কাচ উৎপাদনের জন্য সুপরিচিত দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী নাসির গ্রুপ। গ্রুপটির এক ডজনের বেশি প্রতিষ্ঠানের একটি নাসির ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড অবসায়নের আবেদন করা হয়েছে হাইকোর্টে। মূলত পারিবারিক বিরোধ চরম পর্যায়ে পৌঁছে আইনি লড়াইয়ে রূপ নিয়েছে।
নাসির গ্রুপের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয় ২০২২ সালে এ শিল্পগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা নাসির উদ্দিন বিশ্বাসের মৃত্যুর পর। নাসির উদ্দিনের মৃত্যুর পর তার দুই স্ত্রী এবং তাদের সন্তানরা কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আইনি লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েন।
মূলত নাসির উদ্দিনের প্রথম স্ত্রী আনোয়ারা বিশ্বাসের সন্তানদের ব্যবস্থাপনায় চলা দুটি কোম্পানি—নাসির গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও নাসির ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে কেন্দ্র করে চলছে এ লড়াই।
বর্তমানে নাসির গ্লাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আনোয়ারা বিশ্বাসের মেয়ে নাসিমা বিশ্বাস, আর তার ভাই নাসিম বিশ্বাস আছেন নাসির ফ্লোট গ্লাসের প্রধানের দায়িত্বে।
প্রায় ২০০ কোটি টাকা পাওনা আদায়ের লক্ষ্যে গত ৩০ অক্টোবর হাইকোর্টের কোম্পানি-সংক্রান্ত বেঞ্চ বিচারপতি ফরিদ আহমেদের আদালতে নাসির ফ্লোট গ্লাস অবসায়নের দাবি জানিয়ে মামলা করেছেন নাসিমা।
আবেদনকারীর আইনজীবীরা বলছেন, আদালত অবসায়ন-সংক্রান্ত মামলাটি গ্রহণ করেছেন। একইসঙ্গে আদালত এই মামলায় কেউ আইনি লড়াই করতে চাইলে তাকে নিজে বা আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে হলফনামা দাখিলের আদেশ দিয়েছেন।
এই মামলার শুনানির জন্য আগামী ১১ ডিসেম্বর দিন ধার্য রেখেছেন আদালত।
আবেদনকারীর পক্ষের সিনিয়র আইনজীবী আহসানুল করিম জানান, ‘নাসির গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজের অধীনে অনেকগুলো কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও এমডি নাসির উদ্দিন বিশ্বাস। এই দুটি কোম্পানিও তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘নাসির ফ্লোট গ্লাস প্রতিষ্ঠার জন্য নাসির গ্লাসের কাছ থেকে বেশ কিছু টাকা নিয়ে কোম্পানি পরিচালনা করা হয়। সে হিসাবে নাসির ফ্লোট গ্লাসের কাছে নাসির গ্লাস প্রায় ১৯৭ কোটি ১৩ লাখ ৪১ হাজার ৬৭৭ টাকা পাওনাদার। এই পাওনার বিষয় দুটি কোম্পানির ব্যাংক লেনদেন ও অডিট রিপোর্টেও উল্লেখ আছে।
‘কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরেই এই পাওনা দাবি করা হলেও সেটি দেওয়া হচ্ছে না। এরপর টাকা চেয়ে আইনি নোটিশ ইস্যু করা হয়। নোটিশ ইস্যু করার ২১ দিনের মধ্যে টাকা না দিলে ধরে নেওয়া হয় ওই টাকা তিনি দিতে রাজি নন। ফলে গত ৩০ অক্টোবর হাইকোর্টে নাসির ফ্লোট গ্লাস অবসায়ন করে টাকা পরিশোধের মামলা করা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, আইনি প্রক্রিয়ায় প্রতিটি কোম্পানি আলাদা সত্তা হিসেবে বিবেচিত হয়।
মামলার আবেদনে বলা হয়, নাসির ফ্লোট গ্লাস ২০১৯-২০, ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে নাসির গ্লাসের কাছ থেকে এই ঋণ নেয়।
এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য নাসির ফ্লোট গ্লাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসিম বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
তবে কোম্পানিটির উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) বদিউজ্জামান জানান, অবসায়নের জন্য কোনো আবেদন সম্পর্কে আমি অবগত নই। আর যদি জানতামও, তবুও কোনো মন্তব্য করতাম না; কারণ এই বিরোধ ভাইবোনদের মধ্যে।
দেশে ফ্লোট গ্লাস উৎপদনে শীর্ষে রয়েছে নাসির ফ্লোট গ্লাস; এরপরই রয়েছে আকিজ গ্লাস ও পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস। বছরে প্রায় তিন লাখ টন স্বচ্ছ, রঙিন, রিফ্লেকটিভ, টেম্পারড, শব্দনিরোধক, গাড়ির আয়নাসহ বিভিন্ন ধরনের কাচ উৎপাদন করে নাসির ফ্লোট গ্লাস।
২০০৫ সালে ময়মনসিংহের ভালুকায় দৈনিক ৪০০ টন কাচ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কারখানা চালু করে নাসির ফ্লোট গ্লাস। ২০১৮ সালে দৈনিক ৬০০ টন উৎপাদনে আরেকটি কারখানা চালু করা হয়।
কোম্পানির মালিকানা নিয়ে নাসির গ্রুপের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব
নাসির গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন বিশ্বাসের মৃত্যুর পর তার দুই স্ত্রী ও তাদের সন্তানদের মধ্যে গ্রুপটির ১২টি কোম্পানির মালিকানা নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। সেই বিরোধ গড়ায় আদালত পর্যন্ত।
এসব কোম্পানির মালিকানা পেতে নাসির উদ্দিন বিশ্বাসের দ্বিতীয় স্ত্রী তাসলিমা সুলতানা, তার ছেলে মামুন ও নাসরান বিশ্বাস এবং মেয়ে নারিয়া বিশ্বাস হাইকোর্টে ২৫টির বেশি মামলা করেন গত তিন বছরে।
কোম্পানির নিবন্ধন ও তদারককারী প্রতিষ্ঠান যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি) সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত এসব মামলার রায় ও আদেশ নিয়ে নাসির উদ্দিনের দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার সন্তানরা ১২টির মধ্যে ৮টি কোম্পানির মালিকানা দখলে নেন।
কাফি