চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে আজ যারা উচ্চস্বরে চিৎকার করছেন, তারা আসলে বন্দরের পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন না—তারা নিজেদের হারানো লুটপাটের রাজত্ব ফিরে পেতে হাহাকার করছেন। ‘বিদেশীদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে’—এই বাক্যটি শুধু একটা ঢাল, যেটার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভয়ানক বাস্তবতা: দীর্ঘদিন ধরে কিছু ব্যবসায়ী-রাজনৈতিক গোষ্ঠী এই বন্দরকে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পদ বানিয়ে রেখেছিল। আজ যখন সেই সিন্ডিকেটের চাকা থেমে যাচ্ছে, তখনই উঠছে এই কৃত্রিম শোরগোল।
তারা কি একবারও বলছে—এই বিদেশি প্রতিষ্ঠান কত বছরের জন্য আসছে? কী শর্তে? কত বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে? বাংলাদেশের লাভ কী? না, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর তাদের মুখে নেই। কারণ সত্য প্রকাশ পেলে তাদের মুখোশ খুলে যাবে।
চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃদস্পন্দন। এটি কোনো দলের নয়, কোনো গোষ্ঠীর নয়—এটি আমাদের সকলের। অথচ বহু বছর ধরে এই বন্দরে চলছে চরম অনিয়ম, ঘুষ, চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেটবাজি। রাষ্ট্রীয় সম্পদকে ব্যক্তিগত মুনাফার যন্ত্রে পরিণত করে তোলা হয়েছে। যারা এই অব্যবস্থার অংশ, তারাই আজ জাতীয় স্বার্থের কথা বলে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াতে চায়।
বিদেশি প্রতিষ্ঠান এলেই কি দেশের স্বার্থ বিকিয়ে যায়? না। বরং প্রশ্ন হওয়া উচিত—কারা দক্ষ? কারা সময়মতো কাজ শেষ করতে পারে? কারা স্বচ্ছভাবে সেবা দিতে পারে? বিশ্বজুড়ে সিঙ্গাপুর, দুবাই, ডেনমার্ক—এসব দেশের বন্দরগুলোতে বিদেশি অপারেটররা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। তারা কি তাদের স্বকীয়তা হারিয়েছে? বরং তাদের বন্দর ব্যবস্থাপনা আরও আধুনিক, আরও কার্যকর হয়েছে।
বাংলাদেশে এত ভয় কেন? ভয়টা সেই গোষ্ঠীর, যারা এতদিন এই বন্দরকে ব্যক্তিগত খনি বানিয়ে রেখেছিল। যারা দুর্নীতি করে ঋণ নেয়, ফেরত দেয় না, অথচ বিদেশে বিলাসবহুল জীবনযাপন করে। যারা শ্রমিকদের ব্যবহার করে অপারেটরদের জিম্মি করে ফেলে, এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নিজেদের অপরাধ আড়াল করে।
দেশপ্রেম মানে দুর্বলতা আঁকড়ে ধরা নয়। দেশপ্রেম মানে, দেশের স্বার্থে দক্ষতা ও স্বচ্ছতা গ্রহণ করা। যদি দেশের প্রতিষ্ঠান দক্ষ ও সৎ হয়, তাহলে তারাই কাজ করুক। কিন্তু যদি তারা দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়, তাহলে আমাদের সাহসিকতা দেখাতে হবে—সেই কাঠামো ভেঙে নতুন কিছু গ্রহণ করতে হবে, তা বিদেশি হলেও।
এই মুহূর্তে দরকার এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। আমরা চাই চট্টগ্রাম বন্দর হোক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি। এটা যেন আর কোনো রাজনৈতিক দল, চাঁদাবাজ নেতা বা কর্পোরেট মাফিয়ার দখলে না থাকে। দরকার সুশাসন, প্রযুক্তি, দক্ষতা—জাতীয়তাবাদ নয়, বাস্তবতাবাদ। এ লড়াই উন্নয়নের পক্ষে। এ লড়াই দুর্নীতির বিরুদ্ধে। এ লড়াই ভবিষ্যতের বাংলাদেশের জন্য।
এই দুর্নীতিগ্রস্ত গোষ্ঠীকে প্রতিহত করতে হলে সচেতন জনগণের জাগরণ দরকার। শুধু ফেসবুকে নয়, বাস্তবে। অফিসে, গণমাধ্যমে, সমাজে—সবখানে প্রশ্ন তুলতে হবে, কারা দেশের পক্ষে, আর কারা দেশের ক্ষতির জন্য কাজ করছে।
বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা আমার মতো দেড় কোটি প্রবাসী ভাই-বোনেরা—আপনারাই হচ্ছেন এই জাতির নীরব কান্ডারি। আপনাদের পাঠানো রেমিট্যান্সে দেশ চলে, ঘরে ঘরে আলো জ্বলে। তাই আপনাদের দায়িত্বও ছোট নয়। আপনাদের জানতেই হবে—কারা এই দেশের উন্নয়ন চায়, আর কারা শুধু লুটে খেতে চায়। নিজের পরিবার, সমাজ, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আজ আপনাদের চোখ খুলে তাকাতে হবে।
এই ভয়ংকর বাস্তবতার মাঝেও আমরা আশার আলো খুঁজি। আমরা সেই একজনকে খুঁজি—যিনি নিজের স্বার্থে নয়, অন্যের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করতে চান। ড. মুহাম্মদ ইউনূস আমাদের সামনে সেই নাম। হয়তো তাঁর জীবনেও প্রশ্ন আছে, বিতর্ক আছে, কিন্তু আজ যদি তিনি আরেকবার দেশের জন্য কিছু করতে চান, তাহলে তাকে বাধা না দিয়ে, সুযোগ দেওয়া দরকার। কারণ যদি তিনিও ব্যর্থ হন, তাহলে বুঝে নিতে হবে—আমরাই জাতি হিসেবে সব পথ বন্ধ করে দিয়েছি।
আর যদি তাকে প্রতিহত করা হয়, আরেকটি স্বচ্ছ প্রয়াসও যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। তখন আমরা পরিণত হব এক ব্যর্থ জাতিতে—যারা নিজের সম্ভাবনা নিজের হাতেই ধ্বংস করে দিয়েছে। তখন আমরা পরিচিত হব “পৃথিবীর আবর্জনা” হিসেবে, আর সেই লজ্জার দায় থাকবে আমাদের দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক দলগুলোর কাঁধে।
তবে সেই দিন যেন না আসে। আসুক এক নতুন ভোর—যেখানে উন্নয়ন হবে সবার জন্য, কিছু গোষ্ঠীর জন্য নয়। যেখানে নেতৃত্বের মানদণ্ড হবে সততা ও দক্ষতা। যেখানে প্রবাসীদের পাঠানো কষ্টের টাকা সঠিকভাবে বিনিয়োগ হবে।
এই বিশ্বাস, এই সাহস, এই অঙ্গীকার নিয়েই আমরা এগিয়ে যাব। বাংলাদেশ বাঁচুক। মানুষ জাগুক।দুর্নীতির ছোবল থামুক। গর্জে উঠুক এই প্রজন্ম—নতুন বাংলাদেশের নির্মাতা হয়ে।
রহমান মৃধা, গবেষক এবং লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।