স্বর্ণের আন্তর্জাতিক বাজারে দ্বিতীয় বৃহত্তম ভোক্তা দেশ ভারত। প্রতিবেশী দেশটিতে স্বর্ণের বার্ষিক চাহিদা অন্তত ১ হাজার টন। বিশেষ করে বিয়েসহ নানা উৎসবের মৌসুম হওয়ায় শীতকালে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণের চাহিদা তৈরি হয়।
স্বর্ণের আন্তর্জাতিক বাজারে দ্বিতীয় বৃহত্তম ভোক্তা দেশ ভারত। প্রতিবেশী দেশটিতে স্বর্ণের বার্ষিক চাহিদা অন্তত ১ হাজার টন। বিশেষ করে বিয়েসহ নানা উৎসবের মৌসুম হওয়ায় শীতকালে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণের চাহিদা তৈরি হয়। কিন্তু উচ্চ মাত্রায় শুল্ক আরোপিত থাকায় এ চাহিদা পূরণের জন্য দেশটির ব্যবসায়ীদের বৈধপথে স্বর্ণ আমদানিতে খরচ পড়ে অনেক বেশি। এ কারণে বিশ্বব্যাপী পাচারকৃত স্বর্ণের বৃহত্তম গন্তব্য হয়ে উঠেছে ভারত, যার বেশির ভাগই প্রবেশ করে বছরের শেষ তিন মাস অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর তথা শীতকালে। দেশটিতে পাচারকৃত এ স্বর্ণ সবচেয়ে বেশি প্রবেশ করে বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গ সীমান্ত দিয়ে।
ভারতীয় শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থা ডিরেক্টরেট রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্সের তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে পরিচালিত এক গবেষণায়ও উঠে এসেছে, দেশটিতে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ পাচার হয় শীতের তিন মাস অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে। মূল্যবান ধাতুটির আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতে স্বর্ণ পাচারের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এমন পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন বেঙ্গালুরুভিত্তিক সেন্ট জোসেফস ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট এবং পন্ডিচেরি ইউনিভার্সিটির তিন গবেষক।
‘গোল্ড স্মাগলিং ইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইটস ইফেক্ট অন দ্য বুলিয়ন ইন্ডাস্ট্রি’ শীর্ষক গত মার্চে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসা এ পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত পোষণ করছেন দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরাও।
তাদের ভাষ্যমতে, শীতকালে কুয়াশা বেশি থাকার কারণেও চোরাকারবারিরা এর সুবিধা নিতে বেশি তৎপর হয়ে ওঠে। আবার এ কুয়াশার কারণেই শীতে পাচারের সময় স্বর্ণ জব্দের পরিমাণও কমে যায়। বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২৩ পর্যন্ত চার বছরে সীমান্ত এলাকায় পাচারের সময় মোট প্রায় ৫৯৪ কেজি স্বর্ণ জব্দ করেছেন বাহিনীটির সদস্যরা। এর প্রায় ৪৪ শতাংশই আটক হয়েছে গত বছর। ২০২৩ সালে দেশের সীমান্ত এলাকা থেকে পাচারের সময় জব্দ করা হয়েছে ২৬০ কেজি ৫৬৭ গ্রাম স্বর্ণ। এর মধ্যে অক্টোবরে ১৪ কেজি ৭৯৪ গ্রাম, নভেম্বরে ২৭ কেজি ৪০০ ও ডিসেম্বরে ১১ কেজি ৬৪৩ গ্রাম স্বর্ণ আটক করা হয়।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বিজিবি মুখপাত্র কর্নেল মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘সাধারণত শীতের সময় সীমান্ত এলাকায় কুয়াশার প্রকোপ থাকে বেশি। এ সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করে স্বর্ণ পাচারে যুক্ত অপরাধীরা। স্বর্ণ পাচার বন্ধে শীতের আগেই সীমান্ত এলাকায় নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। আগামীতেও সীমান্ত দিয়ে স্বর্ণ পাচার রোধে শক্ত অবস্থান ধরে রাখবে বিজিবি।’
দেশে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার ভারসাম্যে স্বর্ণ পাচারের ব্যাপক প্রভাব পড়ে বলে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা, ব্যাংকার ও মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। তাদের ভাষ্যমতে, স্বর্ণ পাচার বাড়লে ব্যাংক ও কার্ব মার্কেটে ডলারের বিনিময় হারের মধ্যে ব্যবধানও বেড়ে যায়। দেশের কার্ব মার্কেটের একটি অংশ সবসময়ই ভারতনির্ভর। প্রতিবেশী দেশটি থেকে অবৈধ পথে আসা ডলার লেনদেন হয় মূলত কার্ব মার্কেটে। সাম্প্রতিক সময়ে কার্ব মার্কেটে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে ভারতে স্বর্ণ পাচার ও সেখান থেকে মুদ্রাটির সরবরাহের যোগসূত্র রয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
বাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের কার্ব মার্কেটে ডলারের দর স্থিতিশীল হয়ে আসে। আগস্টের শেষের দিকে ব্যাংক খাতে প্রতি ডলারের সর্বোচ্চ বিনিময় হার ছিল ১২০ টাকা। একই সময়ে খুচরা বাজারে প্রতি ডলার ১২১-১২২ টাকায় ওঠানামা করছিল। আবার চলতি মাসের শুরুতে খুচরা বাজারে ডলারের বিনিময় হারে কিছুটা ঊর্ধ্বমুখিতা দেখা যায়। গতকালও রাজধানীর মানি এক্সচেঞ্জগুলোয় প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ১২৪-১২৫ টাকার মধ্যে। এর আগে গত দুই সপ্তাহে এ দর ১২৬ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল।
এ বিষয়ে রাজধানীর মতিঝিলভিত্তিক এক মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী বলেন, ‘বিভিন্ন মাধ্যমে এ ডলার বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ব্যাংক ও কার্ব মার্কেটে মুদ্রাটির বিনিময় হারের ভারসাম্যে বরাবরই স্বর্ণ পাচারের বড় প্রভাব পড়তে দেখা গেছে।’
দেশে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে রেমিট্যান্স হিসেবে ডলারের সরবরাহেও বড় প্রভাব ফেলছে স্বর্ণ পাচার। দেশে রেমিট্যান্স হিসেবে আসা ডলারের বড় উৎস মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। ভারতে পাচারকৃত স্বর্ণেরও অন্যতম প্রধান উৎস মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীদের অর্জিত আয়ের পরিবর্তে বড় একটি অংশ এখন ডলারের পরিবর্তে স্বর্ণের বার হিসেবে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। দেশের বিমানবন্দরগুলোয় এগুলোর বৈধকরণও হচ্ছে। শুল্কহার দ্বিগুণ করেও মধ্যপ্রাচ্য থেকে রেমিট্যান্সের পরিবর্তে স্বর্ণের বার আনা বন্ধ করা যায়নি। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও শুধু চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরেই প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা মূল্যের স্বর্ণের বার বৈধ করা হয়েছে। তবে বৈধ পথে যত স্বর্ণ বাংলাদেশে প্রবেশ করে, অবৈধ পথে তার কয়েক গুণ প্রবেশ করছে বলে মনে করছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী-সংশ্লিষ্টরা।
যশোরসহ খুলনা বিভাগের সীমান্তবর্তী জেলাগুলো এখন ভারতে বাংলাদেশ থেকে স্বর্ণ পাচারের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে শুধু যশোরেই গত চার বছরে পাচারের সময় স্বর্ণ জব্দ হয়েছে ২৫০ কেজি।
স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানিয়েছে, বর্ষা মৌসুমে যশোরের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোয় পানি জমে থাকে। এটিও এখানকার চোরাকারবারিদের স্বর্ণ পাচারের জন্য শুষ্ক মৌসুমকে বেছে নেয়ার বড় কারণ।
সীমান্তবর্তী এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে গরু ব্যবসার নামে খাটাল (গোয়াল) তৈরি করা হয়। মূলত এর আড়ালেই বাহকের মাধ্যমে ভারতে স্বর্ণ পাচার করা হয়। এর বিনিময়ে ভারত থেকে সমপরিমাণ ডলার বা অন্য মুদ্রা অবৈধভাবে বাংলাদেশে আনা হয়। এখান দিয়ে যে পরিমাণ স্বর্ণ পাচার হয় বিজিবি বা কাস্টমসের হাতে তার ভগ্নাংশ ধরা পড়ে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ৪৯ বিজিবি যশোর ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী বলেন, ‘চোরাচালান রোধে বিজিবি সদস্যরা কাজ করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে আমাদের গোয়েন্দা দল কাজ করছে। যশোর সীমান্তে বর্ষা মৌসুমে পানি জমে থাকে। এ কারণে চোরাকারবারি স্বর্ণ পাচারের জন্য শুষ্ক মৌসুমকে বেছে নেয়।’
বাংলাদেশ থেকে ভারতে স্বর্ণ পাচার বেড়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ হিসেবে দেশটিতে পণ্যটি আমদানিতে উচ্চ মাত্রায় শুল্ক আরোপকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্যমতে, শুল্ক ফাঁকি দিতে গিয়ে দেশটিতে স্বর্ণ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অনেকেই এখন চোরাচালানের মাধ্যমে আনা পণ্য সংগ্রহের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। বর্তমানে বৈশ্বিক স্বর্ণ আমদানি ও স্বর্ণ গহনা রফতানি—দুদিক থেকেই ভারতের অবস্থান শীর্ষে। দেশটিতে এখন প্রতিনিয়তই সম্প্রসারণ হচ্ছে স্বর্ণের কালোবাজার। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল (ডব্লিউজিসি) জানিয়েছে, এ মুহূর্তে বিশ্বব্যাপী গৃহস্থালি পর্যায়ে স্বর্ণের সবচেয়ে বড় মজুদ রয়েছে ভারতে। দেশটির পরিবারগুলোর কাছে জমা স্বর্ণের পরিমাণ কমপক্ষে ২৫ হাজার টন। বিয়ে, ধর্মীয় উৎসব ও পারিবারিক নানা অনুষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য দেশটিতে স্বর্ণের চাহিদা প্রতিনিয়তই বেড়ে চলেছে।
ক্রমবর্ধমান এ চাহিদার কারণে ভারত এখন বৈশ্বিক স্বর্ণ চোরাচালানের সবচেয়ে বড় গন্তব্য দেশ হয়ে উঠেছে। দেশটির ডিরেক্টরেট অব রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্সের তথ্য অনুযায়ী, চাহিদা অনেক বেশি হলেও ভারতে বৈধ পথে স্বর্ণ আমদানি করতে হলে বড় অংকের শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। এ কারণে দেশটিতে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের অনেকেই এখন পণ্যটি চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। আর দেশটিতে চোরাচালানকৃত স্বর্ণের সবচেয়ে বড় উৎস এখন বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। ভারতে এখন পর্যন্ত আটক করা পাচারকৃত স্বর্ণের ৭৩ শতাংশই এসেছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে। দেশটিতে চীন থেকে আসা স্বর্ণ চোরাচালান হচ্ছে মিয়ানমার হয়ে। আর মধ্যপ্রাচ্য-আফ্রিকাসহ অন্যান্য উৎস থেকে পাচার হওয়া স্বর্ণের সবচেয়ে বড় করিডোর এখন বাংলাদেশ।
যশোরের পার্শ্ববর্তী জেলা ঝিনাইদহের সীমান্ত দিয়েও প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে স্বর্ণ চোরাচালান হয় ভারতে। এ স্বর্ণ চোরাচালানে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এখানে খুনখারাবির ঘটনাও ঘটেছে অনেক। হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন এখানকার জনপ্রতিনিধিও। সর্বশেষ গত মে মাসে কলকাতায় ঝিনাইদহ-৪ আসনের তৎকালীন এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারের হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশ ও ভারতে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। সে সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে স্বর্ণ চোরাচালানে আধিপত্য বিস্তারের যোগসূত্র রয়েছে।
সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর মধ্যে স্বর্ণ পাচারের আরেক বড় রুট এখন চুয়াডাঙ্গা দিয়েও প্রচুর স্বর্ণ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে চুয়াডাঙ্গা-৬ বিজিবি ব্যাটালিয়নের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মেজর কাজী আসিফ ইকবাল বলেন, ‘সীমান্ত রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের। চোরাচালান রোধে আমরা আমাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে যাচ্ছি।’
বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর ৯১ হাজার ২৫০ কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে স্বর্ণ চোরাচালানের মাধ্যমে পাচার হয়ে যাচ্ছে। সমিতির মূল্য নির্ধারণ ও মূল্য পর্যবেক্ষণ স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান বলেন, ‘এ পরিসংখ্যান আমরা বিগত সরকারকে দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা এটি গ্রহণ করেনি। কেন করেনি সেটা এখন বুঝতে পারছি। বিগত সরকারের মধ্যে যারা এ পাচারের সঙ্গে যুক্ত ছিল তারাই এর পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। বিগত সরকার স্বর্ণ আমদানির যে নীতিমালা দিয়েছে সেখানে জটিলতা রয়েছে। বৈধ পথে স্বর্ণ আমদানির সুযোগ দেয়ার পাশাপাশি লাগেজের মাধ্যমেও স্বর্ণ আনার সুযোগ করে দেয়া হলো। এ দ্বৈত নীতি নেয়া হয়েছিল মূলত স্বর্ণ পাচারকে উৎসাহিত করার জন্য। এ ব্যাগেজ নীতিমালার মধ্য দিয়ে গত বছর ৫৪ টন স্বর্ণ দেশে এসেছে। পরে এর ৮০ শতাংশই দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের যে দাম তার সঙ্গে আমাদের দেশের দামের সমন্বয় থাকছে না।’
এমআই