শ্বেতপত্রের প্রতিবেদনে দুর্নীতি-লুটপাটের ভয়ংকর চিত্র

ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে ব্যাপক রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গত ৫ আগস্ট অবসান হয় আওয়ামী লীগের টানা দেড় দশকের শাসনের। ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন প্রবল প্রতাপশালী শাসক হিসেবে পরিচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দেড় দশকেরও বেশি সময় স্বৈরাচারী পদ্ধতিতে দেশ শাসন করা আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযোগ ছিল দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও আর্থিক লুটপাটের।

শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম এজেন্ডা ছিল তার আমলে সংঘটিত আর্থিক দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার অনুসন্ধান। এর অংশ হিসেবে গত আগস্ট মাসের ২৮ তারিখে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা পর্যালোচনার জন্য বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত হয় একটি অনুসন্ধানী কমিটি।

তিন মাস বিস্তৃত গবেষণা ও তথ্য অনুসন্ধানের পর প্রতিবেদন তৈরি করে ‘অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি’ নামে অভিহিত এই অনুসন্ধানী কমিটি। খসড়া হিসেবে উপস্থাপিত ৩৯৯ পৃষ্ঠার এই সুবিশাল প্রতিবেদনের ছত্রে ছত্রে উঠে আসে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংঘটিত দুর্নীতি, লুটপাট ও জনগণের অর্থ তসরুপের বিস্তৃত চিত্র।

২ ডিসেম্বর এই খসড়া শ্বেতপত্র প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে সাংবাদিকদের সামনে মুখোমুখি হয় শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। সেখানে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংঘটিত দুর্নীতির নানা চিত্র তুলে ধরেন শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

এ সময় শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি সাংবাদিকদের জানায়, দেশে গত পনের বছরে ‘চামচা পুঁজিবাদ থেকেই চোরতন্ত্র’ তৈরি হয়েছিল, যাতে রাজনীতিক, সামরিক ও বেসামরিক আমলা, বিচার বিভাগসহ সবাই অংশ নিয়েছে। পাশাপাশি গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে পাচার হয় ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

সুবিশাল খসড়া শ্বেতপত্রে দেখানো হয় বিগত সরকারের আমলে ২৮ উপায়ে সংঘটিত দুর্নীতির চিত্র। এছাড়া দেশের প্রধান প্রধান খাতকে দুর্নীতির ভয়াবহতা কোন মাত্রায় গ্রাস করে তার চিত্রও উঠে আসে এই প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনের ভূমিকায় ‘ম্যাগনিচুড অব করাপশন’ শীর্ষক অনুচ্ছেদে বলা হয়, নিয়মিতভাবে কর ফাঁকি দেয়া, কর মাফের সুযোগের অপব্যবহার এবং জনগণের অর্থের অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ভূলুণ্ঠিত করে দেশের উন্নয়নকে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বছরে গড়ে দেশের বাইরে অবৈধভাবে পাচার হয় ১৬ বিলিয়ন ডলার। যা দেশের মোট বৈদেশিক সাহায্য এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণের দ্বিগুণ। পাশাপাশি এই সময়ে যে কর মাফ করা হয়েছে তা দিয়ে শিক্ষা খাতের বরাদ্দকে দ্বিগুণ করা যেত এবং স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দকে তিনগুণ করা সম্ভব হতো। দুর্নীতির মাধ্যমে কিভাবে দেশের উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করা হয়েছে, এই পরিসংখ্যান তার প্রমাণ।

দুর্নীতির কারণে দেশের বড় বড় প্রকল্পগুলোর ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৭০ শতাংশ, পাশাপাশি প্রকল্প সম্পন্নের সময় বিলম্বিত হয়েছে ৫ বছর। পাশাপাশি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি এবং অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পে গত ১৫ বছরে বরাদ্দ হওয়া ৬০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১৪ থেকে ২৪ বিলিয়ন ডলার লোপাট হয়েছে রাজনৈতিক চাঁদাবাজি, ঘুষ এবং বাজেট বৃদ্ধির মাধ্যমে। এছাড়া জমি অধিগ্রহণের সময় তহবিল তসরুপ এবং নিজেদের অনুগত ব্যক্তিদের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দানের মাধ্যমে সম্পদের অপচয় ঘটিয়ে অবকাঠামোগত ও সামাজিক সুযোগ তৈরির সম্ভাবনা থেকে দেশকে বঞ্চিত করা হয়।

চাল, ভোজ্যতেল এবং গমের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদন এবং চাহিদার তথ্যের বিকৃতির কারণে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অরাজকতা ও অস্থিতিশীলতা তৈরি হয় দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থাতেও।

শ্বেতপত্রের প্রতিবেদনে বলা হয়, অবাস্তব ও রাজনৈতিক প্রভাবিত ক্রয় নীতির মাধ্যমে প্রভাবশালী ব্যবসায়িক গোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়া হয়, যা সাধারণ ভোক্তাদের ভোগান্তিকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া মজুদের তথ্য নিয়মিতভাবে যাচাই করার ব্যবস্থাপনার অনুপস্থিতি এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকে দেশের ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে তৈরি হওয়া অরাজক পরিস্থিতি ও লুটপাটের চিত্র উঠে আসে শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ঋণদানের প্রবণতা ব্যাংকিং খাতের সংকটকে আরও ঘনীভূত করে। ২০২৪ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংকিং খাত থেকে লোপাট হওয়া অর্থ দিয়ে দেশে ১৪টি মেট্রোরেল কিংবা ২৪টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব হতো। অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকা খেলাপি ঋণ এবং উচ্চ পর্যায়ের জালিয়াতি আর্থিক ভারসাম্যকে ভূলুণ্ঠিত করে এবং উৎপাদনমুখী খাতে বিনিয়োগ হ্রাস করে।

বিগত সরকারের আমলে অর্থ পাচারের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে জনশক্তি রফতানি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংশ্লিষ্টতা উঠে আসে শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে। গত এক দশকে ভিসা ক্রয়ের আড়ালে বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশি ১৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার হওয়ার তথ্য উঠে আসে শ্বেতপত্রে। যে অর্থ দিয়ে আরও চারটি ‘উত্তরা-মতিঝিল রুট’ এর সমমানের মেট্রোরেল সিস্টেম তৈরি করা সম্ভব ছিলো। এভাবে সিন্ডিকেটবাজি এবং কর্মী নিয়োগ পদ্ধতির দুর্নীতির মাধ্যমে প্রবাসী কর্মীদের মানসম্মত কর্মসংস্থানের সুযোগ পাওয়া থেকে বঞ্চিত করা হয়। যার ফলে কাঙ্ক্ষিত প্রবাসী আয় থেকে বঞ্চিত হয় দেশের অর্থনীতি।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সংঘটিত লুটপাট থেকে বাদ যায়নি সামাজিক নিরাপত্তা খাতও।

শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বরাদ্দের ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির শিকার হয়ে বঞ্চিত হন লাখ লাখ মানুষ। প্রতিবেদনে উঠে আসে, ২০২২ সাল পর্যন্ত সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগীদের মধ্যে ৭৩ শতাংশই দরিদ্র শ্রেণীভুক্ত ছিল না। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির এই অব্যবস্থাপনার ফল ভোগ করতে হয় দেশের দরিদ্র মানুষকে। মাত্র দুই দিন কাজ করতে ব্যর্থ হলেই দারিদ্যসীমার নিচে চলে যাওয়ার শঙ্কায় ছিল দেশের দুই কোটি মানুষ। এই তথ্যেই উঠে আসে দুর্নীতির মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সামাজিক অসাম্য তৈরির চিত্র।

বিগত সরকারের আমলে দুর্নীতি ও লুটপাটের থাবা থেকে বাদ যায়নি দেশের পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতিও। জলবায়ু অভিযোজন সংক্রান্ত তহবিলে দুর্নীতির মাধ্যমে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয় বলে জানানো হয় শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে।

শেয়ার করুন:-
শেয়ার