আমানতকারীদের আস্থা হারালে চলবে না। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে প্রত্যেক আমানতকারীটাকা ফেরত পাবেন। ধৈর্য ধরতে হবে। কিন্তু তার আর প্রয়োজন হবে না। ইতোমধ্যেই ব্যাংক খাত স্থিতিশীল হতে শুরু করেছে। দুর্বল ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।
আজ শনিবার রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের (আইইউবি) ২৫তম সমাবর্তন অনুষ্ঠনে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘তোমরাই আগামী দিনের ব্যাংকার। তোমাদের মধ্য থেকেই দেশের মানুষের আমানতের রক্ষক (কাস্টোডিয়ান) তৈরি হবে। তবে সবসময় সততা, নিষ্ঠা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, তোমরা এখন কর্মজীবনে প্রবেশ করবে। আগামীতে তোমরাই জাতির উন্নয়নে অবদান রাখবে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতিতে নেতৃত্ব দেবে।
যে পেশাতেই যাও না কেন সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করবে। কর্মজীবনে দুই ধরনের পথই খোলা থাকে। চাইলে অসৎ হওয়া যায়, আবার সৎ পথেও থাকা যায়। পছন্দ তোমার। তবে পথ হারালে তুমি তোমার পরিবার ও সমাজসহ পুরো দেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। যেমন এখন আমরা একটি চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান গভর্নর।
তিনি বলেন, আমরা এখন অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার কারণ ব্যাংক খাতের দুর্নীতি। ব্যাংক খাতের বর্তমান নাজুক পরিস্থিতির দায় কোনো ব্যাংকার এড়াতে পারেন না। তাদের জন্যই আজ ব্যাংক খাতের বেহাল দশা। এখন প্রয়োজন শুধু একতা। সবাই মিলে একতাবদ্ধ হতে পারলেই আমরা দেশটাকে আবার ঢেলে সাজাতে পারবো।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমানতকারীদের আস্থা হারালে চলবে না। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে প্রত্যেক আমানতকারীটাকা ফেরত পাবেন। ধৈর্য ধরতে হবে। কিন্তু তার আর প্রয়োজন হবে না। ইতোমধ্যেই ব্যাংক খাত স্থিতিশীল হতে শুরু করেছে। দুর্বল ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। বিদেশি মুদ্রার বাজারও স্থিতিশীল। বাংলাদেশ ব্যাংকের চলতি হিসাব এখন উদ্বৃত্ত। সুতরাং এখন ভয়ের আর কোনো কারণ নেই।
উল্লেখ্য, পতিত আওয়ামী সরকারের আমলে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ মাত্র ২২ হাজার কোটি টাকা থেকে ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকাতে উন্নীত হয়েছে। সিংহভাগ ব্যাংকের মালিকানা চলে যায় আওয়ামী রাজনৈতিক সুবিধাভোগীদের কব্জায়। নামে-বেনামে বের হয়ে যায় বিপুল অঙ্কের ঋণ। দেশ থেকে পাচার হয় ২৪০ বিলিয়ন ডলার। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন থেকে ১৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। যদিও সেটা এখন বেড়ে ২০ বিলিয়নে অবস্থান করছে। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে এসব চিত্র বেরিয়ে আসলে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে শুরু করেছিল আমানতকারীরা। এখনও সেই চাপ সামাল দিয়ে উঠতে পারেনি ব্যাংকগুলো। অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যাংক খাতের যে ক্ষতি হয়েছে তার দিকে ইঙ্গিত দিয়ে গভর্নর বলেন, ব্যাংকের ব্যর্থতা বা বর্তমান নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার দায় কোনো ব্যাংকার এড়াতে পারে না।
গভর্নর বলেন, আমরা একটা বড় ধাক্কা সামাল দিয়েছি। সরকার গঠনের শুরুতে বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি, মূল্যস্ফীতি, ভাঙাচুরা ব্যাংকিং খাত ও দুর্বল অর্থনীতি নিয়ে যাত্রা শুরু করেছি। কিন্তু ইতোমধ্যেই চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত দেখা দিয়েছে। চলতি হিসাব ও আর্থিক হিসাব-দুটিই এখন উদ্বৃত্ত। লেনদেনের ভারসাম্যও শক্তিশালী। বিদেশি মুদ্রারও বাজার স্থিতিশিল। রিজার্ভ ভালো, প্রবাসী আয়ও (রেমিট্যান্স) ভালো। এজন্য আমি বিদেশে থাকা আমাদের বাংলাদেশি ভাইদের ধন্যবাদ জানাতে চাই। যারা কঠোর পরিশ্রম করে দেশে রেমিট্যান্স পাঠান।
তিনি বলেন, ব্যাংক খাত সংস্কারে একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেসব কাজ এখনও চলমান। এর ফলে ইতিবাচক ফল আসা শুরু করেছে। জানুয়ারিতে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কের ঘরে নেমে এসেছে। আশা করি এ বছরের জুনের মধ্যে দেশের মূল্যস্ফীতি ৭ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে নেমে আসবে। তবে আগামী বছরে (২০২৬) মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের নিচে নিয়ে আনা সম্ভব।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংক খাতকে সিস্টেমেটিক্যালি নষ্ট করা হয়েছে। সেই সিস্টেমকে ঠিক করার জন্য বার বার নীতি সুদহার বাড়াতে হয়েছে। আমিও চায় ঋণের সুদহার ৭ থেকে ৮ শতাংশে নেমে আসুক। এজন্য আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
আইইউবি-র দেওয়া তথ্যমতে, বিশ্ববিদ্যালয়টির ২৫তম সমাবর্তনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের এক হাজার ৯৬৯ জন শিক্ষার্থীকে সনদ প্রদান করা হয়েছে। সনদপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক হাজার ৫৫০ জন স্নাতক ও ৪১৯ জন স্নাতকোত্তর পর্যায়ের। কৃতিত্বপূর্ণ ফল অর্জনকারী দুই স্নাতক শিক্ষার্থীকে চ্যান্সেলর্স গোল্ড মেডেল প্রদান করা হয়।
রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের প্রতিনিধি হিসেবে অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব এবং সনদ প্রদান করেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ড. এম আমিনুল ইসলাম। বিশেষ অতিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. মো. সাইদুর রহমান, আইইউবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান দিদার এ হোসেইন এডুকেশন, সায়েন্স, টেকনোলজি অ্যান্ড কালচারাল ডেভেলপমেন্ট ট্রাস্ট (ইএসটিসিডিটি)-এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জাকারিয়া খান উপাচার্য অধ্যাপক ম. তামিম প্রমুখ। আরও উপস্থিত ছিলেন আইইউবির কোষাধ্যক্ষ খন্দকার মো. ইফতেখার হায়দার, রেজিস্ট্রার মো. আনোয়ারুল ইসলামসহ আরও অনেকে।