ক্যাটাগরি: অর্থনীতি

এলডিসি উত্তরণে আরও ২-৩ বছর সময় প্রয়োজন: ডিসিসিআই

বিদ্যমান বৈশ্বিক ও স্থানীয় অর্থনৈতিক বাস্তবতা, শিল্পখাতে জ্বালানি সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও পণ্য আমদানিতে উচ্চ শুল্ক, উচ্চ সুদহার ও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের স্বল্পতা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে দেশের ব্যবসায়ীরা প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করছেন। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ কমপক্ষে ২-৩ বছর পিছিয়ে নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ।

সোমবার (১০ মার্চ) ডিসিসিআই এবং সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সাপোর্ট টু সাসটেইন্যাবল গ্রাজুয়েশন প্রজেক্ট (এসএসজিপি) যৌথভাবে ‘এলডিসি উত্তরণে মসৃণ রূপান্তর কৌশল (এসটিএস) বাস্তবায়ন’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় তিনি এই কথা বলেন।

এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইআরডি-এর সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী এবং বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান।

বেসরকারি খাতের পক্ষে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডিসিসিআই সভাপতি তাসকীন আহমেদ।

তিনি বলেন, ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণের তারিখ নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অস্থিরতা, শিল্পখাতে জ্বালানি সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও পণ্য আমদানিতে উচ্চ শুল্ক, উচ্চ সুদহার ও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের স্বল্পতা ইত্যাদি নানা কারণে আমাদের বেসরকারি খাত প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ কমপক্ষে ২-৩ বছর পিছিয়ে নেওয়া প্রয়োজন।

তিনি জানান, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ১ দশমিক ৮ শতাংশ, যেখানে উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণে ৫টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ‘মসৃণ রূপান্তর কৌশল (এসটিএস)’ প্রণয়ন করা হয়েছে এবং এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ফ্রেমওয়ার্কের বাস্তবায়ন, শক্তিশালী নেতৃত্ব ও অঙ্গীকার, অংশীদারত্ব ও সহমর্মিতা, নীতির সমন্বয়, অর্থায়ন নিশ্চিতকরণে কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তাবয়ন এবং সর্বোপরি পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন একান্ত অপরিহার্য।

এর পাশাপাশি বিশেষ করে এসএমই খাতে দক্ষতা উন্নয়ন ও সিঙ্গেল ডিজিটে দীর্ঘমেয়াদে ঋণ প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের রপ্তানি সম্প্রসারণে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর, সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণে অবকাঠামো উন্নয়ন, রাজস্বসহ সংশ্লিষ্ট নীতিমালার সংষ্কারের ওপর তিনি জোরা দেন।

এছাড়াও তিনি তৈরি পোশাক খাতের বাইরে রপ্তানির সম্ভাবনাময় অন্যান্য খাত যেমন: ওষুধ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, সেমিকন্ডাক্টর, হালকা-প্রকৌশল এবং তথ্য-প্রযুক্তি খাতে রপ্তানি বাড়াতে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন এবং বাস্তাবায়নের আহ্বান জানান।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ইআরডি সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী বলেন, এলডিসি পরবর্তী সময়ে বাণিজ্য সুবিধা চলে যাওয়ার প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের সব স্তরে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের প্রয়োজন নির্ধারণ ও সমাধানের লক্ষ্যে বাণিজ্য সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কমিটি প্রণয়ন করা হবে।

তিনি উল্লেখ করেন, স্থানীয়ভাবে পণ্য উৎপাদনে ব্যয় বাড়ার কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। তবে চলতি হিসাব এবং আর্থিক হিসাবের বর্তমান অবস্থার বেশ উন্নতি হওয়ায় এক্ষেত্রে আশার সঞ্চার হচ্ছে। তথ্যগত বিভ্রান্তি ও ব্যবধান দূর করতে সরকারকে ইউএনএসক্যাপ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন কারিগরি সহায়তা করবে।

ইআরডি সচিব জানান, সরকারের সব স্তরের কার্যক্রম ডিজিটাল সেবার আওতায় নিয়ে আসতে দক্ষিণ কোরিয়া আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, এলডিসি গ্রাজুয়েশনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শুরু থেকেই যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ঘাটতি ছিল। তবে বেসরকারি খাতের মতামতের ভিত্তিতে কতটুকু টেকসই উপায়ে এলডিসি উত্তরণ প্রক্রিয়াকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া যাবে, তার দিকে বেশি আলোকপাত করতে হবে।

তিনি তৈরি পোষাক খাতের পণ্যের বহুমুখীকরণের পাশাপাশি প্যাকেজিং খাতের উন্নয়নে মনোযোগী হওয়ার জন্য বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিদের আহ্বান জানান।

স্বাগত বক্তব্যে ইআরডির অতিরিক্ত সচিব ও এসএসজিপির প্রকল্প পরিচালক এ এইচ এম জাহাঙ্গীর বলেন, এলডিসি পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে আমাদের বেসরকারি খাত। এই অবস্থায় বেসরকারি খাতের সহায়তার পাশাপাশি এলডিসি উত্তরণে সার্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রণীত এসটিএস বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সমন্বিত কার্যক্রম একান্ত অপরিহার্য।

এলডিসির স্মুথ ট্রানজিশন স্ট্রাটেজি বিষয়ে এসএসজিপির কম্পোনেন্ট ম্যানেজার ড. মোস্তফা আবিদ খান বলেন, আমাদের মোট রপ্তানির প্রায় ৭৩ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে থাকে। যা এলডিসি পরবর্তী সময়ে আমরা গ্রহণ করতে পারব না। তাছাড়া বেশ কিছু প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা থেকেও আমরা বঞ্চিত হব।

সেই সঙ্গে রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীতার স্বল্পতাও আমাদের জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ এবং এর আশু পরিবর্তন আবশ্যক বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। স্থানীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগ সম্প্রসারণের পাশাপাশি তিনি মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সরকারি-বেসরকারি খাতের সমন্বয় বাড়ানোর ওপর জোরারোপ করেন।

অনুষ্ঠানের নির্ধারিত আলোচনায় এসএসজিপির কম্পোনেন্ট ম্যানেজার ড. মো. রেজাউল বাসার সিদ্দিকী, ঢাকা চেম্বারের প্রাক্তন সভাপতি ও ইটিবিএল হোল্ডিংস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিজওয়ান রাহমান, আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ও ডিসিসিআইয়ের প্রাক্তন পরিচালক মনোয়ার হোসেন, বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, বিজিএমইএর প্রাক্তন পরিচালক আসিফ আশরাফ এবং সোনালী আঁশ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান পাটোয়ারী অংশ নেন।

এসএসজিপির কম্পোনেন্ট ম্যানেজার ড. মো. রেজাউল বাসার সিদ্দিকী বলেন, এসটিএস বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব। এলডিসি উত্তোরণের সব সূচকে আমরা এখনো বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছি।

তিনি জানান, এসটিএস-এর অ্যাকশন ম্যাট্রিক্স বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের জন্য মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন ফ্রেমওয়ার্ক প্রণয়নের কাজ চলছে। তিনি অ্যাকশন ম্যাট্রিক্স বাস্তবায়নে বেসরকারি খাতের সহযোগিতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণের ওপর জোরারোপ করেন।

ঢাকা চেম্বারের প্রাক্তন সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, যতক্ষণ না পর্যন্ত সিএমএসএমই থেকে ‘মধ্যম’ কে আলাদা করা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কুটির ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা প্রকৃত নীতি সহায়তার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন।

এসএমই ডেটাবেইজ প্রণয়নে বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করার ওপর তিনি জোরারোপ করেন। দেশের ব্যবসায়ীরা এলডিসি গ্রাজুয়েশনের জন্য এখনও প্রস্তুত নয় উল্লেখ করে সরকারকে এ ব্যাপারে বেসরকারি খাতের সঙ্গে আলোচনাপূর্বক সিদ্ধান্ত নিতেও জোর দেন তিনি।

আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন বলেন, অবকাঠামো খাতে আমরা বেশ পিছিয়ে রয়েছি। এছাড়াও ইস্পাত ও সিমেন্ট শিল্প-কারখানায় প্রয়োজনীয় গ্যাসের অভাবে উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে সমগ্র অর্থনীতিতে। এলডিসি গ্রাজুয়েশন সম্পর্কে তিনি বলেন, যতক্ষণ না পর্যন্ত দেশের আমদানির চাইতে রপ্তানি বেশি হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা এর জন্য প্রস্তুত নই।

বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ২০২২ সাল থেকে আমরা অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে নিম্নমুখী প্রবণতা লক্ষ্য করছি। এর সঙ্গে রয়েছে রপ্তানি আয়ের তথ্য বিভ্রান্তি। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশ কিছু নীতি আমাদের রপ্তানি খাতের বিরুদ্ধে গিয়েছে। সেই সঙ্গে ইডিএফ ফান্ডসহ আরও কিছু তহবিল সহায়তা বন্ধ করা হয়েছে এবং ঋণের উচ্চ সুদহার এ অবস্থাকে আরও অসহনীয় করে তুলছে।

বিজিএমইএর প্রাক্তন পরিচালক আসিফ আশরাফ বলেন, এ মুহুর্তে আমরা এলডিসি গ্রাজুয়েশনের জন্য প্রস্তুত নই।

তিনি জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে এখন থেকেই উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান।

সোনালী আঁশ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, পাট খাতে বহুমুখীকরণের জন্য সরকারের প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা একান্ত প্রয়োজন।

ডিসিসিআইয়ের ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি রাজিব এইচ চৌধুরী, সহ-সভাপতি মো. সালিম সোলায়মানসহ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা এবং সরকারি-বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা এই অনুষ্ঠানে অংশ নেন।

শেয়ার করুন:-
শেয়ার