ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির অর্থে সবুর খানের স্ত্রী-কন্যার নামে শেয়ার ক্রয়

বিগত সরকারের কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপির ঘনিষ্ঠতায় কোন জবাবদিহি ছাড়া সকল অনিয়ম ও দুর্নীতির মাত্রা অতিক্রম করেছেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. সবুর খান। তিনি ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) পরিচালক ও সাবেক সভাপতি ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির তৎকালীন বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্যকে অবৈধভাবে বাদ দিয়ে ইউজিসি থেকে দ্রুততম সময়ে রেজুলেশন বের করে দায়িত্ব ছিনিয়ে নেন প্রথম জীবনে কম্পিউটারের পার্টস বিক্রি করা এই সবুর খান। এরপর থেকেই তিনি শুরু করেন দেশের অন্যতম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় দুর্নীতি। পরিচালকসহ বিভিন্ন পদে স্বজনদের বসিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলের অর্থ ব্যক্তিগত খরচে ব্যবহার করতে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিকে অনিয়মের আখড়া বানিয়েছেন সবুর খান। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া টিউশন ফির অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে ব্যয় না করা, সরকারি জমি দখল, কর ফাঁকি, বিদেশে অর্থপাচার করে বাড়ি-ব্যবসা সবকিছুই করতে নানান কৌশল ও প্রতারণার আশ্রয় নেন তিনি। এছাড়াও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ড্যাফোডিল কম্পিউটার্সের বিষয়ে নানান অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে সবুর খানের বিরুদ্ধে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলের অর্থ বিনিয়োগ করে নিজের এবং স্ত্রী-কন্যার ব্যক্তিগত নামে একটি ওষুধ কোম্পানির বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনেছেন সবুর খান। এই তিনজনের নামে এরই মধ্যে নভো হেলথ কেয়ার অ্যান্ড ফার্মা লিমিটেডের ৫৭ দশমিক ৬ শতাংশ শেয়ার হস্তান্তর করা হয়েছে। যার মোট মূল্য ১৯ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর এই অর্থের পুরোটাই দেওয়া হয়েছে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংক হিসাব থেকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থীদের গবেষণা ও ব্যবহারিক শিক্ষার সুবিধার জন্য একটি ওষুধ কোম্পানির শেয়ার কেনার প্রস্তাব দেন সবুর খান। নভো হেলথ কেয়ারের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনায়ও এ বিষয়টি সামনে আনা হয়েছিল। তবে শেয়ার হস্তান্তরের চূড়ান্ত পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে সবুর খান, তার স্ত্রী সাহানা খান এবং মেয়ে সামিহা খানের নামে সব কাগজপত্র তৈরি করেন। চুক্তিপত্রে দেখা যায়, ওষুধ কোম্পানিটির মোট ৮ লাখ ৬৮ হাজার শেয়ারের মধ্যে ৪ লাখের মালিক এখন সবুর খান, যা মোট শেয়ারের ৪৬ দশমিক ০৮ শতাংশ। তার স্ত্রী সাহানা খান এবং মেয়ে সামিহা খানের নামে কেনা হয়েছে ৫০ হাজার করে মোট ১ লাখ শেয়ার। এই দুজন এখন কোম্পানিটির ৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ করে মোট ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ শেয়ারের অধিকারী। সব মিলিয়ে কোম্পানিটির ৫৭ দশমিক ৬ শতাংশ শেয়ারের মালিক এখন এই পরিবার।

জানা গেছে, প্রথম জীবনে কম্পিউটারের পার্টস বিক্রির ব্যবসা করা এই সবুর খান বিএনপি সরকারের আমলে খালেদা জিয়ার ভাগ্নে ও তৎকালীন বিএনপির প্রভাবশালী নেতা শাহরিন ইসলাম চৌধুরী তুহিনের বদৌলতে তার সঙ্গে যৌথভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপত্র সংগ্রহ করে। পরবর্তীতে ১/১১ এর পটপরিবর্তনের সময় বিএনপির সাথে সে সমস্ত সম্পর্ক ছিণ্ণ করার ঘোষণা দেয় এবং ইউজিসির তৎকালীন ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পাশ করা রেজুলেশনে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টির অন্যতম সদস্য বিএনপির নেতা শাহরিন ইসলাম চৌধুরী তুহিন বিদেশে চলে যাওয়ায়, এই সুযোগকে ট্রাস্টি বোর্ড থেকে অবৈধভাবে তাকে বাদ দিয়ে ইউজিসি থেকে দ্রুততম সময়ে পুণরায় রেজুলেশন বের করেন মো. সবুর খান।

বর্তমানে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি পরিচালনার জন্য রয়েছে ১১ সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ড। এর চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা মো. সবুর খান। পাশাপাশি তার স্ত্রী সাহানা খান ভাইস চেয়ারম্যান, কন্যা সামিহা খান, মা রওশন আরা বেগম এবং শ্যালক মো. ইমরান হোসেন ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হিসেবে রয়েছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুসারে, এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় হবে অলাভজনক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। ট্রাস্ট আইন অনুসারেও ট্রাস্টের কোনো সদস্য প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যক্তিগতভাবে সুবিধা নিতে পারবেন না। এদের মধ্যে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালকসহ বিভিন্ন পদে চাকরি করেন। যেখান থেকে তারা মাসে বেতন-ভাতা নেন। এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় সম্মানীর নামে অর্থ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে। যদিও আইন অনুযায়ী তাদের এসব সুবিধা নেওয়ার সুযোগ নেই।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো এটিকে দাতব্য প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ বোর্ড অব ট্রাস্টিজ এর অধিনে প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করতে হবে। এছাড়াও সিন্ডিকেট, একাডেমিকসহ আরো বেশ কিছু কমিটি থাকবে। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো বিশ্ববিদ্যালয়কে অবশ্যই অলাভজনক এবং দাতব্য মডেলে পরিচালনা করতে হবে। এসব শর্ত থাকা স্বত্তেও সে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র নিজের আত্মীয় স্বজনদের নিয়োগ দিয়ে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যান সবুর খানের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। একইসঙ্গে তার মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির জনসংযোগ কর্মকর্তা আনোয়ার হাবিব কাজলের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি অর্থসংবাদকে বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থীদের গবেষণা ও ব্যবহারিক শিক্ষার সুবিধার জন্য বোর্ড ট্রাস্টির কাছে একটা ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। এই প্রস্তাবনার প্ররিপ্রেক্ষিতে ট্রাস্ট্রি বোর্ড ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে। এ বিষয়ে গণমাধ্যমের একটি সংবাদের সূত্র ধরে ট্রাস্টি বোর্ড হাইকোর্টের শরণাপন্ন হয়। বিচারপতি মমতাজউদ্দিনসহ তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ গত জুন মাসের ২৭ তারিখে রায় দেয়। রায় অনুযায়ী, ওষুধ কোম্পানি টাকাটা ফেরত দেবে। এর সাথে বিশ্ববিদ্যালয় এবং ট্রাস্ট্রি বোর্ডের কোন সম্পর্ক থাকবে না।

অভিযোগ রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সবুর খানের শ্যালক-দুলাভাইসহ আত্মীয়-স্বজন নিয়োগ দিয়ে একক রাজত্ব্য কায়েম করেছেন। আত্মীয়করণের এই প্রক্রিয়ায় অযোগ্যদের হাতে পড়ে বিনষ্ট হচ্ছে একটি সম্ভাবনাময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দেশে আইটি শিক্ষার প্রসারে সরকারের অগ্রাধিকার থাকলেও এমন কিছু অযোগ্য মালিক ও কর্তৃপক্ষের হাতে পড়ে বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষার মানে নিম্নগামী হচ্ছে। তবে তথ্যপ্রযুক্তির ধুয়া তুলে উৎসাহী তরুণ-তরুণীর কাছ থেকে নিয়ে নিচ্ছে কাড়িকাড়ি টাকা।

এদিকে স্ক্যামের মহাযজ্ঞকে বাস্তবায়ণ করতে সবুর খান আরো প্রতিষ্ঠা করেন ড্যাফোডিল পরিবার। গ্রুপ অব কোম্পানির আদলে এই ড্যাফোডিল পরিবারে রয়েছে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রয়েছে ডিসিএল, ওভাল ফার্নিচার, ক্রিয়েটিভ ইন্টারন্যাশনাল, সবুজ প্রিন্টার্স, ডিওএল, বাংলাদেশ ভেঞ্চার ক্যাপিটাল লিমিটেড, স্কিল জবস, গ্রিন গার্ডেন, ড্যাফোডিল এডুকেশন নেটওয়ার্কসহ অনেক প্রতিষ্ঠান।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনোক্ষেত্রেই উন্মুক্ত টেন্ডার আহ্বান করা হয় না। মূলত এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই ফলস টেন্ডার সাবমিশনের মাধ্যমে কাজ পায় ড্যাফোডিল পরিবারেরই কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠান। যার মাধ্যমে বাজারমূল্যের থেকে বেশি দামে পণ্য কিংবা সেবা দেখিয়ে সরানো হয় বিশ্ববিদ্যালয় ফান্ডে জমা পড়া শিক্ষার্থীদের টাকা।

এমআই

শেয়ার করুন:-
শেয়ার