ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সংগঠন ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ দেশের শীর্ষ ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তিরা। দেশের শেয়ারবাজার যখন পতনের বৃত্তে আটকে আছে তখন ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানগুলো খরচ মিটাতে হিমসিম খাচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মী ছাঁটাই করছে এবং শাখা অফিস গুটিয়ে নিচ্ছে খরচ কমানোর জন্য ঠিক তখনই ডিবিএ সদস্য প্রতিষ্ঠানের চাঁদার পরিমাণ বাড়িয়েছে ১৬ গুণ পর্যন্ত। বার্ষিক সদস্য ফি যেখানে গতবছর ছিল ১২ হাজার টাকা, তা এখন ২ লাখ টাকা পুন:নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে অনেক প্রতিষ্ঠান এই ফি পরিশোধে অপারগতা প্রকাশ করে ডিবিএকে চিঠি দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, বাজারের উন্নয়নের জন্য ডিবিএ এমন কী ভূমিকা রেখেছে? নিজেদের আখের গুছাতে ব্যস্ত। বাজারে বর্তমানে যে সংকট তা সমাধানে কোন ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি, উল্টো নিয়ন্ত্রক সংস্থার তেলবাজিতে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে।
সূত্র মতে, ডিএসইর ‘শীর্ষ-২০’ ব্রোকারেজ হাউজগুলো প্রথম ১০টির ফি বাড়িয়ে দুই লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। পরবর্তী ১০টির সদস্য ফি ধরা হয়েছে দেড় লাখ টাকা। যা গত অর্থবছরেও ছিলো সাড়ে ১২ হাজার টাকা। ডিবিএর এমন কাণ্ডে দিশেহারা ডিএসইর ‘শীর্ষ-২০’ ব্রোকারেজ হাউজ। গত বছরের তুলনায় আলোচ্য বছরে প্রথম ১০টি ব্রোকারেজ হাউজের সদস্য ফি বেড়েছে ১৬ গুণ।
এদিকে, গত বছরে (১ জুলাই ২০২৩-৩০ জুন ২০২৪) বার্ষিক সদস্য ফি ১২ হাজার ৫০০ হাজার নির্ধারণ করা হয়েছে। আর চলতি বছরে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) ‘শীর্ষ-২০’ ব্রোকারেজ হাউজের প্রথম ১০টির সদস্য ফি বৃদ্ধি করে ২ লাখ টাকা ধার্য্য করা হয়েছে। এই হিসেবে সদস্য ফি বেড়েছে ১৬ গুণ।
জানা গেছে, পতনের বৃত্তে আটকে আছে দেশের পুঁজিবাজার। প্রায় পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমেছে সূচক। এমন অবস্থায় সদস্য ফি বৃদ্ধির কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে পুঁজিবাজারের ব্রোকারেজ হাউজগুলো। লোকসানের চাপ সামাল দিতে পারছে না এদের শাখা অফিস, এমনকি বন্ধ করে দিতেও বাধ্য হচ্ছে তারা।
গত বছরের ৬ নভেম্বর ১১৫তম সভায় এসোসিয়েশনের সদস্যদের বার্ষিক সদস্য ফি বৃদ্ধির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। ডিবিএ’র সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে ডিএসই কর্তৃক প্রকাশিত পূর্ববর্তী বছরের (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) ট্রেড ভলিয়্যুমের ভিত্তিতে নির্ধারিত শীর্ষ ২০ ব্রোকারেজ হাউজের মধ্যে প্রথম ১০টি ব্রোকারেজ হাউজের জন্য ২ লাখ টাকা এবং পরবর্তী ১০ ব্রোকারেজ হাউজের জন্য ১ লাখ ৫০ হাজার হাজার টাকা বার্ষিক সদস্য ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া, ডিবিএ’র সদস্যভুক্ত অন্য ব্রোকারেজ হাউজের জন্য ২৫ হাজার টাকা ফি ধার্য্য করা হয়েছে।
ডিবিএর এক চিঠিতে বলা হয়, বার্ষিক সদস্য ফি অর্থবছরের পরিবর্তে ক্যালেন্ডার সাল (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) হিসেবে আদায় করা হবে। এই সিদ্ধান্ত চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। এবং ধার্য্যকৃত বাৎসরিক সদস্য ফি প্রতিবছরের শুরুতে অর্থাৎ জানুয়ারি মাসে সংগ্রহ করা হবে। এছাড়া ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অনাদায়ী বকেয়া ৬ মাসের ফি সকল সদস্যদের জন্য মওকুফ করা হয়েছে। একই সঙ্গে টাকা জমা দিয়ে রশিদ সংগ্রহ করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে সংগঠনটি।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, ফ্লোর প্রাইসের কারণে ব্রোকারেজ হাউজগুলোর ব্যবসা বিপর্যস্ত হয়েছে। পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করেছেন। এ স্থবিরতা এখনো অব্যাহত রয়েছে এবং পুঁজিবাজারে গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যার ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান আর্থিক সংকটে পড়েছে। এমন অবস্থায় ব্রোকারেজ হাউজগুলোর বার্ষিক সদস্য ফি বৃদ্ধি করে ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত এক দশকে এ শিল্পে কোনো উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হয়নি, এমনকি করোনা পরবর্তী সময়েও কোনো ধরনের প্রণোদনা দেয়া হয়নি। ফলে ব্রোকারেজ হাউজগুলোর আর্থিক ভিত্তি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগও কমে আসছে। একসময় যেখানে দেশর পুঁজিবাজারে দৈনিক লেনদেন ছিল ১০০০-১২০০ কোটি টাকা, ২০২৪ সালে তা গড়ে ৫৯৯ কোটি টাকায় নেমে আসে এবং বর্তমানে দৈনিক গড় লেনদেন আরো কমে ৩০০ কোটি টাকার ঘরে পৌঁছেছে। এ ধারা ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়কে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, যার ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে এবং কর্মী ছাঁটাই করতে বাধ্য হচ্ছে। এই অবস্থায় ব্রোকারেজ হাউজগুলোর বার্ষিক সদস্য ফি বৃদ্ধি কারণে বাজারের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সম্প্রতি পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক পতনের প্রতিবাদে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেয় বিনিয়োগকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশন। এ কর্মসূচিকে সফল করতে বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজে কর্মরত কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। এমন পরিস্থিতিতে ডিবিএ’র পক্ষ থেকে ব্রোকারেজ হাউজগুলোর এমডি ও চেয়ারম্যানের উদ্দেশ্যে একটি সতর্ক বার্তা দেওয়া হয়। ফলে বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজের পক্ষ থেকে বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভে অংশ নিতে বাধা দেওয়া হয়। এতে বিক্ষুদ্ধ হয় ভিবিন্ন ব্রোকারেজের শীর্ষ নির্বাহী সহ সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
আইল্যান্ড সিকিউরিটিজের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মহিউদ্দিন এফসিএমএ, অর্থসংবাদকে বলেন, আমরা “শীর্ষ-২০” ব্রোকারেজের তালিকায় আছি অথচ এখনও সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন পরিশোধ করতে পারিনি। ডিবিএকে চিঠি দিয়েছি এটা আগামী বছর করতে, এখন অসম্ভব। আমাদের প্রতিষ্ঠান চালাতেই হিমসিম খাচ্ছি। অনেক কর্মকর্তা আমাদের এখানে ১৫-২০ বছর চাকরি করছে তাদেরকে বলতে হচ্ছে অন্য জায়গায় চাকরি খুঁজতে। তাছাড়া একটি ট্রেড অর্গানাইজেশনের অনেক কিছু থাকতে হয়, রিসার্চ থাকতে হয়, সেটা ডিবিএর নাই। শুধু মিটিং সিটিং করেই শেষ। আমাদের নাটক দেখিয়ে ১০ বছর পার করেছে।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট অর্থসংবাদকে বলেন, এই বিষয়টি পরিচালনা পর্ষদে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন কোন সদস্যের যদি আপত্তি থাকে চিঠি দিবে এবং সেটা বোর্ডে আলোচনা হবে। এটা ভিতরের তথ্য পাবলিক করা ঠিক না, আমরা আমাদের রিসোর্চ এবং অফিস খরচ চলেই তো সদস্যদের চাঁদায়। ডিবিএ তো মার্কেটের জন্যই কাজ করছে। একাডেমিক এবং রিসার্চ নিয়ে কাজ করছি। আমরা এখন ভিন্নভাবে কাজ করছি।