দেশের ব্যাংক হিসাবের শূন্য দশমিক ১ শতাংশ হিসাবধারীর কাছে ব্যাংকের মোট আমানতের প্রায় ৪২ শতাংশ অর্থ জমা রয়েছে। এ ধরনের ব্যাংক হিসাবে ১ কোটি টাকা বা তার বেশি অর্থ জমা রয়েছে। ২০১৯ সালে এসব ব্যাংক হিসাবে জমা ছিল ব্যাংকের মোট আমানতের ৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ অর্থ। দেশের ১১ হাজার ৩০০টির বেশি ব্যাংক শাখার তথ্য সংগ্রহ করে এই চিত্র পেয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট বা পিআরআই।
গবেষণায় পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পিআরআই বলছে, দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে গ্রাহকের যে ঋণ হিসাব রয়েছে, তার মধ্যে ১ দশমিক ২ শতাংশ হিসাবের বিপরীতে কোটি টাকা বা তার বেশি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এই অল্পসংখ্যক হিসাবেই বিতরণ করা হয়েছে মোট ব্যাংকঋণের ৭৫ শতাংশের বেশি অর্থ। পিআরআইয়ের গবেষণায় পাওয়া তথ্যে বলা হচ্ছে, গত পাঁচ বছরে দেশের ১২৬টি উপজেলায় ঋণ হিসাব কমেছে। এর বিপরীতে ৬০টি উপজেলায় ঋণ হিসাব ১০০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। দেশের মোট ব্যাংকঋণের প্রায় ৬৩ শতাংশই বিতরণ করা হয়েছে ঢাকায়। আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রায় সাড়ে ১৫ শতাংশ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে চট্টগ্রাম জেলায়। সেই হিসাবে দেশের ব্যাংকঋণের ৭৮ শতাংশই ঢাকা ও চট্টগ্রামে কেন্দ্রীভূত। পিআরআই বলছে, এ তথ্য ভৌগোলিকভাবে আর্থিক বৈষম্যের ইঙ্গিত দেয়।
ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১১ হাজার শাখা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সংস্থাটি একটি গবেষণাপত্রও তৈরি করেছে। ১৯৭১ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে এই গবেষণাপত্রটি তৈরি করা হয়। গতকাল বুধবার গুলশানের লেকশোর হোটেলে ‘বাংলাদেশে আর্থিক খাতের উন্নয়নের গতিধারা’ শীর্ষক সেমিনারে এই গবেষণায় পাওয়া তথ্য তুলে ধরা হয়। সেমিনারটি যৌথভাবে আয়োজন করে পিআরআই, বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইন্টারন্যাশনাল গ্রোথ সেন্টার (আইজিসি)।
পিআরআইয়ের চেয়ারম্যান জায়দি সাত্তারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির প্রধান অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। বিশেষ অতিথি ছিলেন ডেপুটি গভর্নর মো. হাবিবুর রহমান।
গবেষণায় পাওয়া বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরে সেমিনারে আশিকুর রহমান বলেন, গবেষণার তথ্য ইঙ্গিত দেয়, বাংলাদেশের সম্পদ ব্যাপকভাবে পুঞ্জীভূত হয়ে আছে। দেশের খুব অল্পসংখ্যক মানুষের হাতে সম্পদের বড় অংশ পুঞ্জীভূত হয়ে আছে।
এদিকে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংক খাতে সারা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমানত জমা রয়েছে ঢাকা জেলায়, যা ব্যাংকের মোট আমানতের ৫১ দশমিক ৭৯ শতাংশ। আমানতের দিক থেকে এর পরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা ও নারায়ণগঞ্জ। ঢাকায় মাথাপিছু আমানতের পরিমাণ ৬ লাখ ১৩ হাজার টাকা। এরপর ২ লাখ ৬০ হাজার মাথাপিছু আমানত রয়েছে চট্টগ্রামে। আমানতের দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে থাকা সিলেট জেলায় মাথাপিছু আমানতের পরিমাণ ১ লাখ ৮ হাজার টাকা। গবেষণায় আরও বলা হয়, ৬০টির বেশি জেলায় মাথাপিছু আমানতের পরিমাণ ১ লাখ টাকার নিচে রয়েছে। তবে গত পাঁচ বছরে ৪৭টির বেশি জেলায় আমানতের পরিমাণ ৬০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমানত বেড়েছে শরীয়তপুর ও জামালপুরে। পাঁচ বছরের ব্যবধানে এই দুই জেলায় আমানত বেড়েছে ৯০ শতাংশ।
গবেষণায় পাওয়া তথ্যে আরও বলা হয়, ১৯৭১ সালে দেশে মোট ব্যাংক শাখা ছিল ১ হাজার ১৯৬টি। ২০২৪ সালে সেই সংখ্যা ১০ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৩৬১টিতে। ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ব্যাংকের মোট ঋণের মধ্যে শিল্প খাতে বিতরণ করা হয়েছে ৪০ থেকে ৪২ শতাংশ। একই সময়ে কৃষি খাতে দেওয়া ঋণের হার ছিল ৪ থেকে ৫ শতাংশ।
সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে পুরোপুরি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। আমরা হয়তো ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারের কাছে আংশিকভাবে পুনর্গঠিত একটি অর্থনীতি দিয়ে যেতে পারব। তবে ভবিষ্যতে যে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসবে, তারা এই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া চলমান রাখবে, এটিই আমাদের প্রত্যাশা। তবে যত দিন রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হবে না, তত দিন অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণও হবে না। অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণের এই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর।’
গভর্নর আরও বলেন, এখন প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে রিজার্ভ পুনর্গঠন করা। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ২৭ বিলিয়ন ডলার। এটি শিগগিরই ৩০ বিলিয়ন ডলারের দিকে যাবে।
সেমিনারে আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান বলেন, দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকট। আর্থিক ব্যবস্থা মূলত ধনী শ্রেণির পক্ষে কাজ করছে—এটা আগে ধারণা থাকলেও এখন গবেষণার মাধ্যমে তা প্রমাণিত।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংক খাতে যে রাজনৈতিক বোঝাপড়া এবং আর্থিক খাত কেন ঢাকা ও চট্টগ্রামনির্ভর হয়ে আছে, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করা জরুরি।
সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আনিস উর রহমান।