মনের মতো ইন্টারনেট সেবা পেতে চাইলে

স্পিডের একক নিয়ে জটিলতা
বেশির ভাগ ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান তাদের সংযোগের গতি ‘এমবিপিএস’ এককে লিখে থাকেন। সমস্যা হচ্ছে, তাঁদের লেখা ‘এমবিপিএস’-এর অর্থ প্রতি সেকেন্ডে কত মেগাবিট তথ্য স্থানান্তর হচ্ছে। অনেক ব্যবহারকারীই ‘এমবিপিএস’কে মেগাবাইট প্রতি সেকেন্ড ভেবে থাকেন। দুটি এককের মধ্যে সম্পর্ক, ৮ মেগাবিট সমান ১ মেগাবাইট। অর্থাৎ মেগাবাইটে গতি বের করতে চাইলে ইন্টারনেট সংযোগের গতিকে ৮ দিয়ে ভাগ দিতে হবে।

সংযোগের ধরন
রাজধানী ও মূল শহরগুলোর বেশির ভাগ ইন্টারনেট সেবাদানকারীই অপটিক্যাল ফাইবার দিয়ে সংযোগ দিয়ে থাকেন। তবে যেসব ইন্টারনেট সেবাদানকারী এখনো ল্যান ক্যাবল দিয়ে সংযোগ দিচ্ছেন, তাঁদের সেবা ব্যবহারের সময় লক্ষ রাখতে হবে মানসম্মত তার ব্যবহার হচ্ছে কি না। ল্যান ক্যাবলের ধরন রয়েছে বেশ কয়েকটি।

এর মধ্যে ন্যূনতম ধরা যেতে পারে CAT-5E। যদি সম্ভব হয়, তাইলে CAT-6 ব্যবহার করা উচিত। ল্যান ক্যাবল সময়ের সঙ্গে দূর্বল হয়ে যেতে পারে, তাই প্রতিবছরই সংযোগের তারটি পরীক্ষা করে প্রয়োজনমাফিক পরিবর্তন করতে হবে। ল্যানের গতি দূরত্বের সঙ্গে কমতে থাকে, মূল সংযোগ বক্স যদি বাসা থেকে অনেক বেশি দূরে হয় সে ক্ষেত্রে স্পিডে তারতম্য থাকবেই।
অপটিক্যাল ফাইবারের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে তারটিতে কোনো বড়সড় বাঁক না থাকে, আর কোনো অবস্থাতেই গিট দেওয়া যাবে না। অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগের জন্য বাসায় ONU, ONT, XPON বা GPON নামের একটি ডিভাইস থাকবে, সেটি হতে হবে মানসম্মত। কমদামি ডিভাইসের কারণেও ইন্টারনেট সংযোগে সমস্যা হতে পারে।

সঠিক রাউটার কেনা
ওয়াই-ফাই রাউটার কেনাটা অনভিজ্ঞদের জন্য জটিল প্রক্রিয়া। রাউটার নির্মাতারা চটকদার সব বিজ্ঞাপনী শব্দ ও সংখ্যা ব্যবহার করে ডিভাইসটির প্রকৃত পারফরম্যান্স বুঝতেই দিতে চায় না। রাউটারের পারফরম্যান্স বুঝতে হলে কিছু টার্ম মাথায় রাখতে হবে।

ইন্টারনেটের সঙ্গে রাউটার সংযুক্ত হয় পেছনে থাকা ইথারনেট পোর্টের মাধ্যমে, WAN/LAN নামেও পরিচিত। সর্বোচ্চ কত গতিতে ফাইল আদান-প্রদান বা ইন্টারনেট ব্রাউজ করা যাবে, তা সরাসরি ওয়্যান পোর্টের গতির ওপর নির্ভরশীল। বাজারে থাকা প্রচুর বাজেট রাউটারে ‘৩০০ মেগাবিট’ বা ‘১১৫০ মেগাবিট’ গতি লেখা থাকলেও খুঁটিয়ে দেখলে প্রথমেই চোখে পড়বে ইথারনেট পোর্টের গতি ১০/১০০ মেগাবিট। অর্থাৎ ওয়াই-ফাইয়ের সর্বোচ্চ গতি হয়তো ১১৫০ বা ১২০০ মেগাবিট হতে পারে, কিন্তু ইন্টারনেটের গতি ১০০ মেগাবিট বা ১১.৫ মেগাবাইটের বেশি হবে না। আজকাল প্রচুর ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান দেশের অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক বা BDIX গতি দিচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে ১০০০ মেগাবিট বা ১ গিগাবিট। তাই সম্ভব হলে অবশ্যই গিগাবিট ইথারনেট পোর্টসহ রাউটার কিনতে হবে।

এরপর আসছে ল্যান ক্যাবল। অপটিক্যাল ফাইবারের ONU ডিভাইস থেকে রাউটারের সংযোগ দেওয়ার ক্যাবল যেন অন্তত CAT-5E গিগাবিট গতির হয়, সেটা লক্ষ করতে হবে। যাঁরা রাউটারের সঙ্গে ডেস্কটপ ল্যানের মাধ্যমে সংযুক্ত করে থাকেন তাঁদের সেই ক্যাবলটিও গিগাবিট সমর্থিত কি না সেটা দেখতে হবে। বর্তমানে গিগাবিট সমর্থিত ক্যাবল আর কম গতির ক্যাবলের মূল্য সমান, তাই কম গতির ক্যাবল কেনার কোনো মানে নেই।

বাসার আকৃতি, রাউটার রাখার জায়গা এবং কী পরিমাণ ডিভাইস ব্যবহৃত হবে, সেটাও মাথায় রাখতে হবে। চেষ্টা করতে হবে রাউটারে বাসার মধ্যভাগে রাখতে। আর ২০০০ স্কয়ার ফুট জায়গা কভার করতে পারে এমন রাউটার কিনতে হবে। যদি এক রুমের বাইরে ওয়াই-ফাইয়ের দরকার না হয়, যেমন মেস বা সাবলেট বাসায়, সে ক্ষেত্রে রেঞ্জ অতটা জরুরি নয়। সর্বোচ্চ কতটি ডিভাইস চলবে সেটা হিসাব করে রাউটারের বাজেট করা উচিত। সাধারণত বাজেট রাউটারগুলো ২০টি ডিভাইসের বেশি হলে ভালো স্পিড ধরে রাখতে পারে না। বেশ কিছু প্রযুক্তি যেমন MU-MIMO বা QoS থাকলে স্পিডের স্ট্যাবিলিটি বাড়বে।

গত পাঁচ বছরে বাজারে আসা বেশির ভাগ ডিভাইস ৫ গিগাহার্জ ওয়াই-ফাই সমর্থন করে। ডুয়াল ব্যান্ড রাউটার কেনাই বুদ্ধিমানের কাজ। সাধারণ ২.৪ গিগাহার্জ ওয়াই-ফাইয়ের চেয়ে ৫ গিগাহার্জ ওয়াই-ফাইয়ের রেঞ্জ কম, কিন্তু স্পিড অনেক বেশি। অবশেষে অবশ্যই রাউটারের ওয়াই-ফাই কোন প্রজন্মের সেটা দেখতে হবে। যদি সম্ভব হয় অন্তত ওয়াই-ফাই ৬ সমর্থিত রাউটার কেনা উচিত। বাজেট থাকলে ওয়াই-ফাই ৭ সমর্থিত রাউটারও বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। যেহেতু ওয়াই-ফাই রাউটার বহু বছর একটানা ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তাই চেষ্টা করা উচিত সামর্থ্যের মধ্যে সেরাটা কেনার।

যত দূর সম্ভব ক্যাবল ব্যবহার করুন
ওয়াই-ফাই প্রযুক্তিটি চমৎকার, কিন্তু আজও ইথারনেট তথা ল্যানের চেয়ে নির্ভরযোগ্য নয়। ডেস্কটপ পিসি সব সময়ই ল্যানের মাধ্যমে সংযুক্ত করা উচিত। একাধিক রুমে ইন্টারনেট ব্যবহার করার জন্যও ল্যান ক্যাবল ব্যবহার করা সবচেয়ে সেরা উপায়। ওয়াই-ফাইয়ের সিগন্যালের মান দূরত্বের সঙ্গে দ্রুত কমতে থাকে, বিশেষ করে রাউটার ও ব্যবহারকারীর ডিভাইসের মধ্যে একাধিক ওয়াল থাকলে তার ওপর নির্ভর করাই উচিত নয়।

মেশ রাউটার
বড় এলাকা বা একাধিক তলায় ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্ক প্রয়োজন হলে মেশ রাউটার ব্যবহার করা উচিত। দুটি বা তিনটি রাউটারের প্যাকেজ কিনে সহজেই নেটওয়ার্কের রেঞ্জ বাড়ানো সম্ভব। আজকাল বেশির ভাগ রাউটারই মেশ নেটওয়ার্ক সমর্থন করে, তাই মূল রাউটারটি যদি মেশ রাউটার হয় তাহলে নেটওয়ার্কের পরিধি বাড়াতে পরবর্তী সময়ে সাধারণ রাউটার কিনলেও চলবে।

নেটওয়ার্ক সেটআপে করণীয়
ওয়াই-ফাই চ্যানেলভিত্তিক নেটওয়ার্ক। মাত্র ১১-১৩টি চ্যানেলে সেটি কাজ করে। রাউটার সেটআপ করার সময় আশপাশের ওয়াই-ফাইগুলো কোন চ্যানেলে কাজ করছে সেটা স্ক্যান করে, যে চ্যানেলটি কিছুটা ফাঁকা রয়েছে সেটা সেট করা উচিত। ওয়াউফাই চ্যানেল স্ক্যান করার জন্য অ্যানড্রয়েড ও আইওএসে বেশ কিছু অ্যাপ রয়েছে। এ ছাড়াও ইন্টারনেট সেবাদানকারীর নিজস্ব DNS সার্ভারের ঠিকানা বের করে সেটা বসাতে হবে। এ ছাড়া ইন্টারনেটের গতি কমবেশি হতে পারে, বিশেষ করে ইউটিউব ও ফেসবুকের ক্যাশ সার্ভার গতি সেই ডিএনএস ছাড়া পাওয়া যাবে না।

ওয়েব ব্রাউজিংয়ের অভিজ্ঞতা অতিরিক্ত বিজ্ঞাপনের কারণে ব্যাহত হতে পারে। অবশ্যই সবার অ্যাড ব্লক করার বিবিধ উপায়গুলো ব্যবহার করা উচিত। ওয়াইফাই রাউটার ও ওএনইউ ডিভাইস যাতে অতিরিক্ত গরম না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। ওয়াইফাই নেটওয়ার্কে ব্যবহার করতে হবে শক্তিশালী পাসওয়ার্ড। পাসওয়ার্ড যাতে বেহাত না হয় সেটাও খেয়াল করতে হবে।

শেয়ার করুন:-
শেয়ার