ক্যাটাগরি: সারাদেশ

সমবায় ব্যাংকের ৭৩৯৮ ভরি স্বর্ণ বিক্রি করে দেন আ. লীগ নেতা

সমবায় ব্যাংকে সোনা জমা বা বন্ধক রেখে ঋণ নিয়েছিলেন সাধারণ গ্রাহকেরা। গ্রাহকদের সেই সম্পদ ভুয়া মালিক সাজিয়ে বিক্রি করে দিয়েছেন ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান। তাঁর নাম মহিউদ্দিন আহমেদ, যিনি যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এখন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের (দক্ষিণ) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।

নথিপত্র বলছে, সমবায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকার সময় ২০২০ সালে মহিউদ্দিন আহমেদ মোট ৭ হাজার ৩৯৮ ভরি সোনা বিক্রি করে দেন, যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ব্যাংকটির ২ হাজার ৩১৬ জন গ্রাহক।

সোনা বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনা তদন্ত শুরু করেছিল পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, যাদের অধীনে সমবায় ব্যাংক পরিচালিত হয়। সমবায় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, সেই তদন্ত প্রভাব খাটিয়ে থামিয়ে দেন মহিউদ্দিন আহমেদ। ২০২১ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সোনা বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনায় মামলা করে। মামলার এজাহারে ৯ আসামির মধ্যে মহিউদ্দিনের নাম ছিল ১ নম্বরে। তবে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অভিযোগপত্র থেকে নিজের নামটিও বাদ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন তিনি।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মহিউদ্দিন আহমেদ আত্মগোপনে চলে গেছেন।

সমবায় ব্যাংকে গচ্ছিত সোনা বিক্রি করে দেওয়ার বিষয়টি আবার সামনে এসেছে অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার ও সমবায় উপদেষ্টা হাসান আরিফের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। গত রোববার কুমিল্লার কোটবাড়ীতে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘সমবায় ব্যাংকের অবস্থা দেখতে গিয়ে জানলাম, ১২ হাজার ভরি (দুদকের মামলায় ৭ হাজার ৩৯৮ ভরি) সোনার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। যাঁরাই এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার মন্তব্যের পর নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়েছে সমবায় ব্যাংকে সোনা বন্ধক রাখা গ্রাহকদের মধ্যে। গত সোমবার ও গতকাল মঙ্গলবার মতিঝিলে সমবায় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনেক গ্রাহক জড়ো হন। অনেকে বন্ধক রাখা সোনা দেখানোর দাবি করেন।

সমবায় ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক আহসানুল গনি বলেন, এটা ঠিক যে ২০২০ সালে বন্ধককৃত সোনা বিক্রি নিয়ে অনিয়ম হয়েছে। দুদকের প্রতিবেদনেও তা উঠে এসেছে।

সাবেক চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন গ্রাহকদের এই সোনা বিক্রি করেছেন, যার বর্তমান বাজারমূল্য ১০০ কোটি টাকা।
যেভাবে জালিয়াতি
সমবায় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের তফসিলভুক্ত কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংক নয়। এটি বিশেষায়িত ব্যাংক। পরিচালিত হয় পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অধীনে।

সমবায় ব্যাংকে সোনা বন্ধক রেখে ঋণ নেওয়া যায়। প্রতি ভরি খাঁটি সোনার (খাদ বাদে) বিপরীতে এখন ৫৫ হাজার টাকা ঋণ পাওয়া যায়। সুদের হার ১৭ শতাংশ। বাড়তি ১ শতাংশ বিমা খরচ দিতে হয়। ঋণ নেওয়ার পর সুদ ও আসল টাকা পরিশোধ করে সোনা ফেরত নিতে পারেন গ্রাহকেরা। নিয়ম অনুযায়ী, কোনো গ্রাহক নির্ধারিত সময়ে ঋণের টাকা শোধ করতে না পারলে বন্ধক রাখা সোনা নিলামে বিক্রি করা যায়।

দুদকের মামলার এজাহার বলছে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর সময়ে সমবায় ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ বন্ধক রাখা সোনা নিলামে না তুলে ভুয়া মালিক সাজিয়ে বিক্রি করে দেন। এ ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি করা হয়। মহিউদ্দিন আহমেদকে জালিয়াতিতে সহায়তাকারীদের একজন সমবায় ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার (ক্যাশ) নুর মোহাম্মদ। তিনি মহিউদ্দিন আহমেদের ভাগনে। দুদকের মামলায় নুর মোহাম্মদ ৬ নম্বর আসামি। মামলাটি এখন বিচারাধীন।

মহিউদ্দিন আহমেদ সমবায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান হন ২০০৯ সালে। তখন তিনি যুবলীগের নেতা ছিলেন। সমবায় সমিতি আইনে ব্যাংকের চেয়ারম্যানের তিন মেয়াদের বেশি থাকার সুযোগ নেই। সে হিসাবে চেয়ারম্যানের পদ থেকে তাঁর ২০১৮ সালে বিদায় নেওয়ার কথা। যদিও ব্যাংকের চেয়ারম্যানের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি। ২০২২ সালে তিনি সমবায় ব্যাংক থেকে বিদায় নেন।

দুদকের মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০২০ সালে মতিঝিলে সমবায় ব্যাংকের সদর দপ্তরে জমা রাখা সোনা ফেরত নিতে অনেক গ্রাহক আবেদন করেন। এর মধ্যে ৪৫৫টি আবেদন যাচাই-বাছাই করে দুদক। তাতে দেখা যায়, ৩৩৫টি আবেদনপত্রে মূল নথিপত্রের সঙ্গে স্বাক্ষর ও জাতীয় পরিচয়পত্রের মিল নেই। অর্থাৎ, ভুয়া মালিক সাজিয়ে সোনা ফেরত নেওয়া হয়েছে বলে দেখানো হয়েছে। পরে সেই সোনা বিক্রি করে দেওয়া হয়। সেখান থেকে ব্যাংকের প্রাপ্য টাকা পরিশোধ করে বাকি অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।

জালিয়াতি করে ঢাকা সমবায় অফিসে বিক্রি করা হয়েছে ১ হাজার ৫৯৪ ভরির কিছু বেশি সোনা। অন্যদিকে সমবায় ব্যাংকের সদস্য প্রতিষ্ঠান নারায়ণগঞ্জ কো-অপারেটিভ ক্রেডিট লিমিটেড সোনা বন্ধক রেখে ঋণ দেওয়ার কার্যক্রম পরিচালনা করে। সেখানকার সোনা পুনঃ বন্ধক রাখে সমবায় ব্যাংক। দুদকের মামলার এজাহার বলছে, নারায়ণগঞ্জ কো-অপারেটিভ ক্রেডিট লিমিটেডের ৫ হাজার ৮০৩ ভরির কিছু বেশি সোনা একই কৌশলে বিক্রি করে দেন মহিউদ্দিন আহমেদ।

দুদকের মামলার এজাহার অনুযায়ী, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ২ হাজার ৩১৬ জন গ্রাহকের ৭ হাজার ৩৯৮ ভরি সোনার তৎকালীন বাজারমূল্য ছিল ৪০ কোটি টাকার বেশি। এর বিপরীতে ঋণের সুদ ও আসল ছিল প্রায় ২৯ কোটি টাকা। এই টাকা পরিশোধ দেখিয়ে ১১ কোটি টাকা ৪০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়।

নারায়ণগঞ্জ কো-অপারেটিভ ক্রেডিট লিমিটেডে ২০১১ সালে আট ভরি সোনা বন্ধক রেখে ৯৩ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন রাজধানীর স্বামীবাগ এলাকার বাসিন্দা কাকলি জাহান। পরে ঋণের সুদ ও আসল বাবদ ১ লাখ ২০ হাজার টাকা জমা দিয়ে সোনা ফেরত আনতে গেলে তাঁকে তা দেওয়া হয়নি। এক বছর ধরে ঘুরছেন তিনি।

কাকলি জাহানের জমা রাখা সোনার এখনকার বাজারমূল্য প্রায় ১০ লাখ ৮০ হাজার টাকা। তিনি সমিতিতে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা জমা দিয়েছিলেন। কোনোটাই ফেরত পাচ্ছেন না। গতকাল বিকেলে তিনি বলেন, ‘সমবায় ব্যাংকে আমার কিছু সোনা বন্ধক রাখা আছে। সমবায় উপদেষ্টার বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, সেটাও বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।’

শেয়ার করুন:-
শেয়ার