ক্যাটাগরি: মত দ্বিমত

এতো দেখছি নতুন বোতলে পুরনো মাদক!

‘ভারত থাকলে আমি থাকব, যা খুশি তাই করব’—এই মানসিকতা নতুন নয়। ‘দেশ পরে, আমি আগে’—এমন আত্মকেন্দ্রিকতা আমরা ইতিহাসে বহুবার দেখেছি। ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধেই তো আমরা দেখেছি—কারা জীবন হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমেছে, আর কারা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। আজ যখন দেখি শেখ পরিবারের নাম করে দেশপ্রেমের নাটক চলছে, তখন প্রশ্ন জাগে—সত্যিই কারা এই দেশের হয়ে লড়েছিল?

একদা পাকিস্তানি সরকার আমাদের সম্পদ লুটে নিয়ে যেত—এটা ছিল ভয়াবহ। আজ শেখ হাসিনার সরকার একই কায়দায় দেশের অর্থ পাচার করে বিদেশে বানিয়েছে ‘বেগমপাড়া’। তফাৎ কোথায়? তখন নাম ছিল পাকিস্তান, আজ নাম ‘গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ’। আর যখন এই চক্রের সদস্যরা পালিয়ে যায়, তখন বারবার প্রশ্ন জাগে—আসল রাজাকার কারা? যারা যুদ্ধ করেনি? নাকি যারা নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে পরে দেশটাকে পণ্য বানিয়ে বিদেশে চলে গেছে?

একটি সত্য চাপা পড়লে ইতিহাস বিকৃত হয়। ‘আওয়ামী লীগ’ নামে যে দলটি একদিন গণমানুষের শক্তি ছিল, আজ কি সেটিই এই লুটেরা চক্র? না, একেবারেই নয়। আমরা যারা ছিলাম—যুদ্ধ করেছি, মিছিল করেছি, রাস্তায় ছিলাম—আমরাও তো আওয়ামী লীগেরই অংশ ছিলাম। কিন্তু সেই দল আর এই দল এক নয়। সবার পলায়ন ঘটেনি। আমরা রয়ে গিয়েছিলাম, লড়াই করেছি, আজও দেশেই আছি—কাজ করে যাচ্ছি।

আমরা রাজনীতি করি না, গুণ্ডামি করি না, চাঁদাবাজিও না। আমরা দেশ গড়ি, মানুষের জন্য কাজ করি। আমরা Good for Nothing নই—আমরা দেশের ভিতরে Good for Everything।

তাই আমাদের বক্তব্য পরিষ্কার:
অপরাধী অপরাধীই—সে যেই দলের হোক না কেন। সে আওয়ামী লীগ হোক, বিএনপি, জামাত, শিবির বা অন্য যেকোনো দল—আইনের শাসনের আওতায় তার বিচার হতেই হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নামের ট্যাগ থাকলেই সাধারণ মানুষকে দমন করা, নির্যাতন চালানো—এটা চলতে পারে না।

৭০ শতাংশ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল—তারা সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, দেশ স্বাধীন করেছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যারা যুদ্ধে ছিল না—তারাই এখন রাষ্ট্রের মালিক হয়ে বসে আছে। আর যারা ছিল, যারা লড়েছিল, রক্ত দিয়েছিল—তারা এখনো উপেক্ষিত।

দেখা যাচ্ছে, যারা দেশেই থেকে গিয়েছে, তারা হয়তো দুর্নীতিগ্রস্ত—তবুও তারা দেশের উন্নয়নে কিছু না কিছু করছে। অন্যদিকে, যারা কৌশলে ক্ষমতা নিয়ে দেশ লুটেছে, নিজেরা বিদেশে বসে দেশ চালিয়েছে—তারা এখনো বিচারহীন। এই বিভাজন আমাদের বুঝতে হবে।

সত্য চেপে রাখলে প্রকৃত অপরাধীরা রয়ে যায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। তারা ইতিহাসকে বিকৃত করে, জনগণকে বিভ্রান্ত করে। তাদের চিহ্নিত করুন। বিচারের আওতায় আনুন। কিন্তু যারা একসময় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নে বিশ্বাস করেছিল, সাধারণ মানুষ হিসেবে আশাবাদী ছিল—তাদের দোষ দিয়ে ইতিহাসকে কলঙ্কিত করবেন না।

জিয়াউর রহমান নিজেও আওয়ামী লীগের অংশ ছিলেন, যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু যখন দেখেছেন শেখ পরিবার দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে, তখন সরে দাঁড়িয়েছেন। আমরাও তাই করেছিলাম—বিশ্বাস করেছিলাম, পরে প্রতারণা দেখেছি।

আজ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি আমাদের বিনীত আহ্বান: আপনার দায়িত্ব সংস্কার করা, বিশৃঙ্খলা নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনে যেন নতুন করে হতাশা না আসে—এই দায়িত্ব আপনাকে নিতেই হবে।

আমরা কেউ ভারতের গোলাম না, না শেখ পরিবারের, না কোনো দলের। আমরা দেশের, মানুষের। সেই দায়িত্ব থেকেই বলছি: এই দেশ কারো বাপের সম্পত্তি নয়। এটা সৎ, মহৎ, কর্মঠ মানুষের দেশ। যারা দুর্নীতির সংস্কৃতিতে জড়িত, তারা সবাই অপরাধী—দলের নামে হোক, বা ব্যক্তিগত সুবিধার নামে।

শুধু একটি দলের দুর্নীতিকে টার্গেট করলে হবে না। বিএনপির নামেও আজ চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ হচ্ছে। তারা বলে বেড়ায়—“আমরা পেছনে থাকি, তোরা ওপরে থাক”—এই অপসংস্কৃতিও এখন বিএনপির নামেই প্রতিষ্ঠিত।

প্রশ্ন হচ্ছে: তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন? আওয়ামী লীগের দুর্নীতিবাজ আর বিএনপির চাঁদাবাজের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়? অথবা অন্য দলের গডফাদারদের সঙ্গে?

স্বৈরাচার থেকে মুক্ত হয়ে যদি আমরা নতুন এক স্বরাচারের শৃঙ্খলে বন্দি হই—তাহলে কেন ঝরেছিল এত রক্ত? কেন মায়েরা সন্তান হারিয়েছিলেন, তরুণেরা জীবন দিয়েছিল?

২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান কোনো ব্যক্তি পরিবর্তনের জন্য ছিল না— তা ছিল রাষ্ট্র কাঠামোর মৌলিক রূপান্তরের জন্য। যদি সেই কাঠামো অপরিবর্তিত থাকে, পুরনো শোষণ শুধু নতুন মুখে ফিরে আসে— তাহলে আমাদের সংগ্রাম ব্যর্থই থেকে যাবে।

এই মুহূর্তে আমাদের প্রধান দায়িত্ব: আর কোনো ফ্যাসিবাদ যেন এই দেশে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। এই লড়াই কোনো গদির জন্য নয়, কোনো গোষ্ঠীর জয়গান নয়— এটি ন্যায়ের, মানবিকতা আর অন্তর্ভুক্তির রাষ্ট্রব্যবস্থা নির্মাণের লড়াই।

যে-ই করুক, দলের নাম যেটাই হোক- অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে সমান ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে আমরা শুধু এক শোষকের জায়গায় আরেক শোষক বসাচ্ছি।

দলের নাম দিয়ে কারো গায়ে ‘অভিজাতত্বের চাদর’ জড়িয়ে দিলে এই সমাজ কখনো বদলাবে না। আমরা দেখেছি—জামায়াত, বিএনপি, আওয়ামী লীগ এমনকি তথাকথিত স্বাধীন প্ল্যাটফর্ম—সবখানেই একই অপরাধ, শুধু রং বদলেছে।

এই সুবিধাবাদী কালচার, বংশানুক্রমিক দুর্নীতির নেটওয়ার্ক—যদি ভেঙে না ফেলা যায়, তাহলে সরকার বদলালেও থাকবে ‘যে লাউ, সেই কদু’। সুতরাং, আজ সময় সত্য বলার।

সংস্কারের নামে ভণ্ডামি নয়।
দেশটা কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়—এটি সেইসব মানুষের, যারা ন্যায়ের পক্ষে, মানুষের পক্ষে। দল নয়, ব্যক্তি নয়—নীতি হোক নেতৃত্বের ভিত্তি। মুখ নয়—মনোভাব বদলাক।

যারা এখনো বলে, ‘আমরা ঐ দলের লোক, ক্ষমতায় গেলে সব ঠিক করে ফেলব’—তাদের জিজ্ঞেস করি: তোমরা নিজে কি বদলেছো? যদি বদল না আসেই, তাহলে আগামীকালও পুরনো লোক, পুরনো পদ্ধতি, পুরনো মিথ্যাচারই চলবে!

আমরা চাই—একটি নতুন বাংলাদেশ, যেখানে বিচার হবে কর্ম ও সততার ভিত্তিতে—না কারো রক্তের সম্পর্ক দেখে, না দলের ট্যাগ দেখে। সৎ মানুষই হোক এই দেশের কান্ডারি। আর তা কেবল কথায় নয়, কাজে প্রমাণ করেই দেখাতে হবে।

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন

শেয়ার করুন:-
শেয়ার