ক্যাটাগরি: রাজনীতিসারাদেশ

জেলা বিএনপির সভাপতির দখলদারিত্ব-প্রভাব বিস্তারে আতঙ্কিত চাঁদপুরবাসী

৫ই আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে হাসিনা ভারত পালানোর পরবর্তি সময়ে চাঁদপুর জেলা বিএনপির সভাপতির শেখ ফরিদ আহমেদ মানিকের দখলদারিত্ব ও প্রভাব বিস্তারে বেপরোয়া হয়ে উঠার অভিযোগ রয়েছে।ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্ব নিয়ে বিএনপির কেন্দ্র থেকে সম্প্রতি শোকজও করা হয় চাঁদপুর জেলা বিএনপির সভাপতি মানিককে। সম্প্রতি আলজাজিরার সাংবাদিক জুলকারনাইন সামি চাঁদপুর জেলা বিএনপির সভাপতির অনৈতিক দখলদারিত্ব নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করে। পরবর্তীতে বিএনপির কেন্দ্র থেকে শেখ ফরিদ আহমেদকে শোকজ করা হলে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন তিনি।সম্প্রতি চাঁদপুর জেলা বিএনপির দলীয় অফিসের জন্য একটি পরিবারের বাড়ি দখলেরও অভিযোগ উঠেছে। তার বিরুদ্ধে জাতীয় প্রেসক্লাবে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মানববন্ধনও করেছে মীর আহমদ আলী নামের চাঁদপুরের একটি পরিবার। এছাড়াও সম্প্রতি চাঁদপুর সদর হাসপাতালে দালাল চক্র ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারী জনতার মধ্যে সংঘর্ষ হয়। পরবর্তীতে দালাল চক্রের পক্ষ নিয়ে সিভিল সার্জনকে হেনস্থা করার অভিযোগে জেলা বিএনপির সভাপতি সমালোচনার মুখে পড়েন। এ নিয়ে চাঁদপুর শহরে উত্তেজনা বিরাজ করে। এসব বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের ফলে খোদ চাঁদপুর জেলা বিএনপির মধ্যেই ভিবক্তি দেখা দিয়েছে।

সূত্র জানায়, জেলা বিএনপির সভাপতির দখল, লুটপাট ও নৈরাজ্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লেখা-লেখির ফলে চাঁদপুর জেলা বিএনপির প্রকাশনা সম্পাদক কাজী ইব্রাহিম জুয়েল বহিষ্কার হয়। এর ফলে শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক ও জুয়েল প্রকাশ্যে দ্বন্ধে জড়ায়।

সূত্র মতে, চাঁদপুর জেলা বিএনপি সভাপতির দখল-লুটপাট চাঁদাবাজি ও ভয় ভীতি দেখানোর বিষয় নিয়ে চাঁদপুর জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপারকে লিখিত অভিযোগ দেয় জুয়েল। একই সঙ্গে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচী পালনের অনুমতি নেয় সাবেক ছাত্রদল সভাপতি জুয়েল।

এদিকে সোমবার (৯ ডিসেম্বর) প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন এবং সংবাদ সম্মেলনের উদ্যোগ নেয় কাজী ইব্রাহীম জুয়েল। তবে এই প্রতিবাদ কর্মসূচীতে হামলায় আহত হয় অর্ধশত।একই সঙ্গে জুয়েলের বাসা-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও তাঁর মালিকানাধীন পত্রিকা কার্যালয় ভাঙচুর-লুটপাট করে একদল দূর্বৃত্ত।ভুক্তভুগী জুয়েলের দাবি এই হামলার ইন্ধন দিয়েছে চাঁদপুর জেলা বিএনপি সভাপতি মানিক। কারণ হামলার সময় উপস্থিত ছিলেন মানিকের অনুগত চাঁদপুর জেলা ছাত্রদল সভাপতি- সাধারণ সম্পাদকসহ সসস্র সন্ত্রাসীরা।হামলায় কাজী ইব্রাহিমের ছেলেসহ গুরুতর আহত শতাধিক। এসময় বাসা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার, সিসিটিভি ডিভিআর, মূল্যবান জিনিসপত্র ও লগদ টাকা লুট করার অভিযোগ উঠেছে।

সূত্র জানায়, কাজী ইব্রাহীম জুয়েলের বাসা-বাড়ী, ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান, হোটেল ও প্রত্রিকা কার্যালয়ে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ব্যাপক হামলা ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। হামলায় উপস্থিত নেতৃত্ব দেয় চাঁদপুর জেলা ছাত্রদল সভাপতি ইমাম গাজী , সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন পাটোয়ারী,সাংগঠনিক সম্পাদক জিয়াউর রহমান সোহাগ। এছাড়াও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানা, মেহেদী হাসান শাকিল, চাঁদপুর পৌর ছাত্রদল মামুন খান, চাঁদপুর সরকারি কলেজ সভাপতি সোহেল গাজী, জিসান আহমেদ মুরাদ (সভাপতি থানা ছাত্রদল), পারভেজ খান (সাধারণ সম্পাদক সদর থানা), জুনায়েদ খান (সাবেক সাধারণ সম্পাদক সদর থানা), মাসুদ মাঝি (যুগ্ম আহ্বায়ক স্বেচ্ছাসেবক দল, চাঁদপুর জেলা)। এসময় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের অসংখ্য নেতাকর্মীদেরকে হামলা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট অংশগ্রহণ করতে দেখা যায় বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা।

এবিষয়ে ভুক্তভুগী কাজী জুয়েল অর্থসংবাদকে বলেন, গত ১৭ বছর আমি স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসনে নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার হয়েছি। অসংখ্যবার কারাবরণ করেছি। আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং বাড়িতে অসংখ্যবার আওয়ামী সন্ত্রাসীর হামলা ও লুটপাট করেছে। তবুও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি এবং স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে রাজপথ থেকে এক পাও সরে যাইনি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে এবং নির্দেশে রাজপথে প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছি। আমার কষ্টে উপার্জিত অর্থ দিয়ে দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের পাশে ছিলাম। আজকে ছাত্র-জনতার রক্তে অর্জিত নতুন বাংলাদেশে আমার সন্তানকে রক্তাক্ত করা হলো। আমাকে খুন করার চেষ্টা করেছে। এ বিচার আমি মহান আল্লাহর কাছে দিলাম।

এছাড়া আমি দলের পরিক্ষীত কর্মী। আমাকে দলের নেতাকর্মীরা ভালোবাসেন এবং আমি সুনাম ক্ষুন্ন যেন না হয় সেই জন্য জেলা বিএনপি সভাপতি অনৈতিক কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করেছি এটাই আমার অপরাধ। তাই আমার প্রতি ইর্শান্বিত হয়ে তিনি বার বার আমাকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি আমার দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের কাছে এর সঠিক বিচার চাই।’

এ বিষয়ে শান্তিপ্রিয় ও সচেতন চাঁদপুর বাসির দাবি, এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের দ্রুত হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। না হয় চাঁদপুরে বিএনপি জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকবে । পাশাপাশি চাঁদপুরবাসীর জান ও মালের নিরাপত্তায় সেনাবাহিনী এবং পুলিশ বিভাগের হস্তক্ষেপ চাই।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাঁদপুর জেলা বিএনপির সভাপতি শেখ ফরিদ আহমেদ মানিকের মুঠো ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোনে সাড়া দেননি। ফলে কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

এবিষয়ে জানতে চাইলে চাঁদপুর জেলা পুলিশ সুপার রবিক উদ্দিন অর্থসংবাদকে বলেন, আমরা সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছি। সঠিক তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। তবে এখনো লিখিত অভিযোগ পাইনি।

এদিকে জেলা বিএনপির কয়েকজন নেতা নাম না প্রাকাশ করার শর্তে বলেন, আসলে জুয়েল শেখ ফরিদ আহমেদ মানিকের অন্যায়ের প্রতিবাদ করে দলের ইমেজ রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মানিক সাহেব তা সহ্য করতে পারেননি। তাই জুয়েলকে দল থেকে বহিস্কারের পথ বেছে নেন। শুধু বহিস্কার করেই ক্ষান্ত হননি এবার তিনি জুয়েলকে প্রাণে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ ব্যাপারে বিএনপির উর্ধ্বতন মহল ব্যবস্থা না নিলে মানিক সাহেব জেলা বিএনপিকে শেষ করে দিবে এতে কোন সন্দেহ নেই। তাই আমরা জেলা বিএনপি সভাপতির অনৈতিক কর্মকান্ডের ব্যাপারে দ্রুত ব্যাবস্থা গ্রহণের জন্য দলের শীর্ষ নেতাদের প্রতি দাবী জানাই।

এদিকে প্রত্যক্ষ দর্শীরা জানান, গতকাল ৯ ডিসেম্বর ইব্রাহীম জুয়েল এর বাসার মূল গেইট ভেঙ্গে হামলাকারী জুয়েলকে ঘেরাও করে হত্যার উদ্দেশ্যে তুলে নেওয়ার চেষ্টা চালায় এবং তার পূর্ব নির্ধারিত সংবাদ সম্মেলন যেন না করেন তার জন্য হুমকি দেন। এসময় তারা জুয়েলের কাছে সিসি টিভির ডিভিআর ও কম্পিউটার ল্যাপটপ তুলে দেওয়ার দাবী জানায়। এরপর তারা অস্ত্রের মুখে জোর পূর্বক অফিসের সকল কম্পিউটার ও সিসিটিভির ডিভিআর ও ক্যামেরাসহ সব খুলে নিয়ে যায়। তবে ইব্রাহীম কাজী জুয়েলকে পুলিশের সহযোগীতায় নিরাপদে সরিয়ে নেয় উপস্থিত বিএনপির, যুব দল ও ছাত্রদলের কিছু নেতাকর্মীরা।

অপর দিকে ইব্রাহীম জুয়েলকে না পেয়ে তাঁর একমাত্র ছেলে আফতাবকে কাছে পেয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোটা দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। তার অবস্থা এখনো আশঙ্কাজনক। তাকে প্রথমে চাঁদপুর সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে ঢাকায় রেফার করলে তাকে দ্রুত ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তার অবস্থা আসঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন তার পরিবার। এতিকে হামলায় ব্যাবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারী এবং সাংবাদিক সহ প্রায় শতাধিক আহত হয়েছে বলে জানা যায়।

এদিকে ছাত্রদলের একটি সূত্র জানায় রবিবার (৮ ডিসেম্বর) সন্ধ্যার পর থেকেই জেলা বিএনপির সভাপতি শেখ ফরিদা মানিকের নির্দেশে ছাত্রদল-যুবদলের অসংখ্যা দুর্বৃত্ত ইব্রাহিম জুয়েল এর বাড়িতে হামলার ছক আঁকেন। সেই মোতাবেক পরিকল্পিতভাবেই হামলা চালানো হয়েছে বলে জানান বিএনপি’র একাধিক সূত্র। হামলার সময় পুরো শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয় এবং চাঁদপুর কুমিল্লা মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এর আগে ৮ ডিসেম্বর রোববার রাত থেকেই ছাত্রদল ও যুবদলের একটি অংশ চাঁদপুর শহর ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করে। তারা শত শত মোটরসাইকেল চড়ে এবং দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন করে চাঁদপুর শহরের পুরানবাজার, নতুন বাজার এবং ষোলঘর এলাকায় মহড়া দেয়। জনমনে প্রীতি ও এত সৃষ্টি করতে মুহুর্মুহু ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। হঠাৎ করেই একেরপর এক ককটেল বিস্ফোরনের আওয়াজে কেঁপে ওঠে পুরো চাঁদপুর শহর। এতে চাঁদপুর কুমিল্লা মহাসড়কে যান চলাচলে ব্যাহত হয়। পরে পুলিশ প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে আতঙ্ক সৃষ্টিকারীরা সটকে পড়ে। পরের দিন গতকাল সোমবার সকাল থেকেই তারা চাঁদপুর শহরের পুরান বাজার, নতুন বাজার এবং ষোলঘর এলাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অবস্থান নেয়। এরপর সন্ধ্যা পর্যন্ত মোটরসাইকেল এবং দেশীয় অস্ত্র নিয়ে জনমনে ভীতি সৃষ্টি করতে মহড়া দেয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের নির্যাতিত সাবেক কয়েকজন নেতা জানানা, চাঁদপুর জেলা বিএনপির সভাপতি শেখ ফরিদা মানিকের নির্দেশে বিএনপি ছাত্রদল যুবদলের একটি অংশ চাঁদপুর শহর জুড়ে এই তাণ্ডব এবং হামলা চালিয়েছে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর যে সকল সাবেক ছাত্র নেতারা চাঁদপুরে শেখ ফরিদ আহমেদ মানিকের দখল, লুটপাট ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল তাদের টার্গেট করে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে।

শেয়ার করুন:-
শেয়ার