বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ধারণা এসেছিল একটি নিরপেক্ষ, অস্থায়ী এবং দায়িত্বশীল প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে, যার একমাত্র লক্ষ্য একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা। কিন্তু নয় মাস পেরিয়ে গেলেও এই সরকার শুধু তাদের মূল দায়িত্বই পালন করতে পারেনি, বরং নতুন নতুন দায়িত্বের বুলি আওড়াতে গিয়ে নিজের সীমারেখা ও বিশ্বাসযোগ্যতা—উভয়ই হারিয়েছে। এমনকি দেশের একজন উপদেষ্টা নির্লজ্জভাবে বলেন, “শুধু নির্বাচন নয়, আমাদের আরও দায়িত্ব রয়েছে—সংস্কার ও বিচারব্যবস্থা।” এই বক্তব্য কেবল হতবাক করে না, আমাদের রাজনৈতিক চেতনার ওপরই আঘাত হানে।
ভবিষ্যতের নামে বর্তমানের ভণ্ডামি
একটি দরিদ্র, জনবহুল, দুর্বল অবকাঠামোর দেশে যেখানে মানুষ নুন আনতে চুন ফুরায়, সেখানে কি করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এতটা নির্লজ্জ ও বেহায়াভাবে অতিরিক্ত ক্ষমতার দাবি করে? এটি কি গণতন্ত্রের প্রতিস্থাপন না এক নতুন প্রকারের আধা-স্বৈরতন্ত্র?
এই প্রশ্ন এখন কেবল একজন চিন্তাশীল নাগরিকের নয়—এটি একটি জাতির প্রশ্ন, যে জাতি তার ভবিষ্যতের জন্য আজ দিশেহারা।
দায়িত্বের সীমারেখা না জানার বিপদ
যে সরকার গঠিত হয়েছিল নির্বাচন আয়োজনের জন্য, তারা যখন ‘সংস্কার’ এবং ‘বিচার বিভাগের হাল ধরার’ কথা বলে, তখন স্পষ্ট হয় তারা নিজেরাই সংবিধান, প্রশাসনিক কাঠামো এবং নিজেদের সীমাবদ্ধতা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা না নির্বাচনের প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে পেরেছে, না সংস্কার বা বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা রক্ষা করতে পেরেছে। একদিকে কথার ফুলঝুরি, অন্যদিকে কাজের শূন্যতা—এই হচ্ছে বর্তমান বাস্তবতা।
ভবিষ্যতের নামে লুটপাটের মহোৎসব
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নামে এখন চলছে নানা পক্ষের লুটপাট ও রাজনৈতিক ভাগাভাগির উৎসব। একেকজন উপদেষ্টা, আমলা, প্রভাবশালী ব্যক্তি অর্থ ও ক্ষমতার দম্ভে বুঁদ হয়ে আছেন। যাকে যেভাবে খুশি ব্যাখ্যা করে, যেটা ইচ্ছে সেটা বলে—কিন্তু দেশের দুঃখজনক বাস্তবতা তাদের মনেও পড়ে না।
এই অবস্থা চলতে থাকলে, কেবল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নয়—পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রই ধ্বংসের পথে যাবে।
সচেতন জাতি অজুহাত নয়, চায় সমাধান
নয় মাসের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেসব দায়িত্ব পালন করতে চেয়েছিল তা শতভাগ অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। এখন নানা অজুহাত উঠে আসছে—প্রশাসনিক জটিলতা, নিরাপত্তা পরিস্থিতি, রাজনৈতিক পরিবেশ ইত্যাদি। কিন্তু সচেতন জাতি অজুহাতে বিশ্বাস করে না, তারা চায় সুস্পষ্ট পরিকল্পনা, সময়সীমা ও কার্যকর ফলাফল। এখন প্রশ্ন—কবে নাগাদ এই অচলাবস্থা ভাঙবে? কবে নাগাদ রাষ্ট্রের সকল অবকাঠামো উন্নয়নের পথে হাঁটবে?
নতুন সূর্য চাই—জেগে উঠুক নতুন নেতৃত্ব
আমরা যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি, সেখানে কেবল ব্যর্থতার গ্লানি। এখন প্রয়োজন এমন এক নতুন নেতৃত্ব, যারা গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতা নয়—গণমানুষের অধিকার ফিরিয়ে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
সাংবিধানিক শুদ্ধতা, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা, আদালতের স্বাধীনতা এবং একটি দুর্নীতিমুক্ত ও প্রযুক্তিনির্ভর রাষ্ট্রব্যবস্থা। এই নতুন সূর্য আমরা চাই মেঘের আড়াল থেকে নয়, বরং স্পষ্ট আকাশে উদিত হোক—যাতে জনগণ দেখতে পায় তাদের আশা এখনও মৃত নয়।
উপসংহার: পতাকা ও নেতৃত্ব ফেরত চাই জনগণের হাতে।
আমি এই মুহূর্তে জনগণের হাতে বাংলাদেশের পতাকা ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব তুলে দিতে প্রস্তুত। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যর্থ হয়েছে—তাদের কথায়, কাজে এবং অবস্থানে।
তাই গুড বাই অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন সূর্য উঠার আগেই আমরা চাই একটি নতুন নেতৃত্বের জাগরণ—যেখানে রাষ্ট্র মানে হবে জনগণ, ক্ষমতা মানে হবে জবাবদিহি, এবং শাসন মানে হবে সেবা।
রহমান মৃধা
গবেষক এবং লেখক
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com