ক্যাটাগরি: মত দ্বিমত

বিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা কেন প্রয়োজন?

বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা বহুমুখী সংকটের মুখোমুখি। সৃজনশীলতার অভাব, দক্ষতার ঘাটতি এবং স্থানীয় চাহিদার প্রতি উদাসীনতা শিক্ষাব্যবস্থার অগ্রগতিকে স্থবির করে দিয়েছে। এই সংকট শুধু শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎকেই নয়, বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়নকেও বাধাগ্রস্ত করছে। একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি দক্ষ, উদ্ভাবনী এবং সমাজের প্রয়োজনমাফিক শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্য বিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের প্রচলিত এককেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে সবার জন্য একই পাঠ্যসূচি ও পরীক্ষার কাঠামো নির্ধারিত, সেখানে শিক্ষার্থীদের বহুমুখী প্রতিভা বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা ও সুযোগ সীমিত। এককেন্দ্রিক ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন, পটভূমি এবং চাহিদাকে অগ্রাহ্য করে ‘সবার জন্য একই জিনিস’ (ওয়ান সাইজ ফিটস অল) ধারণা চাপিয়ে দেয়। ফলে একদিকে শিক্ষার্থীদের ভিন্নতর প্রতিভা ও যোগ্যতার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, অপরদিকে রাষ্ট্র বঞ্চিত হয় জনসংখ্যাকে মানবসম্পদে পরিণত করার সুযোগ থেকে।

বিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা এই সংকটের সমাধানে কার্যকর সমাধান হতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় একটি নির্ধারিত শিক্ষাক্রম কাঠামোর ভিত্তিতে স্থানীয় চাহিদা ও বৈচিত্র্য অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের সক্ষমতা ও আগ্রহের ভিত্তিতে পাঠ্যসূচি এবং উপযোগী শিক্ষণ পদ্ধতি তৈরি করা সম্ভব। উদাহরণ হিসেবে এখানে ইংল্যান্ড ও ফিনল্যান্ডের বিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। বিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্বের নানা দেশে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান, দক্ষতা এবং সৃজনশীলতা বিকাশে বিশেষ সহায়ক হয়ে ওঠেছে। এই ব্যবস্থা পড়ালেখায় শিক্ষার্থীদের নিজস্ব অগ্রগতি ও প্রয়োজন অনুযায়ী শেখার সুযোগ দেয়, যা তাদের প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে সৃজনশীল চিন্তাধারার বিকাশ এবং সমস্যার সমাধান করার দক্ষতাকে উন্নত করে।

বিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার পূর্বের আলোচনায় আমরা এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিকতা, স্থানীয় সমস্যা ও সুযোগ-সুবিধার সাথে সংযোগ এবং সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী চিন্তার বিকাশের ওপর জোর দিয়েছি। শিক্ষার মৌলিক লক্ষ্য হওয়া উচিত প্রতিটি শিক্ষার্থীর শিখনধারা, আগ্রহ এবং প্রাসঙ্গিক বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্য রাখা। বিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিটি বিদ্যালয়, এমনকি প্রতিটি শিক্ষক, তাদের শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী পাঠ্যসূচি ও পাঠদান পদ্ধতি নির্ধারণ করতে সক্ষম হন। এতে শিক্ষার্থীরা তাদের নিজস্ব পড়ালেখার অগ্রগতি ও ক্ষমতা অনুযায়ী শেখার সুযোগ পায় এবং প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়। এককেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের বৈচিত্র্যপূর্ণ শিখনধারা এবং আগ্রহকে উপেক্ষা করে, যা সৃজনশীলতার বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। এর বিপরীতে বিকেন্দ্রিক ব্যবস্থায় প্রতিটি শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত দক্ষতা ও প্রতিভার বিকাশে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়। এটি শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস এবং স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে তোলার পাশাপাশি তাদের ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম করে তোলে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা শুধু পরীক্ষার ফলাফলের জন্য নয়, বরং জীবনের বাস্তব প্রয়োগের জন্য জ্ঞানার্জন করতে পারে, যা একটি জাতির সামগ্রিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত জরুরি।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য একটি বিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার জন্য খুবই উপযোগী ও অত্যাবশ্যক। কারণ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিদ্যমান সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যার প্রকৃতি ও চাহিদার ধরন আলাদা। যেমন চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের জীবনযাত্রা, জীবিকা ও পরিবেশের চাহিদা সিলেটের চা বাগান বা পটুয়াখালীর উপকূলীয় এলাকার শিক্ষার্থীদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনার ওপর ভিত্তি করে পাঠ্যসূচি তৈরি করা যেতে পারে, যা সেখানে জীবনযাত্রা, জীবিকা এবং পরিবেশ রক্ষায় সহায়ক হবে। তেমনি সিলেটের চা বাগানের শ্রমজীবী পরিবারগুলোর জন্য কৃষিভিত্তিক কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা তাদের জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে।

একইভাবে উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত শিক্ষা বাস্তবিক চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে। বিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে এসব এলাকার স্থানীয় সমস্যা এবং শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষাসূচি সাজানো সম্ভব। এই ধরনের ব্যবস্থা জন-সমাজের প্রাসঙ্গিক শিক্ষাকে নিশ্চিত করবে এবং স্থানীয় দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

এককেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার একটি বড় সমস্যা হলো, এটি শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল চিন্তা এবং গবেষণাধর্মী শিক্ষার বদলে মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভরশীল করে তোলে। বিকেন্দ্রিক ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষা এবং গবেষণায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, চীনের কিছু গ্রামীণ বিদ্যালয়ে স্থানীয় কৃষি সমস্যার সমাধানে শিক্ষার্থীদের গবেষণামূলক কাজ করানো হয়, যা শুধু তাদের সৃজনশীলতাকেই বাড়ায় না বরং স্থানীয় সমস্যার বাস্তবসম্মত সমাধানও দেয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা শুধু দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে নয়, বরং ভবিষ্যতের উদ্ভাবক হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে। এককেন্দ্রিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে পরীক্ষাভিত্তিক জ্ঞানার্জনের ওপর যে অতিরিক্ত জোর দেওয়া হয়, তা শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী চিন্তার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। বিকেন্দ্রিক ব্যবস্থায়, বিশেষত প্রকল্পভিত্তিক এবং গবেষণাধর্মী শিক্ষার মাধ্যমে, শিক্ষার্থীরা শুধু পাঠ্যবইয়ে সীমাবদ্ধ না থেকে বাস্তব সমস্যা সমাধানে উদ্ভাবনী সমাধান খুঁজে পায়। ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা এ ক্ষেত্রে একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ যেখানে শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানে নিজস্ব পদ্ধতি অনুসন্ধানের স্বাধীনতা দেওয়া হয় এবং তাদের গবেষণায় অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করা হয়। বাংলাদেশের মতো দেশে এ ধরনের উদ্যোগ শুধু উদ্ভাবনী চিন্তার বিকাশ ঘটাবে না, বরং প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার সম্প্রসারণেও সহায়ক হবে।

বাংলাদেশের এককেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের চাহিদা এবং বৈচিত্র্যময় পটভূমিকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের তত্ত্বাবধানে সারা দেশের জন্য একই পাঠ্যপুস্তক নির্ধারণ করা হয়, যা বিশেষ করে শহর ও গ্রামের শিক্ষার্থীদের ভিন্নতর চাহিদা এবং বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। শহরের শিক্ষার্থীরা যেখানে উন্নত প্রযুক্তি, শিক্ষণ সামগ্রী এবং অভিজ্ঞ শিক্ষকের সুবিধা পায়, গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এর ফলে শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি গভীর বৈষম্য তৈরি হয়, যা শিক্ষার্থীদের দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে অন্তরায় এবং আত্মবিশ্বাসে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই বৈষম্য কেবল শারীরিক সুযোগ-সুবিধার সীমাবদ্ধতা নয়; এটি শিক্ষার্থীদের চিন্তা ও দক্ষতার বিকাশকেও বাধাগ্রস্ত করে। গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজন স্থানীয় বাস্তবতা এবং জীবিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত ও জীবনমুখী সংগতিপূর্ণ পাঠ্যসূচি। যেমন ভারতের কেরালা রাজ্যে স্থানীয় শিক্ষার বিকাশে একটি সমন্বিত উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে, যা গ্রামের শিক্ষার্থীদের স্থানীয় সমস্যার সমাধানে সম্পৃক্ত করে তাদের আত্মবিশ্বাস এবং দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে।

ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা তার বিকেন্দ্রিক চরিত্র এবং শিক্ষকের স্বাধীনতার জন্য বিশ্বব্যাপী সেরা হিসেবে স্বীকৃত। এই ব্যবস্থায় শিক্ষকরা পাঠ্যক্রম এবং শিক্ষাদান পদ্ধতি নির্ধরণে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করেন, যা শিক্ষার মানকে বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে। শিক্ষার্থীদের তাদের আগ্রহ অনুযায়ী বিষয় বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় এবং তারা গবেষণাধর্মী কার্যক্রমে অংশ নিয়ে সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অর্জন করে। ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার এই উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, শিক্ষকদের স্বাধীনতা এবং শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত চাহিদার প্রতি মনোযোগ শিক্ষার সামগ্রিক মান উন্নত করতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা স্থানীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, এবং প্রযুক্তির সফল সংমিশ্রণের জন্য বিখ্যাত। জাপান তাদের শিক্ষাক্রমে স্থানীয় ঐতিহ্যকে অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করে। যেমন জাপানের বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের স্থানীয় শিল্পকলা, কৃষি এবং পরিবেশ নিয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়, যা তাদের শিকড়ের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করে। একই সঙ্গে প্রযুক্তির ব্যবহার শিক্ষার্থীদের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত করে তোলে। ফিনল্যান্ড এবং জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আমরা দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। প্রথমত, শিক্ষকদের স্বাধীনতা এবং স্থানীয় চাহিদার প্রতি মনোযোগ প্রদান শিক্ষার গুণগত মান উন্নত করে। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় ঐতিহ্য এবং প্রযুক্তির সংমিশ্রণ শিক্ষার্থীদের বাস্তবমুখী এবং কার্যকর শিক্ষা প্রদান করতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই মডেলগুলো গুরুত্বপূর্ণ।

বিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিক্ষকদের স্বাধীনতা প্রদান এবং স্থানীয় চাহিদার ওপর ভিত্তি করে শিক্ষাক্রম তৈরির মাধ্যমে শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব। বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে স্থানীয় বনজ সম্পদের ওপর ভিত্তি করে পরিবেশগত শিক্ষা, বা উপকূলীয় এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার কৌশল অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। একইসঙ্গে প্রযুক্তি ব্যবহারে বিনিয়োগ করে শিক্ষার্থীদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার উপযোগী করে গড়ে তোলা সম্ভব। ফিনল্যান্ড এবং জাপানের উদাহরণ থেকে দেখা যায় যে, একটি বিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা কেবল শিক্ষার মান উন্নত করতেই নয়, বরং শিক্ষার্থীদের সার্বিক উন্নয়নের মাধ্যমে একটি জাতির ভবিষ্যৎ গড়তে কতটা কার্যকর হতে পারে।

সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে বিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে। এটি কেবল শিক্ষার মানোন্নয়নেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং প্রযুক্তি, শিল্প এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। বিকেন্দ্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা, দক্ষতা এবং উদ্যোক্তা মানসিকতা বিকশিত হবে, যা তাদের বৈশ্বিক চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে তুলবে। একই সাথে শিক্ষার ডিজিটালকরণ নিশ্চিত করা হলে শিক্ষার্থীদের শেখার পদ্ধতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। তারা তাদের শেখার নিজস্ব গতি ও আগ্রহ অনুযায়ী জ্ঞান অর্জন করতে পারবে, যা ব্যক্তিগত উদ্ভাবন এবং উদ্যোক্তা চেতনার বিকাশ ঘটাবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জাপানের শিক্ষাব্যবস্থায় যেমন স্থানীয় শিল্পের সাথে প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটানো হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশেও স্থানীয় চাহিদা অনুযায়ী পাঠ্যসূচি এবং প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ডিজাইন করা সম্ভব। এর ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি দক্ষ জনশক্তির ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবে এবং বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম হবে।

একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশে বিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি নতুন, দক্ষ ও সৃজনশীল প্রজন্ম গড়ে তোলা সম্ভব। তাই বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে বাংলাদেশকে টিকে থাকতে হলে এককেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে বিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার পথে দ্রুত এগোতে হবে। ফিনল্যান্ড, জাপান বা সিঙ্গাপুরের মতো উদাহরণগুলোকে বিচার-বিশ্লেষণ করে আমরা আমাদের নিজস্ব প্রেক্ষাপটের উপযোগী একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি। এই ব্যবস্থা কেবল শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়াবে না, বরং তাদের মধ্যে উদ্ভাবনী চিন্তা, মানবিক মূল্যবোধ এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা তৈরি করবে। বিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা শুধু আমাদের অকার্যকর শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের জন্য নয়, এটি আমাদের আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের ভিত্তি হিসেবেও জরুরি। এটি বাংলাদেশী হিসেবে এমন এক প্রজন্ম গড়ে তুলতে সহায়তা করবে যারা হবে আত্মনির্ভরশীল, সৃজনশীল এবং আধুনিক বিশ্বের প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষতার চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এর মাধ্যমে বাংলাদেশীরা অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী, প্রযুক্তিতে অগ্রসর এবং মানবসম্পদে সমৃদ্ধ একটি জাতি হিসেবে বিশ্বে স্থান করে নিতে সক্ষম হবে। শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়িয়ে বিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার পথে এগিয়ে গিয়ে আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎকে নিরাপদ এবং উজ্জ্বল করে তুলতে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

ড. মাহরুফ চৌধুরী, ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য। mahruf@ymail.com

শেয়ার করুন:-
শেয়ার