দেশের ৬১টি রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের ৭০ দশমিক ৫৮ শতাংশই রয়েছে মাত্র ১০টি ব্যাংকে। গতকাল প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। তবে প্রতিবেদনে এসব ব্যাংকের নাম প্রকাশ করা হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই ব্যাংকগুলোর শীর্ষ ঋণগ্রহীতারা খেলাপি হলেই ২৯টি ব্যাংক তাদের ন্যূনতম মূলধন সক্ষমতা বা ক্যাপিটাল টু রিস্ক-ওয়েটেড অ্যাসেটস রেশিও (সিআরএআর) বজায় রাখতে ব্যর্থ হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জুন প্রান্তিকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, শীর্ষ পাঁচ ও ১০ ব্যাংকের মধ্যে খেলাপি ঋণের ঘনত্ব আগের (মার্চ) প্রান্তিকের তুলনায় যথাক্রমে ২.৮৯ ও ২.৭৯ শতাংশীয় পয়েন্ট বেড়েছে। ২০২৪ সালের জুন শেষে, খেলাপি ঋণের ৫৪ শতাংশই ছিল শীর্ষ পাঁচ ব্যাংকে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শীর্ষ পাঁচ ও ১০টি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের এই ক্রমবর্ধমান কেন্দ্রীকরণ সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতের জন্য উদ্বেগজনক।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এখনকার প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেখা যাচ্ছে, সেটি আসলে এই খাতের ন্যূনতম পরিমাণ (মিনিমাম ফিগার)। প্রকৃত পরিস্থিতি সম্ভত আরও খারাপ।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ২০২৫ সালের জুন মাসের স্ট্যাবিলিটি রিপোর্টে ব্যাংক খাতের আসল চিত্র উঠে আসবে।
তিনি আরও বলেন, আগামী এপ্রিল মাস থেকে খেলাপি ঋণ (ক্লাসিফাইড লোন) নির্ধারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নিয়ম কার্যকর হবে। তখন নতুন আরও খেলাপি ঋণ তৈরি হবে, যেগুলো এখন নিয়মিত দেখাচ্ছে। একইসঙ্গে ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতির চিত্রও পরিষ্কার হবে।
ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি উন্নয়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ যথেষ্ট কি না- জানতে চাইলে জাহিদ হোসেন বলেন, ব্যাংকগুলোকে এখন ফার্স্ট এইড দেওয়া হচ্ছে, যাতে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে না যায়। মূল চিকিৎসা এখনও শুরুই হয়নি। এর জন্য আরও কিছুটা সময় প্রয়োজন। ব্যাংকগুলোর সামগ্রিক চিত্র হাতে পাওয়ার পর মূল চিকিৎসা শুরু করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুন প্রান্তিকে মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে খারাপ ও মন্দ (ব্যাড অ্যান্ড লস) ঋণের হিস্যা কিছুটা কমলেও এখনও এই শ্রেণির ঋণ সবচেয়ে বেশি।
মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে খালাপ ও মন্দ ঋণ ৭৯.৪২ শতাংশ, সাব-স্ট্যান্ডার্ড’ (নিম্নমান) ঋণ অংশ ১৭.৩৯ শতাংশ এবং ‘ডাউটফুল’ (সন্দেহজনক) ঋণে ৩.১৯ শতাংশ। খারাপ ও মন্দ শ্রেণির ঋণ সবচেয়ে বাজে ধরনের খেলাপি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২৪ সালের জুন শেষে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২.১১ লাখ কোটি টাকা, যা মোট বকেয়া ঋণের ১২.৫৬ শতাংশ।
তবে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.৮৫ লাখ কোটি টাকা, যা দেশের মোট বকেয়া ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ। ওই সময়ে মোট বকেয়া ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৬.৮৩ লাখ কোটি টাকা।
শীর্ষ ৩ ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে মূলধন ঘাটতিতে পড়বে ২৯ ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শীর্ষ তিন ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে দেশের ২৯টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়বে এবং ন্যূনতম সিআরএআর বজায় রাখতে ব্যর্থ হবে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের জুন শেষে দেশের ৬১টি তফসিলি ব্যাংকের মধ্যে ১১টি ইতিমধ্যেই ১০ শতাংশ ন্যূনতম সিআরএআর বজায় রাখার বাধ্যবাধকতা পূরণে হয়েছে। বাকি ব্যাংকগুলোর শীর্ষ তিন ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে আরও ১৮টি ব্যাংক ঝুঁকিতে পড়বে।
অন্যদিকে, খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতির অবস্থাও আরও খারাপ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১০টি ব্যাংকের সম্মিলিত সঞ্চিতি ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা।
এই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলো হচ্ছে: ন্যাশনাল ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক ও সাউথইস্ট ব্যাংক। এগুলোর মধ্যে চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ও ছয়টি বেসরকারি ব্যাংক।
খেলাপি ঋণ বেশি হলে প্রভিশন ঘাটতি হয়। প্রভিশন ঘাটতি বাড়লে ব্যাংকের নিট মুনাফা কমে যায়, যার ফলে কমে যায় শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশেও।