ক্যাটাগরি: আন্তর্জাতিক

শেখ হাসিনা দালাই লামা নন, ভারতের উচিত তাকে সমর্থন বন্ধ করা: দ্য প্রিন্ট

গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার ১৮০তম দিনেই সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইভে ভাষণ দেওয়ার ঘোষণা দেন শেখ হাসিনা। তার এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশিদের একটি বড় অংশের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে— অনেকেই ভাবতে শুরু করেন তার দল আওয়ামী লীগ হয়তো প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা করছে। শুরুতে যা ছিল শেখ হাসিনার একটি সাধারণ ফেসবুক পোস্ট, বাংলাদেশের হাজার হাজার তরুণরা তা কার্যত লুফে নেয়। সেইসঙ্গে ঢাকার কেন্দ্রে প্রতিবাদীদের একটি বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

শেখ হাসিনা যতক্ষণে তার বক্তৃতা শুরু করেন, ধানমন্ডি ৩২-এর ঐতিহাসিক ভবনটির সামনে আনা হয় কয়েকটি বুলডোজার, ততক্ষণে আগুনে জ্বলছিল ভবনটি। ঐতিহাসিক এই বাড়িতেই শেখ হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের মুকুটহীন রাজা হিসেবে তার শেষ দিনগুলো কাটিয়েছিলেন। হলুদ বুলডোজারের বড় ধাতব ব্লেডগুলো ভবনের একের পর এক অংশ গুঁড়িয়ে দিতে শুরু করে। এই ভবন থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।

ঘটনাটি অনেককে, এমনকি বাংলাদেশের এস্টাবলিস্টমেন্ট সদস্যদেরও বিস্মিত করেছে। প্রায় ৪০ জন সেনা সদস্য রাস্তার মুখে গিয়ে ওই বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তারা বিক্ষোভকারীদের ক্ষোভের মুখে সেখান থেকে সরে যান।

পরদিন সূর্যোদয়ের সময় বাংলাদেশ যখন জেগে ওঠে তখন তার ল্যান্ডস্কেপে পরিবর্তন ঘটে গেছে— বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যা করতে পারেনি, তা ওই রাতের ৯ ঘণ্টায় ঘটেছিল। ৩২ নম্বর রোডের ভবনটিতে ইট ও ছাই- ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

কিন্তু ভুল বুঝবেন না। এরা বিক্ষুব্ধ জনতা বা ধর্মান্ধরা নয় যারা ইতিহাসকে নতুন করে লেখার চেষ্টা করছে বা বাংলাদেশকে ১৯৭১ সালের আগের দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে যখন দেশটি পাকিস্তানের অংশ ছিল। বাড়িটি ভাঙার সাথে সাথে যারা হাততালি, উল্লাস ও সেলফি তুলছিলেন তাদের মধ্যে দেশের ইংরেজি-শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এবং শহুরে মানুষও দাঁড়িয়েছিলেন।
দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে হাসিনা ও তার দোসরদের হাতে তাদের ভোটাধিকার হরণ হতে দেখেছে তারা। বিক্ষোভেকারীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যারা হাসিনার শাসনামলে একের পর এক কারচুপির নির্বাচনের কারণে তাদের জীবনে কখনো ভোটই দিতে পারেননি।

অবশ্য ভোটে কারচুপি করলেও মানুষের সমর্থন পেতে হাসিনা তার বাবার উত্তরাধিকার এবং দেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর অনেক বেশি নির্ভর করেছেন। এই কাজটা তিনি এতটাই করেছেন যে- সাধারণ বাংলাদেশিরা মুজিবকে হাসিনা থেকে আলাদা ভাবতে পারেননি। উভয়ই দুঃখজনকভাবে একে অন্যের সাথে মিলে গিয়েছেন। হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে এখন ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। এই আবহে ভারত এখন পররাষ্ট্রনীতির জালে আটকে পড়েছে। ঢাকায় এখন আবেগ তুঙ্গে।

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ব্রিটিশ-বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ এহতেশাম হক বলেছেন, লাখ লাখ ভুক্তভোগী মানুষ তাদের নিপীড়কের প্রতীককে সম্মান করবে বলে আপনি আশা করেন? যা কিনা ইট-বালি দিয়ে তৈরি একটি বাসা মাত্র- আপনি কি আমাদের কাছ থেকে চুরি করে নেওয়া সম্পদ ফিরিয়ে দিতে পারবেন? আমাদের দেশবাসীর কাছ থেকে নৃশংসভাবে কেড়ে নেওয়া চোখ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফিরিয়ে আনতে পারবেন? আজকে ভেঙে ফেলা প্রতিটি ইট ন্যায়বিচারের প্রতীক, যা নিপীড়ক শাসকের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ দাবি করছে। মুজিবকে গুম, অপশাসন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রতীকে পরিণত করেছেন শেখ হাসিনা। ৩২ নম্বর রোডের বাড়িটি, যাকে একসময় বাংলাদেশিদের গর্বের স্মারক হিসেবে দেখতেন, তা এখন হাসিনা নামের সমার্থক হয়ে উঠেছে।

ভারতের আওয়ামী লীগের সমস্যা

শেখ মুজিবুর রহমান যখন পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির সেন্ট্রাল জেল মিয়ানওয়ালিতে বন্দি ছিলেন তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমেদ। মুজিবকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর তাজউদ্দীন আহমেদসহ মোট চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়। তাজউদ্দীনের বিধবা স্ত্রী ও সোহেল তাজের মা সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন আওয়ামী লীগ পুনর্গঠন করেন এবং ১৯৭৭ সালে দলটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, ৩২ নম্বর রোডের বাড়িটি ধ্বংস হয়ে যাবার একদিন পরও আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য সোহেল তাজ কোনও সমালোচনা করেননি। কারও নাম না করে তিনি তার দলের দুঃখজনক অবস্থার জন্য ১৯৮১ সাল থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকা শেখ হাসিনার ওপরই দোষারোপ করেছেন। তিনি বলেন, কেউ একজন এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে যেখানে দেশের স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দলের সুনামই আজ প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

যতবারই মিডিয়ায় শেখ হাসিনার কর্মকাণ্ডের খবর প্রকাশিত হয় ততবারই তার প্রতি ভারতের নিরবচ্ছিন্ন এবং অটল সমর্থনের প্রশ্নটিও সামনে এসে যায়। কয়েকদিন আগে, শেখ হাসিনা তার দলের সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন- যারা তার বিরোধিতা করেন তাদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন ধরিয়ে দিতে। একটি অডিও ক্লিপে তাকে বলতে শোনা যায়, “তাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিন।”

এটা দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে, শেখ হাসিনা কোনও দালাই লামা নন যে, তিনি বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতকে নৈতিক সংকটে ফেলবেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবেশী ভারতের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন এবং আওয়ামী লীগ হচ্ছে বাংলাদেশে ভারতের একমাত্র মিত্র। কিন্তু শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে পুনর্বাসন করা এককথায় অসম্ভব, বিশেষ করে যখন সারাদেশে তার নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি এখনও জনসাধারণের মনে টাটকা, সতেজ। ৩২ নম্বর রোডে মুজিবের বাড়ি ভাঙা তারই একটি বহিঃপ্রকাশ।

অবশ্য শেখ হাসিনা সেই দুর্ভাগ্যজনক বক্তৃতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তার বিরোধীরা বিশৃঙ্খল অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল- হাসিনার বিরুদ্ধে বিপ্লবের দিকে পরিচালিত আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিতে শুরু করেছিল। কিন্তু, হাস্যকরভাবে, শেখ হাসিনা সফলভাবে তার বিরোধীদের আবার একত্রিত হওয়ার রসদ যুগিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি সক্ষম হয়েছেন। যে মুহূর্তে শেখ হাসিনার ছায়া দিগন্তে আবির্ভূত হয়েছিল, নিজেদের মধ্যে সব মতবিরোধ তারা দ্রুত ভুলে গিয়েছিল। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে (বিএনপি) বেশ অস্বস্তিকর অবস্থানে ফেলেছে। ভারতকে খুশি করতে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে দলটি। ভারতবিরোধী বক্তব্য না দেওয়ার ও ছড়ানোর ব্যাপারেও সতর্ক রয়েছে বিএনপি। কিন্তু দিনশেষে দলটির নেতাদের নির্বাচনের সম্মুখীন হতে হবে- আর তাই বিএনপি কতদিন তার কণ্ঠ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে।

এই মুহূর্তে ভারতকে দেশের তরুণ প্রজন্মের চোখ দিয়ে বাংলাদেশকে দেখতে হবে, যারা বছরের পর বছর ধরে শেখ হাসিনার হাতে নিজেদের মৌলিক মানবিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হতে দেখেছে। হাসিনার হাতে কেবল দুটি অস্ত্র ছিল- তার বাবার উত্তরাধিকার এবং ভারতের সমর্থন। মুজিবের ঐতিহাসিক বাসা ধ্বংসকে এই আলোকে দেখা উচিত এবং বিপুলসংখ্যক জনগণের মধ্যে ভারতের বিরুদ্ধে বিরাজমান ব্যাপক ক্ষোভকে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝা উচিত। নয়া দিল্লিকে অবশ্যই তার গর্ব খর্ব করতে হবে এবং বুঝতে হবে যে, এটি এমন একটি দেশের স্বৈরশাসককে নির্লজ্জভাবে সমর্থন করেছে- যার সাথে রয়েছে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম স্থল সীমান্ত। শুধু প্রয়োজন সাবেক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর মতো বাস্তব বুদ্ধি। এমনকি অতীতে যখন ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল তখনও তিনি বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে নিজের উদ্যোগে তার হাঁটুতে অস্ত্রোপচারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

ট্রাম্পের লেনদেনের জগত

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন বাস্তববাদী মানুষ। তিনি লেনদেনে বিশ্বাসী। যেখানে সর্বোচ্চ দরদাতা যা চায় সেটাই পায়। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত বাংলাদেশ বৈশ্বিক দুই পরাশক্তি চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারত মহাসাগরে কৌশলগতভাবে প্রবেশের জন্য বাংলাদেশের অবস্থানকে প্রাণকেন্দ্রে হিসেবে দেখে চীন। যদি কখনও দক্ষিণ চীন সাগরে নৌ-অবরোধের মুখে পড়তে হয় সে ক্ষেত্রে সমুদ্রপথে যাওয়ার জন্য বার্মা বা বাংলাদেশ অথবা উভয়েরই প্রয়োজন হবে চীনের। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলেও বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। বর্ষা বিপ্লব বাংলাদেশকে উভয় পরাশক্তির সাথে সঠিক দর কষাকষির সুযোগ করে দিয়েছে। যেখানে ভারতের সাউথ ব্লক বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার কল্পনায় অটল বলে মনে হচ্ছে।

এদিকে চীন ঢাকায় নতুন শাসন ব্যবস্থার প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব দেখাচ্ছে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতকে অবশ্যই বাংলাদেশে নতুন বন্ধু তৈরি করতে হবে। সাধারণ বাংলাদেশিদের পাকিস্তানের ছায়ামূর্তি হিসেবে চিত্রিত করা ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্য ভালো হতে পারে এবং পশ্চিমবঙ্গে কিছু ভোট জিততে সাহায্য করতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদী এই কৌশল ক্ষতিকারক হিসেবে প্রতিভাত হবে।

বাংলাদেশের বিষয়ে চীন বরাবরের মতোই বাস্তবতা দেখিয়েছে। তবে ভারতের বাংলাদেশ নীতি ৭৭ বছর বয়সী ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, শেখ হাসিনা দেশের মাটিতে একাধিক হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছেন। ভারতের এই অবাস্তববাদী নীতির প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও উদ্বেগজনক। কারণ চীনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের ওপর নির্ভরশীল ওয়াশিংটন।

সূত্র: দ্য প্রিন্ট

শেয়ার করুন:-
শেয়ার