পুঁজিবাজারে চলছে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি মন্দাভাব। দিশেহারা স্টেইকহোল্ডার বিনিয়োগকারীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই। এমন বাস্তবতায় পুঁজিবাজারে সুবিধা রেখে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘিরে কর কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে। আগামী ২ জুন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ টেলিভিশনের মাধ্যমে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব করবেন। তা কার্যকর করা হবে অধ্যাদেশ আকারে। ভ্যাট ও শুল্ক তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হয়ে যাবে। তবে আসন্ন বাজেটে কর বাড়ানোর চেয়ে করদাতাদের স্বস্তি দেওয়ার দিকে নজর বেশি থাকবে। তবে বাজেটে কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজস্ব বাড়বে, আবার কিছু ক্ষেত্রে শর্ত শিথিল করা হতে পারে।
কর বিভাগ সূত্র মতে, পুঁজিবাজারের ব্রোকারেজ হাউজের লেনদেনের উপর উৎসে কর কমানো হতে পারে। ব্রোকারেজ হাউজের মালিকরা দীর্ঘদিন ধরে এই কর কমানোর দাবি জানিয়ে আসছে। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা খুব বেশি না হলেও কিছুটা লাভবান হবে। এ ছাড়া নতুন নতুন কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করার ক্ষেত্রে শর্ত যেমন সহজ করা হবে, তেমনি কর ছাড়ও দেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে।
করমুক্ত আয়সীমা বেড়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা হচ্ছে
অপরদিকে, মূল্যস্ফীতির কশাঘাতে জর্জরিত স্বল্প আয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে আগামী বাজেটে বাড়ানো হচ্ছে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা। আয়ের সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করা হচ্ছে। অপরিবর্তিত থাকছে করহার। বর্তমানে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের আয়ের স্তরভেদে ৫, ১০, ১৫, ২০ ও ২৫ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হয়। এনবিআর কখনোই টানা করমুক্ত আয়ের সীমা কমায়নি। সাধারণত ২-৩ বছর বিরতিতে আয়ের সীমা বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা করা হয়। ২০২০-২১ সালে করমুক্ত আয়ের সীমা আড়াই লাখ থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২ লাখ ২০ হাজার থেকে বাড়িয়ে আড়াই লাখ টাকা করা হয়। সাধারণ করদাতাদের বাইরে নারী করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা ৪ লাখ টাকা, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের করদাতাদের ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ও গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের করদাতাদের করমুক্ত সীমা ৫ লাখ টাকা।
ব্যক্তিশ্রেণি-কোম্পানির অনলাইন রিটার্ন বাধ্যতামূলক হচ্ছে
আয়কর বিভাগ সূত্রমতে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর থেকে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের অনলাইন রিটার্ন দাখিলে সাড়া পেয়েছে এনবিআর। সেজন্য সরকারি চাকরিজীবীসহ কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনলাইনে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়। প্রায় ১৬ লাখ ব্যক্তিশ্রেণির করদাতা অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করেছেন। আসন্ন বাজেটে অনলাইন রিটার্ন দেওয়ার ব্যবস্থা আরো সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। যার ফলে ব্যক্তিশ্রেণির পাশাপাশি কোম্পানি করদাতাদের অনলাইনে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হতে পারে।
কপোরেট করের শর্ত শিথিল হচ্ছে, ২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ কর্পোরেট কর নির্ধারণ করা হচ্ছে
সূত্র মতে, ব্যবসায়ীদের মাথাব্যথা বর্ধিত করপোরেট কর। দাবির প্রেক্ষিতে গত কয়েক অর্থবছর সরকার করপোরেট কর কমিয়েছে। সাড়ে ৭ শতাংশ পর্যন্ত করপোরেট কর কমানো হয়েছে। কিন্তু করপোরেট কর কমানোর সুফল ব্যবসায়ীরা পাচ্ছেন না বলে বিভিন্ন সময় অভিযোগ করে আসছেন। কারণ, ‘শর্ত সাপেক্ষে’ করপোরেট কমিয়েছে সরকার। এই শর্তের কারণে ব্যবসায়ীরা এই সুফল পাচ্ছে না। ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে ‘শর্ত’ শিথিল এবং করপোরেট কর কমাতে বিভিন্ন সময় এনবিআরকে অনুরোধ জানিয়ে আসছে। বর্তমানে দেশের পরিস্থিতির কারণে এবং ব্যবসায়ীদের স্বস্তি দিতে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছর ‘শর্ত’ শিথিল করা হতে পারে। তবে করপোরেট কর কমানো হবে না। শর্ত শিথিল ছাড়াও ২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ অর্থবছরের করপোরেট করহার নির্ধারিত করে দেওয়া হতে পারে।
কৃষিভিত্তিক খাতে কর অব্যাহতি প্রত্যাহার হতে পারে
কর অব্যাহতি তুলে নেওয়ার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আসন্ন বাজেটে বহুল আলোচিত মৎস্য ও পোল্ট্রি খাতের বিদ্যমান আয়কর সুবিধা বাতিল করে স্বাভাবিক করহার প্রবর্তন করা হতে পারে। কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে এসব খাত থেকে আয় করলে তার ওপর ৩ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ হারে আয়কর প্রদান করতে হয়। তবে আগামী বাজেটে এনবিআরের নতুন পদক্ষেপের পরে এসব খাতের আয়ের ওপর নিয়মিত হারে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কর দিতে হতে পারে। এ তালিকায় আসতে পারে হাঁস-মুরগি ও চিংড়ি হ্যাচারির আয়ও। এছাড়া তালিকায় যুক্ত হতে পারে—পোলট্রির পেলেটেড ফিড উৎপাদন, গবাদিপশু, চিংড়ি ও মাছের পেলেটেড ফিড উৎপাদন, বীজ উৎপাদন ও বিপণন, গবাদিপশুর খামার, দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যের খামার, ব্যাঙ উৎপাদন খামার, হর্টিকালচার, তুঁত চাষ, মৌমাছি চাষ প্রকল্প, রেশম গুটিপোকার খামার, মাশরুম খামার এবং ফ্লোরিকালচারের আয়। বর্তমানে এসব খাত থেকে বার্ষিক আয় হলে প্রথম ১০ লাখ টাকার ওপর ৫ শতাংশ, পরবর্তী ১০ লাখ টাকার ওপর ১০ শতাংশ এবং অবশিষ্ট আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। অথচ এর বিপরীতে, ব্যক্তি করদাতাদের সর্বোচ্চ করহার বর্তমানে ৩০ শতাংশ এবং অধিকাংশ কোম্পানিকে ২৭.৫ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। মূলত দেশের মৎস্য, পোলট্রি ও গবাদিপশু খাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে এই কম করহার সুবিধা চালু হয়েছিল। তবে অভিযোগ রয়েছে, এ সুবিধার সুযোগ নিয়ে অনেকে মৎস্য খাতের আয় দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ কালো টাকা সাদা করেছেন। বিশেষ করে প্রভাবশালী রাজনীতিক, আমলা ও ব্যবসায়ীরা এই সুবিধার অপব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ খাতে কম হারে কর আদায়ের ফলে সরকার কোম্পানি পর্যায়ে ১৪৩ কোটি টাকা এবং ব্যক্তি পর্যায়ে ২,৯৮৫ কোটি টাকার কর ছাড় দিয়েছে। বর্তমানে ট্যাক্স ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তারা এসব খাতে বড় অঙ্কের আয় দেখানো শতাধিক ব্যক্তির তথ্য নিয়ে কাজ করছেন।
ন্যূনতম কর ৫ হাজার টাকা হচ্ছে
সূত্রমতে, কর বৈষম্য কমাতে আগামী বাজেটে ন্যূনতম কর ৫ হাজার টাকা করা হচ্ছে। ফলে সিটি করপোরেশন, পৌর এলাকা, গ্রাম এলাকার করদাতাদের ন্যূনতম কর পাঁচ হাজার টাকা দিতে হবে। ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা দু-এক অর্থবছর পরপর বাড়লেও ন্যূনতম করহার বাড়ানো হয়নি। সর্বশেষ ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে অঞ্চলভেদে ব্যক্তিশ্রেণির ন্যূনতম করহার বাড়ানো হয়। সেই থেকে আজ অবধি একই হারে করদাতারা কর দিয়ে আসছেন। এ সময় করমুক্ত আয়ের সীমা একাধিকবার বাড়ানো হয়েছে। এবার করবৈষম্য কমিয়ে আনতে সব এলাকার করদাতাদের ন্যূনতম কর ৫ হাজার টাকা করা হতে পারে। বর্তমানে ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকার করদাতাদের ন্যূনতম কর ৫ হাজার টাকা, অন্য সিটি করপোরেশন এলাকার করদাতাদের ৪ হাজার টাকা ও সিটি করপোরেশনের বাইরে পৌর এলাকা ও গ্রামাঞ্চলের করদাতাদের কর ৩ হাজার টাকা বিদ্যমান রয়েছে। আর্থিক বৈষম্য কমিয়ে এনে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় সর্বপ্রথম ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটে অঞ্চলভিত্তিক করহার চালু করা হয়।
ভূমি নিবন্ধনে কর কমছে
ভূমি নিবন্ধনের ক্ষেত্রে আসন্ন বাজেটে কিছুটা ছাড় দেওয়া হচ্ছে। কাঠার পরিবর্তে শতাংশে নিবন্ধন ফি ও কর নির্ধারণ করা হবে। ভূমি নিবন্ধনে অগ্রিম কর কিছুটা কমানো হতে পারে। এর ফলে ভূমি বা সম্পত্তি নিবন্ধনে কর কমবে না বলে মনে করেন কর্মকর্তারা। গত অর্থবছর ভূমি নিবন্ধন থেকে এনবিআর প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার কর পেয়েছে।
টার্নওভার কর বাড়ছে
বর্তমানে বছরে তিন কোটি টাকার বেশি টার্নওভার হয়, এমন প্রতিষ্ঠানকে লাভ-লোকসান নির্বিশেষে দশমিক ৬ শতাংশ কর দিতে হয়। এটি আসন্ন বাজেটে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হতে পারে। বর্তমানে কোম্পানি ও ব্যক্তিগত টার্নওভারে ন্যূনতম কর থেকে সরকার প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব পায়। প্রস্তাবিত এই হার বাড়লে— অতিরিক্ত আরও ৩,৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনা রয়েছে বলে আশা করছে এনবিআর। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নিবন্ধিত ২ লাখ ৮৮ হাজার কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ২৪ হাজার ৩৮১টি রিটার্ন দাখিল করেছে। বর্তমানে পাঁচ ধরনের ব্যক্তি ও কোম্পানি করদাতার ওপর ০.২৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত ন্যূনতম কর হার রয়েছে। এরমধ্যে কার্বোনেটেড বেভারেজ কোম্পানির ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ হারে, তামাক কোম্পানির ওপর ৩ শতাংশ হারে, মোবাইল ফোন অপারেটরদের ২ শতাংশ, এবং ০.২৫ শতাংশ হলো সেইসব ব্যক্তি করদাতার জন্য— যাদের বার্ষিক টার্নওভার ৩ কোটি টাকা অতিক্রম করে। বাদবাকী কোম্পানির ০. ৬০ শতাংশ এবং রপ্তানিকারকদের ১ শতাংশ ন্যূনতম কর দিতে হয়। এনবিআরের তথ্যমতে, রিটার্ন জমা দেওয়া ২০০ এর মতো কোম্পানি বাদে বাকি প্রায় ২৪ হাজার কোম্পানিই ০.৬০ শতাংশ হারে ন্যূনতম করের আওতায় রয়েছে। অবশ্য এরমধ্যে ন্যূনতম কর দিচ্ছে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ বা প্রায় ৮ হাজার কোম্পানি। অর্থাৎ প্রস্তাবিত হারে কর বাড়লে মূলত এই ৮ হাজার কমপ্ল্যায়েন্ট কোম্পানির ওপরই চাপ বাড়বে।
খাদ্য, সার, কাঁচামালের শুল্কমুক্ত ২০০ আমদানি পণ্যে অগ্রিম কর বসছে
করমুক্ত প্রায় ২০০টি পণ্যের ওপর আমদানি পর্যায়ে ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) আরোপ হতে পারে। ধাপে ধাপে করছাড় তুলে নেওয়া এবং কর পরিপালন বাড়ানোর অংশ হিসেবে নেওয়া এই পদক্ষেপ থেকে অতিরিক্ত ২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। যেসব পণ্য এই নতুন করের আওতায় আসবে, তার মধ্যে রয়েছে দেশের পোশাক শিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল যেমন তুলা এবং মানবসৃষ্ট তন্তু। পাশাপাশি আলু, পেঁয়াজ, মসুর ডাল, ছোলা, সয়াবিন ও ভুট্টার মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য, সার, অপরিশোধিত তেল, চিনি এবং চিকিৎসা সরঞ্জামও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ ছাড়া কম্পিউটার প্রিন্টার, রাউটার, মডেম, বিমান ইঞ্জিন ও বাসসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স ও শিল্প যন্ত্রপাতিও প্রভাবিত হতে পারে। প্রস্তাবিত কর সম্প্রসারণের আওতায় চিকিৎসা সরঞ্জাম, শিল্প রাসায়নিক, বিমান, বাস, আমদানি করা মাছ ও মাংস, নেটওয়ার্কিং ডিভাইস এবং প্রিন্টার আনুষঙ্গিকও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
সঞ্চয়পত্র, এফডিআরে বিনিয়োগ, ভূমি নিবন্ধন ও পেশাজীবীদের পিএসআর লাগবে না
একাধিক সূত্রমতে, সঞ্চয়পত্রে অনেকেই লাখ লাখ বিনিয়োগ করেন। কিন্তু রিটার্ন দাখিল করেন না। আবার অনেকেই ব্যাংকে লাখ লাখ টাকার এফডিআর করেন। কিন্তু রিটার্ন দাখিল করেন না। রিটার্ন দাখিল না করায় এক অর্থে তারা করজালে আসে না। সঞ্চয়পত্র ক্রয়কারী ও এফডিআরে বিনিয়োগকারীদের করের আওতায় আনতে এই দুই খাতে বিনিয়োগে ‘আয়কর রিটার্ন দাখিলের’ শর্ত বা পিএসআর জমার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছর এই শর্ত শিথিল করা হতে পারে। পিএসআর এর পরিবর্তে ই-টিআইএন এর কপি দিতে হবে। এছাড়া কয়েকটি পেশাজীবী সংগঠনের সদস্যপদ নেয়ার ক্ষেত্রেও পিএসআর এর শর্ত শিথিল করা হতে পারে।
কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে পাঁচ লাখ টাকা বা তার বেশি টাকার সঞ্চয়পত্র কিনতে গেলেই আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র বা পিএসআর দাখিলের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আগামী বাজেটে তা থাকছে না। মূলত সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়াতে এই শর্ত শিথিল করা হচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাংকে ১০ লাখ টাকা বা তার বেশি মেয়াদি আমানত খুলতেও রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেওয়ার বাধ্যবাধকতাও উঠে যাচ্ছে। এ ছাড়া চিকিৎসক, দন্ত চিকিৎসক, আইনজীবী, হিসাববিদ, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট, ইঞ্জিনিয়ার, স্থপতি, সার্ভেয়ারসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংস্থার সদস্যপদ পেতে এবং তা বহাল রাখতেও এ ধরনের বিধান থাকছে না। পিএসআর এর পরিবর্তে ই-টিআইএন দিলেই হবে। তবে এসব পেশাজীবীরা তাদের সংগঠন বা সংস্থায় রেজিস্ট্রেশনের সময় ই-টিআইএন দিলেও রি-রেজিস্ট্রেশনের সময় পিএসআর দিতে হবে। অর্থাৎ এসব পেশাজীবী পেশায় প্রবেশের সময় তাদের স্বস্তি দিতে এই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। আবার ভূমি, ফ্ল্যাট বা সম্পত্তি কেনা-বেচার নিবন্ধনের সময় পিএসআর দিতে হয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসব সম্পত্তি নিবন্ধনের সময় পিএসআর এর শর্ত শিথিল করা হতে পারে। কারণ বহু গরীব, অসহায় মানুষ আছে-যাদের আয় নেই, রিটার্ন দাখিল তাদের প্রয়োজন নেই।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা শতাধিক পণ্যে শুল্ক ছাড় পাচ্ছে
অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা বাড়তি শুল্ক কমানোর জন্য ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে অন্তত ১০০ ধরনের আমদানি পণ্যের শুল্ক কমাতে যাচ্ছে সরকার। যুক্তরাষ্ট্র থেকে মূলত বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, অস্ত্র, ফাইটার বিমানের পার্টস, মিসাইলসহ ১৫-১৬টি পণ্য কেনে। অস্ত্র ও যুদ্ধ বিমান, মিসাইল জাতীয় পণ্য সরকার কিনলে তখন চুক্তির আওতায় শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকে। ফলে রাজস্ব হারানোর শঙ্কা থাকে না বলে মনে করেন এনবিআর কর্মকর্তারা। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য বৈষম্য কমাতে বাংলাদেশ আগে থেকে ১৯০ ধরনের পণ্যের শুল্কহার শূন্য রেখেছে। এবার আরও ১০০ ধরনের পণ্য সেই তালিকায় যুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দেওয়া হয়।
মৎস্য, ডেইরি ও পোল্ট্রি খাতে করছাড় থাকছে না-থাকছে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ
এনবিআর সূত্র মতে, বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক ব্যক্তি ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা মৎস্য, ডেইরি ও পোলট্রি খাতে বিনিয়োগ দেখিয়ে কর ছাড়ের সুবিধা নিয়েছেন। ওই সুযোগ তুলে দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন পেয়েছে। তবে বাড়ি, ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট কেনার সময় কালো টাকা দিয়ে বিনিয়োগ করে সুযোগ বহাল রাখারই সিদ্ধান্ত এসেছে। করপোরেট কর হার না বাড়লেও টার্নওভার কর দ্বিগুণ, ব্যক্তি করদাতার ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন কর ৫ হাজার টাকা, সর্বোচ্চ কর ৩০ শতাংশে উন্নীত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এসি-ফ্রিজ-মোবাইল ফোনে ভ্যাট বাড়ছে
মাত্র ছয় মাস আগে ফ্রিজ ও এয়ার কন্ডিশনার প্রস্তুতকারকদের ওপর করপোরেট কর দ্বিগুণ করার পর, এবার তাদের পণ্যে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে সরকার। এর ফলে প্রচণ্ড গরমের এই সময়ে ভোক্তাদের ওপর চাপ আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন এই খাত সংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে ফ্রিজ ও এয়ার কন্ডিশনারের উৎপাদন পর্যায়ে সাড়ে ৭ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপিত রয়েছে, তবে এনবিআর আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছর তা ১৫ শতাংশ করার পরিকল্পনা করছে। একইভাবে, মোবাইল ফোন তৈরিতে স্থানীয় মূল্য সংযোজনের ওপর নির্ভর করে ৫ ও সাড়ে ৭ শতাংশ হারে যে ভ্যাট আরোপিত রয়েছে, তা বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ ও ১০ শতাংশ করারও প্রস্তাব করা হচ্ছে। এছাড়া ব্যাটারি তৈরির ওপরও বিদ্যমান সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা পারে।
বিদেশ থেকে বছরে স্বর্ণ আনা যাবে একবার
কাস্টমস বিভাগের একাধিক সূত্রমতে, বিদেশফেরত যাত্রীদের জন্য ব্যাগেজ রুলে বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে সরকার। শুল্ক ছাড়াই বছরে একাধিকবার স্বর্ণ আনার সুযোগ থাকলেও এখন থেকে সেটি সীমিত করা হচ্ছে বছরে মাত্র একবার। একই সঙ্গে ১০ হাজার ডলারের বেশি বহন করলে তা নির্ধারিত ফরমে ঘোষণা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এ ছাড়া সেকেলে ও অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় কয়েকটি পণ্যের আমদানির সুযোগ বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমান নিয়মে একজন যাত্রী বছরে যতবার খুশি ততবার শুল্ক ছাড়াই ১০০ গ্রাম স্বর্ণালংকার বা ২০০ গ্রাম রুপার অলংকার আনতে পারেন। এ ছাড়া শুল্ক দিয়ে ১১৭ গ্রাম বা প্রায় ১০ ভরি স্বর্ণের বার আনার সুযোগ রয়েছে, যার জন্য প্রতি ভরিতে দিতে হয় চার হাজার টাকা শুল্ক। নতুন প্রস্তাবনায় এ সুযোগ সীমিত করে বছরে একবার করা হচ্ছে। বর্তমানে স্থলবন্দর দিয়ে বছরে তিনবার সর্বোচ্চ ৪০০ ডলার পর্যন্ত শুল্কমুক্ত পণ্য আনার সুযোগ থাকলেও তা কমিয়ে একবার করা হচ্ছে। একই সঙ্গে ইউ-ব্যাগেজ (যাত্রীর সঙ্গে না থাকা লাগেজ) ব্যবস্থায় ১২ বছরের কম বয়সী শিশুর জন্য ১০০ কেজি এবং ১২ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য ৪০ কেজি পর্যন্ত পণ্য আনার সুযোগ থাকছে। এ ছাড়া অতীতের মতো অপ্রয়োজনীয় ও পুরনো প্রযুক্তির কিছু পণ্য যেমন ক্যাসেট প্লেয়ার, ডিস্কম্যান, টাইপরাইটার, ওয়াকম্যান, ফ্যাক্স মেশিন, ১৯ ইঞ্চি এলসিডি মনিটর, পুশবাটন ফোন—এসব পণ্য আমদানির সুযোগ বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
এসএম