সম্প্রতি বড় অংকের মূলধন ঘাটতির কারণে নিজেদের অ্যাকাউন্ট ফাইনাল করতে পারছে না ১৯টি ব্যাংক। ফলে বড় ধরণের বেকায়দায় পড়েছে ব্যাংকগুলো। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর তারল্য সংকটে পড়ে এসব ব্যাংক। গ্রাহকদের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণের অবস্থাও ছিলনা কোন কোন ব্যাংকের। নানা রকম গুজবের কারণে কোন কোন ব্যাংকে গ্রাহকরা নিজেদের জমানো টাকা তুলতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ফলে এ সংকট আরো তীব্র আকার ধারণ করে। কেন্দ্রীয় ব্যংক তারল্য সুবিধা দিয়ে এসব ব্যাংককে সহযোগিতা দিলেও মূলধন ঘাটতির সমস্যা সমাধান হয়নি।
পালাতক আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও দুর্ণীতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে সীমা লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত বিনিয়োগ গ্রহণ, বেনামী বিনিয়োগ ও কোন ডকুমেন্ট বিহীন অর্থ লুটের কারণেই সৃষ্টি হয় এমন বিপর্যয়কর অবস্থা। এ লেখায় ব্যাংক খাতের সমস্যার কারণ ও তা প্রতিকারের কিছু উপায় আলোচনা করব।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ব্যংক খাত ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। আশির দশকে বেশ কিছু বেসরকারি ব্যাংক গড়ে ওঠায় ব্যাংক খাত উন্নত হতে থকে। গড়ে উঠতে থাকে ছোট-বড় নানান শিল্প কারখানা। বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে থাকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পথে।
২০০৮ সালের পর দেশের অর্থনীতির উপর শ্যেন দৃষ্টি পড়ে অর্থলোলুপ গোষ্ঠীর। পতিত স্বৈরাচারের মদদপুষ্ট একটি শ্রেণী অর্থনীতি ধ্বংসের নীলনকশা আঁকতে থাকে। তারা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দখল করে একের পর এক ব্যাংক। দখল করে নেয় বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ও সুশৃঙ্খল ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ইসলামী ব্যাংকসহ বেশ কটি ব্যাংক। তাদের ব্যাংক পরিচালনার যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতার বিষয় বিবেচনা করা হয় না। রাতারাতি ব্যাংকের মালিক বনে গিয়ে তারা আকর্ষণীয় মুনাফার প্রলোভন দিয়ে ব্যাংকে আমানত রাখতে সাধারণ মানুষকে প্রলুব্ধ করে। এক পর্যায়ে জনগণের জমানো অর্থ নিয়ম ভঙ্গ করে তারা নামে-বেনামে ঋণ গ্রহণ করতে শুরু করে।
আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়। পরিচালকরা পরস্পরকে সহযোগিতা করে অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ পাইয়ে দিতে। এভাবে ব্যাংক খাত থেকে নিয়ম বহির্ভুতভাবে তারা বের করে নেয় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। (২৭ আগস্ট ২০২৪, দ্যা ডেইলি স্টার)। এসব পরিচালকদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক আশির্বাদপুষ্ট। ব্যবসায়িক হিসাব, আর্থিক পরিস্থিতি ও ব্যাংকিং নীতি বিবেচনায় নিলে এই ব্যবসায়িক গ্রুপগুলোর বেশিরভাগই ঋণ পাওয়ার যোগ্য ছিল না। তাই তারা একে অপরকে ঋণ দেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো ব্যাংকের পরিচালক তার নিজ ব্যাংক থেকে নির্দিষ্ট অংকের বেশি ঋণ নিতে পারেন না। এই নিয়ম ফাঁকি দিতেই তারা নিজের ব্যাংক থেকে অপরকে ঋণ দেওয়ার ধূর্ত পদ্ধতি বেছে নেন।
এছাড়া বিভিন্ন নামে বেনামে কোম্পানী খুলে ভুয়া ঋণ গ্রহণ করেছে অনেক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী এবং ব্যাংক পরিচালক। তারা গড়ে তুলেছে অদৃশ্য মাফিয়া চক্র। বিভিন্ন প্রলোভন ও টোপ দিয়ে ব্যাংকের অসাধু কিছু কর্মকর্তাকে হাত করে তারা ব্যাংক থেকে বের করে নিয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। যেসব ব্যাংকার তাদের অনিয়মের বিরোধিতা করেছে তাদেরকে ব্যাংক থেকে বিতাড়ন, পুলিশি হয়রানিসহ নানানভাবে হয়রানি করা হয়েছে। এসব লুটেরা গোষ্ঠী ব্যাংক খাত থেকে বের করে নিয়েছে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহযোগিতায় এসব ঘটনা ঘটেছে। (যুগান্তর ১৩ আগস্ট ২০২৪)
এর বাইরে খেলাপী ঋণ ব্যাংক খাতের গলার কাটা। পরিচালকদের এই বড় ধরণের অনিয়মের পাশাপাশি ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩.৪৫ লাখ কোটি টাকা যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ২০.২০ শতাংশ (বাংলাট্রিবিউনডটকম ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)।
ব্যাংক খাত থেকে বের করে নেয়া এসব ঋণ ও খেলাপী ঋণের বেশিরভাগই পাচার হয়েছে দেশের বাইরে। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত স্বৈরাচার আওয়ামীলীগ সরকারের নেতা ও তাদের দোসর ব্যবসায়ীরা ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। (প্রথম আলো ২ ডিসেম্বর ২০২৪)। অর্থাৎ বছরে গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। ব্যাংক থেকে পুনঃপুন অর্থ লোপাটের এসব খবরে গ্রাহকদের মনে দানা বেঁধেছে ভয় এবং হতাশা। ফলে তারা ব্যাংকে জমানো টাকা নিজেদের হাতে সংরক্ষণ করছেন। একদিকে অর্থ পাচার ও খেলাপী ঋণ অন্যদিকে আতঙ্কিত গ্রাহকদের টাকা উত্তোলনের ফলে ব্যাংক খাতে দেখা দিয়েছে বড় ধরনের তারল্য সংকট।
পাঁচ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর আশা দেখতে পায় ব্যাংক খাত। আর্থিক খাতে সংস্কারের অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে একজন দক্ষ অর্থনীতিবিদকে গভর্নরের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কাজ করছেন। প্রতিটি বেদখল হওয়া ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে দেয়া হয়। গঠন করা হয় অন্তর্বর্তীকালীন নতুন পর্ষদ। এসব পর্ষদ কাজ করছে খাদের কিনারা থেকে ব্যাংকগুলোকে উদ্ধারের জন্য। ১৫ বছরের অপশাসন ও লুটপাটে ধ্বংসের দারপ্রান্তে ব্যাংক খাত। এ অবস্থা থেকে ব্যাংক খাতকে ফিরিয়ে আনতে এই দশটি উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে।
প্রথমত: ব্যাংকগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও অনুকূল কর্মপরিবেশ ফিরিয়ে আনতে অসাধু, অযোগ্য ও জাল সনদে চাকরি প্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারি অপসারণ করে সৎ, দক্ষ ও পেশাদার ব্যাংকারদের পদায়ন করলে গ্রাহকবান্ধব ব্যাংকিং সেবা প্রদান সহজ হবে।
দ্বিতীয়ত: যারা নামে বেনামে ব্যাংক থেকে অর্থ বের করে বিদেশে পাচার করেছে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশাসক বসিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত আয় থেকে ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
তৃতীয়ত: রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যারা অস্ত্রের মুখে ব্যাংক দখল করেছিল সেসব দখলদারদের সকল শেয়ার এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পদ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় বিক্রি করার ব্যবস্থা করতে হবে। বিক্রয়লব্ধ অর্থ থেকে ব্যাংকের টাকা পরিশেধের ব্যবস্থা করতে হবে এবং প্রকৃত মালিকদের হাতে ব্যাংকগুলো ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
চতুর্থত: যেসব পরিচালক নিয়ম ভেঙে নিজ ব্যাংক এবং অন্য ব্যাংক থেকে নামে বেনামে বিনিয়োগ নিয়ে খেলাপী হয়েছেন তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে এবং তারা যে টাকা ব্যাংক থেকে নিয়েছে তা ফেরত আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
পঞ্চমত: ব্যাংকগুলোতে ঋণ খেলাপীদের তালিকা তৈরি করে তা প্রকাশ করা এবং ইচ্ছাকৃত খেলাপীদের আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
ষষ্ঠত: যেসব ব্যাংকের টাকা অন্য ব্যাংকে আমানত (প্লেসমেন্ট) হিসেবে রাখা আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় পাওনাদার ব্যাংককে এসব টাকা ফেরত দেয়ার দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
সপ্তমত: দুর্নীতিবাজ এবং লুটেরাদের দোসর ব্যাংক কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
অষ্টম পদক্ষেপ হিসেবে ব্যংকগুলো থেকে কি পরিমাণ অর্থ লুট হয়েছে তার সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ করা এবং যারা এসব কাজে জাড়িত তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
নবম পদক্ষেপ হিসেবে লুটেরাদের নিষ্পেষণে যেসব ব্যাংক তারল্য সংকটে ভুগছে, ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সেই ব্যাংকগুলোকে পর্যাপ্ত তারল্য সরবরাহ করতে হবে। এবং দশম পদক্ষেপ হিসেব ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির অর্থ যেমন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় লুট হয়েছে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ব্যাংকের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ সুবিধা প্রদান করতে হবে যেন লুটেরাদের নিয়ে যাওয়া ভুয়া বিনিয়োগের বিপরীতে ব্যাংকের কোন প্রভিশন সংরক্ষণ করা না লাগে।
আগামীতে যেন কেউ এভাবে ব্যাংক দখল করতে না পারে সেজন্য ব্যাংকবান্ধব আইন প্রণয়ন করতে হবে। এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন সম্ভব হলে দেশের ব্যাংক খাত ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি নতুন উচ্চতায় উন্নীত হবে বলে আশা করা যায়।
লেখক: রিয়াজ উদ্দিন, ব্যাংকার। riyazenglish@gmail.com