ক্যাটাগরি: মত দ্বিমত

অন্তরের গহীনে পহেলা বৈশাখ: ছোটবেলার স্মৃতি থেকে নতুন অধ্যায়ের সূচনা

দেশ এবং ভাষা, একে অপরের সাথে গভীরভাবে গাঁথা, যেন দুই প্রাচীন রেশমি সুতো এক সুতায় বাঁধা। বাংলা ভাষা, এই মাটি, এই জনগণের অভ্যন্তরীণ আত্মা—এগুলো সবই একযোগে জড়িয়ে থাকে, যেখানে একে অপরের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। এই দেশের মানুষ, যে ভাষায় কথা বলে, যে সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠে, সেই ভাষা ও সংস্কৃতি তার অস্তিত্বের অঙ্গ। এবং পহেলা বৈশাখ, এই বাঙালি নববর্ষ, ঠিক তেমনই একটি দিন—যে দিনটি শুধুমাত্র একটি নতুন বছরের সূচনা নয়, বরং একটি নতুন অধ্যায়ের যাত্রা, যেখানে আমরা সবাই একযোগে একটি নতুন সূর্যের দিকে এগিয়ে যাই।

এদিনের অমলিন আনন্দে ইলিশ মাছের সাথে পান্তাভাত, পাশে মরিচ, পেঁয়াজ আর নুনের স্বাদ—এই খাবারের মধ্যে রয়েছে এক অমোঘ সম্পর্ক। স্নিগ্ধতার এক স্বরূপ, যা কেবল বাংলার মাটিতেই সম্ভব। চিরকালীন এই ঐতিহ্য, যেখানে বছরের শুরুতে হালখাতা আর মিষ্টির আদান-প্রদান, এক নিঃশব্দ চুক্তি—একটি নতুন বছরে ব্যবসা, সম্পর্ক, জীবন—সব কিছুই নতুন করে শুরু হতে থাকে।

এবারের পহেলা বৈশাখে, পুরনো বছরের সেই সমস্ত অশুভ প্রতিচ্ছবি, ধান্দাবাজি, চাঁদাবাজি—সবকিছু দূর হয়ে যাবে। নববর্ষের এই দিনটি যেন এক নতুন দিগন্তের সূচনা, যেখানে আমরা শুধুমাত্র নতুন কিছু পাওয়ার স্বপ্ন দেখি না, বরং সেই পুরনো দিনের অশান্তি ও কষ্ট থেকে মুক্তির জন্য, একটি সুন্দর, সজীব এবং পবিত্র জীবনের দিকে অগ্রসর হতে চাই।

প্রকৃতি ও সংস্কৃতি, একে অপরের পরিপূরক। বাংলা নববর্ষ, পহেলা বৈশাখ, এই দিনটি শুধুমাত্র আমাদের ক্যালেন্ডারের একটি নতুন পৃষ্ঠা নয়, বরং এটি আমাদের চারপাশের প্রকৃতির এক অনবদ্য রূপ। বৈশাখের প্রথম দিনে আকাশের কোণে মেঘের গম্ভীরতা, যেন সে জানাচ্ছে নতুন বছর আসছে, নতুন আশা, নতুন উল্লাস। ঝড়ো হাওয়ার মধ্যে বৈশাখী বৃষ্টি এসে প্রকৃতির গা ভিজিয়ে দেয়, যেমন আমাদের হৃদয়ের গভীরে বয়ে আনে এক নতুন আনন্দের তরঙ্গ। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে মিষ্টি গন্ধ—কলমি শাক, পাটুলি ফুল, পলাশের রঙে মোড়া নববর্ষের ফুল। এই দিনটি যেন প্রকৃতির নিজস্ব এক শ্রদ্ধাঞ্জলি, যে ফুলগুলো শোভা পায় আমাদের ছোট-বড়, শহর-বাংলাদেশের প্রতিটি কোণায়।

গ্রামের পলিতে কিংবা শহরের কোন পার্কে, পহেলা বৈশাখের এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেন বাড়িয়ে দেয় আনন্দের অনুভূতি। পুরনো বাংলার গ্রামের প্রান্তরে পাকা ফসলের সুবাস, সেই প্রাচীন ঝিলগুলোর শান্ত জল, খালি মাঠে এক অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য—এগুলি শুধু চোখে নয়, আমাদের মনে প্রতিধ্বনিত হয়, যেন পহেলা বৈশাখের প্রতিটি মুহূর্ত প্রকৃতি নিজ হাতে আমাদের জন্য সাজিয়ে রেখেছে।

এই দিনটি শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক উদযাপন নয়, এটি প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কেরও একটি বিশেষ রূপ, যা আমাদের শিকড়ের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। সারা দেশের মানুষের আনন্দে মেতে ওঠা, গ্রামীণ পরিবেশে গুচ্ছগুচ্ছ পটল, কাঁচা কলা, কচুরিপানা—এই সব প্রকৃতির উপাদান, একে অপরকে সহযোগিতা করে নতুন বছরের দারুণ সূচনা করতে। বৈশাখী বাতাস, মাটির গন্ধ এবং নতুন জীবনের এক সতেজ শ্বাস—এই উপাদানগুলো একত্রিত হয়ে পহেলা বৈশাখের উদযাপনকে শুধু একটি দিন নয়, বরং এটি যেন একটি নয়া দিগন্তের সূচনা, যেখানে প্রকৃতি এবং সংস্কৃতি হাতে হাত রেখে একত্রে উদযাপন করে।

পহেলা বৈশাখের দিনটি যেন এক সুন্দর গল্প, যার প্রতিটি দৃশ্য জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। ভোর বেলা, যখন প্রথম সূর্য ওঠে, রাস্তায় রাস্তায় মানুষের পদচারণা শুরু হয়। শহরের বাজারে, ফুলের দোকানে ভিড় জমে যায়—প্রতিটি দোকানে সাজানো থাকে নানা রঙের ফুল। গোলাপের লাল, গাঁদার হলুদ, শাপলার সাদা, আর পলাশের তীব্র কমলা রঙের ফুলের গুচ্ছ, যেন প্রকৃতির নিজস্ব শুভেচ্ছা। সেখানে একেকটি ছোট গল্প প্রতিধ্বনিত হয়, এক বিক্রেতা তার দোকানে সাজানো ফুলগুলো তুলে তুলে বিক্রি করছে, আর এক বৃদ্ধা আনন্দের সাথে একটি ছোট পুতুলের ফুল কেনে, যেন পুরনো দিনের রঙিন স্মৃতি ফিরে পাচ্ছে।

গ্রামের সরু পথে, হালকা রোদে, লাল-সাদা শাড়ি পরা মেয়েরা চমক দিয়ে হেঁটে যায়, তাদের গায়ে ফুলের মালা, হাতে সজাগ চুড়ি, মুখে হাসি—পহেলা বৈশাখের আনন্দের প্রতীক। ছোট ছেলে-মেয়ে, তারা ঝরে পড়া পাতা ও ফুলের সঙ্গে খেলছে, মুখে মিষ্টি খাবারের খুশি হাসি, যেন পুরো গ্রামটি এক নতুন রঙে রাঙানো। পথে, গ্রামের পুকুরে নৌকায় চড়ে মাঝির গান শুনতে পাওয়া যায়, সেই গান যা বাঙালি ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, একটি দৃশ্য যা শুধু বাঙালির কাছে নয়, সারা বিশ্বে নস্টালজিয়া তৈরি করে।

আর শহরের বড় পার্ক, রমনা বটতলায়, যেখানে হাজার হাজার মানুষের ভিড়। উজ্জ্বল রঙের পাঞ্জাবি ও শাড়ি পরিহিত মানুষ একসঙ্গে দাঁড়িয়ে সুর মেলাচ্ছে, সবাই যেন একসাথে গাইছে—“এসো হে বৈশাখ এসো এসো…”। এ যেন এক উত্সব, এক সমবেত সঙ্গীত, যেখানে সবার হৃদয় এক সঙ্গে মিলছে। বটগাছের নিচে, পুরনো দারুণ ঐতিহ্যের গুনগুন, আর চিরন্তন প্রাকৃতিক সুরের মাঝে, পহেলা বৈশাখকে অভ্যর্থনা জানাতে সবাই মিলিত।

এটি একটি মুহূর্ত, যেখানে অতীত ও বর্তমান একসাথে মিশে যায়, যেখানে প্রতিটি সুর, প্রতিটি ফুল, প্রতিটি হাসি এক নতুন কাহিনী রচনা করে—পহেলা বৈশাখের দিনটি, যা আমাদের জীবনে সেই সোনালী দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়, যখন আমরা একে অপরকে আরও ভালোভাবে জানতাম, ভালোবাসতাম।

পৃথিবীর নানা প্রান্তে নতুন বছর উদযাপন হয়, তবে বাংলা নববর্ষের প্রতি যে অনন্য ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা, তা পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের থেকে একেবারেই আলাদা। যেমন, ইংরেজি নববর্ষ ১ জানুয়ারিতে আসে, এবং পশ্চিমা দেশগুলোতে এটি এক আড়ম্বরপূর্ণ পার্টির মাধ্যমে পালিত হয়। রাতের বেলা, আতশবাজি, মিউজিক এবং জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে মেতে ওঠে মানুষ। তবে বাংলা নববর্ষের উৎসবটি শুধুমাত্র একটি রাতের অনুষ্ঠান নয়, এটি একটি পুরো দিনের, পুরো সমাজের একটি অনন্য ঐতিহ্য। এখানে দিন শুরু হয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে, যেখানে সূর্যোদয়ের সাথে এক অনাবিল শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

ভারতেও নানা অঞ্চলে নববর্ষ উদযাপন করা হয়, যেমন বাংলা নববর্ষ, পাঞ্জাবের বৈশাখি, এবং গুজরাটের উত্তরায়ণ। যদিও এগুলোর মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে—ফসল কাটার সময়, কৃষকের জীবনের শুরু—তবে প্রতিটি অঞ্চলের নববর্ষের রীতি, সংস্কৃতি এবং আচার-অনুষ্ঠান আলাদা। বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখ, বিশেষ করে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে, মিষ্টি গন্ধে ভরা গাছে গাছে রঙিন ফুল আর পরিবেশের মধ্যে অন্যরকম এক অনুভূতি তৈরি হয়, যা আর কোথাও পাওয়া যায় না।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নববর্ষ উদযাপন হয় ভিন্নভাবে। যেমন চীনা নববর্ষে থাকে লাল রঙের উত্সব, যা পৃথিবীজুড়ে প্রাচীন ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে পরিচিত, যেখানে বিশেষ খাবার, সাংস্কৃতিক নৃত্য ও ড্রাগন র‍্যালি থাকে। আর জাপানি নববর্ষে, বরফাচ্ছন্ন পর্বতমালা এবং সাদা প্রাকৃতিক দৃশ্যে পালিত হয় উৎসব, যেখানে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে এসব সবার মধ্যে একটি সাধারণ মিল রয়েছে—নতুন বছরের সূচনায় পুরনো সব পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা ও আশা।
বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো এর মানুষের মাঝে একাত্মতা তৈরি করা। এখানে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়ের মানুষ একত্রিত হয়ে নৃত্য, সঙ্গীত এবং ঐতিহ্যবাহী খাবারের মাধ্যমে দিনটি উদযাপন করে, যা বাংলাদেশের এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্য। এই দিনটি শুধু একটি কালেন্ডারীয় পরিবর্তন নয়, বরং আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং শিকড়ের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন। এটা যেন মানুষের মনের মধ্যে এক নতুন প্রেরণা দেয়, যেখানে সবাই মিলে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক বিরোধ ভুলে এক হয়ে জীবন উদযাপন করে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশে, যেমন সুইডেন, নেদারল্যান্ডস কিংবা স্পেনে, নববর্ষ উদযাপন হয় অঙ্গীকার, আশাবাদ এবং বন্ধুত্বের ভিত্তিতে। তবে পহেলা বৈশাখের বৈশিষ্ট্য হলো, এর মধ্যে যে উন্মুক্ততা, ঐক্য ও সামাজিক যোগাযোগ রয়েছে, তা যেন এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করে, যেখানে জাতিগত ঐতিহ্যকে সম্মান জানিয়ে, সবাই একসঙ্গে উদযাপন করে।

বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখের উদযাপন, তাই শুধু একটি জাতির নববর্ষ উদযাপন নয়, এটি একটি বৈশ্বিক উত্সবের অংশ, যা আমাদের সংস্কৃতির গুরুত্ব, শান্তি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করে। এটি একটি দৃঢ় আহ্বান—বিশ্বের প্রতি যে, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং মানুষের শিকড়কে সম্মান জানিয়ে, আমরা যেন নিজেদের বিশ্বাসে অটুট থেকে, সবধরনের বিভেদ ও বৈষম্য ভুলে মানবতা, ভালোবাসা ও একাত্মতায় বিশ্বাস রাখি।

পহেলা বৈশাখের দিনটি যেন এক অমূল্য স্মৃতি, যা হৃদয়ে চিরকাল রয়ে যায়। ছোটবেলায়, আমার গ্রামের পথে পহেলা বৈশাখের আনন্দ ছিল এক অপূর্ব দৃশ্য। দুপুর বেলা, পান্তা-ইলিশ আর পেঁয়াজ, চিঁড়া-দইয়ের এক অপূর্ব পর্বে বসে, আমার সঙ্গীরা একে অপরকে জানাতো বছরের শুভেচ্ছা। তবে সবচেয়ে স্মরণীয় ছিল, পহেলা বৈশাখের দিনটিতে রমনার বটতলায় যাওয়া। একসঙ্গে গানের তালে তালে নাচ, গল্প বলা—যেখানে শুধু ঐতিহ্যই নয়, সেখানে ছিল একাত্মতা, ভালোবাসা আর বিশ্বাসের শক্তি। আমি যেন তখন উপলব্ধি করতাম, পহেলা বৈশাখ শুধু একটি নতুন বছরের সূচনা নয়, বরং একটি নতুন জীবনের সূচনা, যেখানে আশা ও সম্ভাবনার আলো জ্বলতে থাকে।

তখনকার সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে, মনে হয়—আজও যদি সেই ঐতিহ্যকে অটুট রাখতে পারতাম, যদি সেদিনের মতোই আমরা সবাই এক হয়ে নতুন বছরের শুরুটা উদ্যাপন করতে পারতাম, তবে হয়তো আমাদের সমাজের সবার মধ্যে সত্যিকার অর্থে ঐক্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা হত। এই স্মৃতিগুলো যেন এখনো মনকে উজ্জীবিত করে—যতই সময় এগিয়ে যাক, পহেলা বৈশাখের সেই স্নিগ্ধ রোদ, সেই পান্তা-ইলিশ, সেই গানের সুর—সব কিছু মনে হয়, কখনো মুছে যাবে না, বরং প্রতিটি পহেলা বৈশাখের সঙ্গে নতুন করে জীবন্ত হয়ে উঠবে।

পহেলা বৈশাখ (১৪ এপ্রিল) সারা বিশ্বের বাঙালিদের জন্য এটি শুধু একটি দিন নয়, এটি আমাদের জীবনের এক নতুন যাত্রা, যেখানে আশা, ভালবাসা, পরিবর্তন ও ভবিষ্যতের প্রতি আস্থা থাকুক। এখানে ধর্ম, জাতি কিংবা বিশ্বাসের কোনো ব্যাপার নেই—এটা শুধু জাতিগত পরিচয়ের উদযাপন।

আমরা যেন ভুলে না যাই, আমাদের সংস্কৃতি এবং বিশ্বাসকে সম্মান করতে হবে এবং কোনো কিছুই আমাদের জাতিগত পরিচয়ের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে না। তাই আসুন, আমরা যেন বিশ্বে এক শক্তিশালী, উদার জাতি হয়ে উঠি। দূর হোক কুসংস্কার, জয় হোক মানবতার, গড়ে উঠুক বাঙালির ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি।

এবারের পহেলা বৈশাখ হতে পারে ভবিষ্যৎ নির্মাণের চাবিকাঠি, যা সবার জন্য ভালোবাসা, শান্তি এবং সমৃদ্ধি বয়ে আনবে। সবাইকে বাংলা নববর্ষের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা এবং ভালোবাসা।

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
Rahman.Mridha@gmail.com

শেয়ার করুন:-
শেয়ার