গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ বলেছেন, গত ১৫ বছরে গণমাধ্যমের বড় একটি অংশ সত্য প্রকাশে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে তারা সাধারণ মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। যার অন্যতম কারণ হচ্ছে দলীয় প্রভাব। গণমাধ্যমের রাজনৈতিক দলবাজি বন্ধ করা দরকার। রাজনৈতিক দলীয় আদর্শে দিয়ে সংবাদমাধ্যমকে প্রভাবিত করা যাবে না।
রোববার (৫ জানুয়ারি) বেলা ১১টায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন কর্তৃক আয়োজিত চট্টগ্রাম বিভাগের সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন। সভায় চট্টগ্রাম বিভাগের চাঁদপুর, কুমিল্লা, কক্সবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর জেলার প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা অংশগ্রহণ করেন।
মতবিনিময় সভায় সিনিয়র সাংবাদিক কামাল হোসেন আরো বলেন, এদেশে যে কেউ চাইলেই পত্রিকা বের করতে পারছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় সম্পাদক কিংবা প্রকাশকের গণমাধ্যম পেশায় কোন অভিজ্ঞতাই নেই। ফলে তারা আবার অভিজ্ঞতা কিংবা যোগ্যতা ছাড়াই যাকে তাকে সাংবাদিক হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছে। এগুলোয় শৃঙ্খলা আনতে হবে। যদিও পত্র-পত্রিকার ক্ষেত্রে অনেক নীতিমালা আছে। তবে সমস্যা হচ্ছে সরকার সে নীতিমালাগুলো মানেনি। সরকার মানেনি বলতে, সরকারের কর্মকর্তারা রাজনৈতিক প্রভাবে অথবা অন্য কোনো কারণে সেগুলো মানেননি। সংবাদপত্র সংক্রান্ত নীতিমালায় আছে যে, পত্রিকার সম্পাদক হতে গেলে ৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি হতে হবে। কিন্তু অনেকে উত্তরাধিকার সূত্রে ভাই ও পুত্রকে সম্পাদক বানিয়ে দিচ্ছে, যার কোনো সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা নেই। সেটা আবার সরকার গ্রহণ করছে। নীতি থাকলেও সেটা কার্যকর হচ্ছে না। এটা আমাদের বড় সমস্যা।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে ৪৬টি টেলিভিশন চলার মতো বাজার নেই। অথচ বিগত সরকারের আমলে একের পর এক টেলিভিশন অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। একই হাউস থেকে একাধিক সংবাদপত্র বের হচ্ছে। পাঠক একই জিনিস ঘুরে ফিরে পাচ্ছে। দেখা যায়, একই ব্যক্তির মালিকানায় পত্রিকা, টেলিভিশন, অনলাইন নিউজ পোর্টালও আছে। এই দুষ্টু চক্র ভাঙতে হবে। এমনও জেলা-উপজেলা আছে যেখানে চারটা প্রেসক্লাব। এটি আসলে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। প্রেসক্লাব করলে হয়তো কিছু সুবিধা পাওয়া যায়! প্রেসক্লাবের নেতা হলে মনে হয় একটু আলাদা মর্যাদা, একটু আলাদা কোনো আর্থিক ব্যাপার থাকতে পারে। সেই কারণে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা। আমরা বলতে পারি এটা একটা সমস্যা এটি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা দরকার, সমাধান কি হতে পারে।
ওয়েজবোর্ডের বদলে সাংবাদিকদের একটা ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ করার প্রস্তাবের বিষয়ে তিনি বলেন, সেটা একটা ভাল সমাধান হতে পারে যে, সারাদেশে সাংবাদিকদের জন্য ন্যূনতম বেতন থাকবে। আমরা আশা করছি এই ধরনের সমাধানগুলো আমরা আপনাদের কাছ থেকেই পাবো। সেটার ভিত্তিতেই আমরা সুপারিশমালা তৈরি করবো। সাংবাদিকদের পাশাপাশিআমরা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকেও লিখিতো আকারে সুপারিশ চেয়েছি।
মতবিনিময় সভায় উপস্থিত সাংবাদিকরা তাদের পরামর্শ এবং প্রস্তাবনায় বলেন, শুধুমাত্র সাংবাদিকদের যোগ্যতা কিংবা অভিজ্ঞতা দেখলেই হবে না, প্রকাশক কিংবা সম্পাদকেরও যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতা দেখতে হবে। যেকোনো ব্যক্তি যেন চাইলেই পত্রিকার সম্পাদক হতে না পারেন। অনেক সময় দেখা যায়, রাজনৈতিক ব্যক্তি কিংবা মাদক কারবারিরা সাংবাদিকদের দমিয়ে রাখতে নিজেই পত্রিকার মালিক হয়ে যান। এসব বন্ধ করতে হবে। আর বেশিরভাগ পত্রিকা সাংবাদিকদের ওয়েজ বোর্ড মানে না। গণমাধ্যমের মান-মর্যাদা ধরে রাখতে হলে সাংবাদিকদের ন্যূনতম বেতন ভাতা নিশ্চিত করতে হবে। যেহেতু সব পত্রিকার আয় একই নয়, তাই ওয়েজ বোর্ড না হলেও মফস্বল সাংবাদিকদের জন্য অন্তত একটি বেতনকাঠামো করে দেওয়া হোক, যাতে ব্যয় অনুযায়ী ন্যূনতম বেতন পান সাংবাদিকেরা। বিগত ফ্যাসিবাদ সরকারের সময়ে সাংবাদিকের নামে করা মিথ্যে মামলা প্রত্যাহার করা এবং তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
জবাবে গণমাধ্যম কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ বলেন, ১৯৮৩ সালে প্রেস কমিশনের সুপারিশেও সাংবাদিকদের হয়রানির বন্ধে বলা হয়েছিল, জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে সাংবাদিকদের হয়রানি করা যাবে না। সংস্কার কমিশন তো তদন্ত কমিটি নয়। তবে মামলা-হামলার বিষয়ে আপনাদের সুপারিশগুলো বিবেচনা করা হবে। সারা দেশে পত্রিকাগুলোতে যাতে একটি জাতীয় সম্পাদকীয় নীতি থাকে, তার জন্য সম্পাদক পরিষদকে বলা হয়েছে। আমরা আপনাদের কথা অনুযায়ী সুপারিশ করব। সেটি বাস্তবায়ন করবে সরকার।
মতবিনিময় সভায় অংশ নেওয়া চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন পর্যায়ে সাংবাদিকদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, চট্টগ্রামের সিনিয়র সাংবাদিক ওসমান গনি মনসুর, মোস্তাক আহমেদ, সাইফুল ইসলাম, ইকবাল হোসেন, লতিফা আনসারী, মনীষা আচার্য, কক্সবাজারের সিনিয়র সাংবাদিক মাহবুবুর রহমান, মো. আরিফ, মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম, কুমিল্লা জেলার সাংবাদিক মো. রফিকুল ইসলাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাংবাদিক ইব্রাহিম খান, নোয়াখালী জেলার সাংবাদিক মানিক ভূঁইয়া, দৈনিক চাঁদপুর দিগন্ত পত্রিকা নির্বাহী সম্পাদক ইলিয়াস পাটোয়ারী, চাঁদপুর টাইমসের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান বার্তা সম্পাদক মুসাদ্দেক আল আকিব, দৈনিক ইলশেপাড় পত্রিকার বার্তা সম্পাদক এস এম সোহেল ও দৈনিক চাঁদপুর সময় পত্রিকার বার্তা সম্পাদক আশিক বিন রহিম প্রমুখ।
এছাড়া আরও উপস্থিত ছিলেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন, আখতার হোসেন খান, বেগম কামরুন্নেসা হাসান, আবদুল্লাহ আল মামুন, মোস্তফা সবুজ, চট্টগ্রাম পিআইডির উপ-প্রধান তথ্য অফিসার মো. সাঈদ হাসান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. কামরুজ্জামান প্রমুখ।
কাফি