ক্যাটাগরি: মত দ্বিমত

চেহারায় মানুষ, চেতনায় অমানুষ: আমরা কি হারিয়ে যাচ্ছি?

বর্তমানে আমরা মানুষ হয়ে অমানুষের পরিচয় দিচ্ছি। আরও বিস্ময়কর হলো, পশুপাখিদের আচরণকে যখন তুলনামূলকভাবে শ্রেষ্ঠ বলে দেখানো হয়, আমরা তাতেও দ্বিধা করি না। কেন এমন হচ্ছে?

আমরা বলতে সাহস পাই না যে আমরা অমানবিক, নিষ্ঠুর ও আত্মমগ্ন হয়ে উঠেছি। আমরা স্বীকার করতে চাই না যে আমাদের পথচলা বিবেকবর্জিত, যুক্তিহীন, অথচ আমরা দিব্যি সমাজে মাথা তুলে চলছি। এমনকি আজকাল এমন কাজ, যা মানুষের করা উচিত, সেটাও পশুপাখিরা তাদের সহজাত প্রবৃত্তি দিয়ে করে দেখিয়ে দিচ্ছে। তারা প্রযুক্তি ছাড়াও নৈতিকতা, সহানুভূতি আর শৃঙ্খলার পরিচয় দিচ্ছে, অথচ আমরা—শিক্ষিত, আধুনিক মানুষ—সেই গুণগুলোর চর্চা করছি না।

যেমন ধরা যাক, যুগ যুগ ধরে আমরা ধর্ম, নীতি, মানবিকতার কথা বলে এসেছি, কিন্তু এসবের আসল অনুশীলন কোথায়? আমরা জ্ঞানার্জন করছি, উচ্চশিক্ষিত হচ্ছি, সমাজে নাম কুঁড়াচ্ছি, অথচ মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলছি। অমানুষের মতো আচরণ করে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত—এবং তার পরেও নিজেদের মানুষ বলে দাবি করছি।

এখন যদি এমন কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটে—যেমন, আমরা যেহেতু পশুর মতো আচরণ করছি, হঠাৎ আমাদের চেহারাও যদি পশুর মতো হয়ে যায়? তাহলে কী হবে? কী প্রতিক্রিয়া হবে আমাদের সমাজের? তখন কীভাবে আমরা নিজেদের মানুষ বলে পরিচয় দিতে পারব?

এই ভাবনা হঠাৎ আমার মধ্যে জন্ম নিয়েছে। জানেন কেন? আমি প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটাই। আমি মানুষের থেকে অনেকটাই আলাদা হয়ে, সুইডেনের মাঠে কৃষিকাজ করি, খোলা আকাশের নিচে হাঁটাহাঁটি করি, পরিবেশবান্ধব কাজ করি। আর এই জীবনের মধ্যেই আমি মানুষের বদলে যাওয়া দেখে ফেলি—মানুষ কীভাবে তার প্রাকৃতিক ক্ষমতা হারাচ্ছে, কীভাবে সে নিজের মূল সত্তাকে ভুলে যাচ্ছে।

এই ‘দেখা’ আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি উপলব্ধি করছি, মানুষ শুধু নিজের জন্য তৈরি হয়নি। মানুষের সৃষ্টি একটি উদ্দেশ্যমূলক ঘটনা—তার মধ্যে জ্ঞান, দায়িত্ব, নৈতিকতা ও ভালোবাসা ঢেলে দেওয়া হয়েছে। আমাদের জীবন শুধুমাত্র ইঁদুর দৌড়ে অংশ নেওয়ার জন্য নয়। আমাদের দায়িত্ব আছে, উদ্দেশ্য আছে, যা পশুর মধ্যে নেই—তবু তারা তাদের স্বভাব অনুযায়ী ভারসাম্য রক্ষা করে চলে, আর আমরা?

এই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আমাদের ভাবতে হবে—মানুষের মতো দেখতে হলেই কি মানুষ হওয়া যায়? নাকি মানুষ হওয়া মানে হলো চেতনায়, আচরণে এবং পারস্পরিক দায়বদ্ধতায় একটি সত্তা হয়ে ওঠা?

জানি, এই প্রশ্ন কিছুটা কল্পনাপ্রসূত শোনায়, তবু ভাবুন—যদি আমাদের অমানবিক আচরণের প্রতিফলন আমাদের চেহারায় ফুটে ওঠে? যদি হিংস্র, লোভী, নিষ্ঠুর মানুষের মুখে পশুর রূপ এসে পড়ে? তখন কি আমরা নিজেদের দিকে তাকাতে পারব?

এই প্রশ্নগুলো আমার মধ্যে আসে, কারণ আমি প্রকৃতির সঙ্গে নিরবধি সময় কাটাই। সুইডেনের খোলা মাঠে কৃষিকাজ করি, প্রকৃতির ছন্দে হাঁটি, ভাবি, দেখি। সেখানে প্রকৃতির মধ্যে যে ভারসাম্য, সহনশীলতা ও শান্তি—তা মানুষের সমাজে ক্রমশ অনুপস্থিত। প্রকৃতি আমার মনে করিয়ে দেয়: মানুষ শুধু নিজের জন্য নয়, এক বৃহত্তর উদ্দেশ্যের জন্য সৃষ্টি।

আমাদের জীবন ইঁদুর দৌড়ে শেষ হবার জন্য নয়। মানবসত্তার মূল ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে দায়িত্ব, সহানুভূতি ও সৃষ্টির সঙ্গে সংযোগের উপর। কিন্তু আমরা কি সে পথে আছি? নাকি মানুষ নামের মুখোশ পরে পশুর মতো আচরণ করছি?

উগান্ডার বুদোঙ্গো জঙ্গলে শিম্পাঞ্জিদের নিয়ে গবেষণায় দেখা যায়, তারা শুধু নিজের নয়, অপরের ক্ষতও সারাতে গাছের পাতা বা প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে। গবেষক এলোডি ফ্রেইম্যান এই আচরণকে এক ধরনের ‘social healing’ বলে অভিহিত করেন—যা মানুষের সহানুভূতির প্রতিফলন মনে হয়।

এছাড়াও, অন্যান্য অনেক প্রজাতির মধ্যেও এমন আচরণ দেখা যায়, যেখানে তারা গোষ্ঠীর দুর্বল সদস্যদের রক্ষা করে, খাবার ভাগ করে খায়, বিপদে পাশে থাকে। এর মানে, সহানুভূতি ও নৈতিকতা শুধু মানুষের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়।

বলা হয়, মানুষ দিনকে দিন নিষ্ঠুর হচ্ছে। কিন্তু গবেষণায় দেখা যায়, যুদ্ধ, দাসত্ব বা খুনের হার ইতিহাসের তুলনায় অনেক কমেছে। তবে আমরা এত বেশি নেতিবাচক তথ্যের মুখোমুখি হই (বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে), যে মনে হয় সমাজ ভেঙে পড়ছে।

এটি ‘biased exposure effect’ নামে পরিচিত—যেখানে আমরা নেতিবাচকতাকে বেশি গুরুত্ব দিই। তবুও, এই বাস্তবতা আমাদের দায়বদ্ধতা কমায় না। বরং আমাদের আরও সজাগ ও আত্মসমালোচক হতে শেখায়।

আধুনিক প্রযুক্তি যেমন আমাদের জীবন সহজ করেছে, তেমনি মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে করেছে দূরত্বপূর্ণ। ভার্চুয়াল সংযোগের ছায়ায় হারিয়ে যাচ্ছে আসল সহানুভূতি ও চোখের ভাষা। মোবাইল স্ক্রিনে আমরা জীবন দেখি, কিন্তু জীবনের ছোঁয়া হারিয়ে ফেলছি।

আপনার অভিজ্ঞতা যেমন বলে, প্রকৃতি আমাদের বদলে দিতে পারে। প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত হলে মানুষ তার মূল সত্তার সংস্পর্শে আসে—জাগে সহানুভূতি, শ্রদ্ধা ও ভারসাম্যের বোধ। বিজ্ঞানও বলে, প্রকৃতির মাঝে সময় কাটানো মানসিক স্বাস্থ্য, দায়িত্ববোধ ও সামাজিক সচেতনতা বাড়ায়।

মানুষ হয়ে জন্মানোর পরও আমরা সারাজীবন মানুষ হতে কত কিছুই না করি—তবুও কী আমরা সত্যিই মানুষ হতে পেরেছি?

এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। তবে এটুকু নিশ্চিত—শুধু মানুষের দেহ ধারণ করলেই মানুষ হওয়া যায় না। মানুষ হওয়া মানে হলো আচরণে, চেতনায়, সহানুভূতিতে এবং দায়বদ্ধতায় মানুষ হয়ে ওঠা।

আমি যখন এই প্রশ্ন তুলি— ‘আমরা কি সত্যিই মানুষ হচ্ছি?’—তখন আমি শুধু একজন দর্শক নই। আমি নিজেকেই প্রশ্ন করছি, সমাজকেও ডাক দিচ্ছি। আমি এই সমাজে চেতনার এক দূত হতে চাই।

আমার ভাবনা শুধু ব্যক্তিগত নয়—এটি আমাদের সময়, সমাজ ও সভ্যতার সামনে একটি জরুরি জবাবদিহি তৈরি করে। আমি চাই, আমরা সবাই মুখোমুখি হই সেই প্রশ্নের— আমরা কোন মানুষ হতে চাই? কেবল দেহধারী, না কি আত্মসচেতন, দায়িত্বশীল মানুষ?

এই লেখার প্রতিটি শব্দে আমি চেয়েছি নিজের ভেতরের আলো ও অন্ধকারকে সামনে আনতে, যাতে আপনিও আপনারটা খুঁজে পান। যদি আমরা সবাই আমাদের ভিতরের মানুষটিকে প্রশ্ন করি—তবে হয়তো এখনও সময় আছে সত্যিকার মানুষ হয়ে ওঠার।

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। Rahman.Mridha@gmail.com

শেয়ার করুন:-
শেয়ার