব্য তরুণদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার একটি অপচেষ্টা।
এই প্রতিক্রিয়াগুলো স্পষ্ট করে দেয়—জনগণ এমন ধারার অবজ্ঞাপূর্ণ রাজনীতিকে আর গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়।
বিএনপির পতনের ইঙ্গিত?
এমন অপমানজনক বক্তব্যের মাধ্যমে বিএনপি কি নিজেদের রাজনৈতিক পতনের ঘণ্টা বাজাতে শুরু করেছে?
সালাউদ্দিন, রিজভীসহ একদল নেতাকর্মীর অযাচিত ও সময়োচিত অবস্থানহীন কথাবার্তা বিএনপিকে জনবিচ্ছিন্ন করে তুলছে। অন্যদিকে, তারেক রহমান লন্ডনে বসে লংডিস্টান্সে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও নির্দেশনার মাধ্যমে দল পরিচালনার যে অভ্যাস গড়ে তুলেছেন—তা দল নয়, দেশকেই ভয়ংকর এক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কারণ যাদের তিনি ‘সাহসী নেতা’ বলছেন, বাস্তবে তাদের অনেকেই অতীতে সন্ত্রাস ও সহিংসতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। বিশ্বাস না হলে নিরপেক্ষ তদন্ত করুন এবং প্রমাণ পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।
বিএনপির রাজনীতি এখন প্রশ্নবিদ্ধ—নৈতিক, সাংগঠনিক এবং কৌশলগত দিক থেকে। আপনিও কি আমার মত ভাবছেন, নাকি অনেকটা বদলে গেছেন? খুব জানতে ইচ্ছে করে।
বিএনপি কি চায় বাঁচতে? তাহলে গ্রহণ করতে হবে বাস্তবতা
যদি বিএনপি সত্যিই জনগণের আস্থা ফিরে পেতে চায়, তবে কৌশলগত ও আদর্শিকভাবে তাকে মৌলিক পরিবর্তনের পথে হাঁটতেই হবে। তা না হলে এই দল এক সময় শুধু ইতিহাসের বইতেই রয়ে যাবে।
প্রথমত, বিএনপিকে জিয়াউর রহমানের সেই মূল আদর্শে ফিরে যেতে হবে—যেখানে আত্মনির্ভরতা, রাষ্ট্রচিন্তা, জাতীয় স্বার্থ, এবং জনগণের শক্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। দলকে পুনর্গঠনের কেন্দ্রে থাকতে হবে জনগণকেই—উপদেষ্টা, কর্মী বা বংশানুক্রমিক নেতৃত্ব নয়। জনগণ হতে হবে বিএনপির প্রাণকেন্দ্র।
দ্বিতীয়ত, তারেক রহমানকে দীর্ঘকাল প্রবাসে বসে ‘নির্দেশনা দিয়ে রাজনীতি’ বন্ধ করতে হবে। তাকে অনতিবিলম্বে দেশে ফিরতে হবে, মাঠে নামতে হবে, জনগণের চোখে চোখ রেখে তাদের আস্থা অর্জন করতে হবে। শুধুমাত্র বক্তৃতা আর হুমকি নয়, দরকার বিশ্বাসযোগ্যতা ও সাহসের রাজনীতি।
তৃতীয়ত, নতুন প্রজন্মকে একঘরে করে নয়—তাদের হাত ধরেই ভবিষ্যতের জন্য রাজনৈতিক কর্মসূচি সাজাতে হবে। আর এই প্রক্রিয়ায় পুরাতনদের বিদায় অনিবার্য। শুধু বয়স নয়, সময়, পরিস্থিতি এবং যুগবোধ বিবেচনায় তাদের অবদানকে সম্মান জানিয়ে অবসর নিতে হবে। বাস্তবতা হলো—৫৪ বছর ধরে যারা পারেনি, তারা এই বৃদ্ধ বয়সে পারবে—এই ধারণা শুধু অলীকই নয়, আত্মপ্রবঞ্চনাও।
বারোটা বাজে একবার—তাদের জন্য তা বাজছে দীর্ঘকাল। এখন সময়, সেই শব্দ শুনে স্থান ছেড়ে দেওয়ার।
সবশেষে বলতে চাই, বিএনপির সমস্যার সমাধানই কিন্তু দেশের সর্বাঙ্গীন সমাধান নয় বরং বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল এবং বহুপ্রতিষ্ঠিত সমস্যা দ্বারা বিপর্যস্ত। দুর্নীতি, মতপ্রকাশের সংকট, প্রশাসনিক অবনতি, বিচারহীনতা, রাজনৈতিক সন্ত্রাস এবং নেতৃত্বহীনতা দেশের সর্বাঙ্গীন উন্নয়নের পথে গুরুতর বাধা সৃষ্টি করছে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে থাকা দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারে সাধারণ জনগণের বিশ্বাস হ্রাস পাচ্ছে, যা গণতন্ত্র ও শাসন ব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত হুমকিস্বরূপ।
তবে এই সংকট থেকে উত্তরণের পথও রয়েছে। প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক সংকল্প, স্বচ্ছ প্রশাসনিক সংস্কার, দুর্নীতি দমনে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। নতুন ও যোগ্য নেতৃত্বের বিকাশ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের স্বাধীনতা দেশের উন্নয়নকে সঠিক পথে এগিয়ে নিতে পারে।
বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের এই প্রতিবেদন এক সুস্পষ্ট আহ্বান—সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রকৃত সংস্কার ছাড়া দেশের প্রগতি সম্ভব নয়। এটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতাদের দায়িত্ব নয়, বরং প্রতিটি নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য। এই প্রতিবেদন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশপ্রেমিক এবং সচেতন নাগরিকেরা সম্মিলিত উদ্যোগে পরিবর্তনের বাণী ছড়িয়ে দেবেন, তবেই বাংলাদেশকে একটি মুক্ত, সমৃদ্ধ এবং স্বচ্ছ দেশ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন