ক্যাটাগরি: পুঁজিবাজার

সুকুক বন্ডের নামে বড় কারসাজি সালমান এফ রহমানের

২০২১-২২ সময়ে যেন সহসাই আলাদিনের চেরাগ পায় গ্রেপ্তারকৃত সালমান এফ রহমানের ফ্ল্যাগশিপ প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো লিমিটেড। এই কোম্পানির মূল ব্যবসা টেক্সটাইল। আলোচ্য সময়ে, অর্থাৎ মাত্র দুই বছরেই তাদের রাজস্ব ১ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা থেকে আকাশচুম্বী হয়ে পৌঁছায় ৭ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকায়।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, ওই একই বছরে বেক্সিমকো তাদের ২০০ মেগাওয়াট তিস্তা সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প, ৩০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং টেক্সটাইল শিল্পের আরো যন্ত্রপাতির অর্থায়নের জন্য প্রথম সুকুক বন্ড চালু করে।

বিশ্লেষকরা এখন মনে করছেন, বেক্সিমকোর কথিত এই ‘ব্যবসায়িক পারদর্শিতা’ ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করেন সালমান, তাতে বাড়ে কোম্পানির শেয়ারদরও। এসবই ছিল সুকুক বন্ডে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার কৌশল।

২০২১ সালের শেষে বাজার থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা সুকুকের মাধ্যমে উঠিয়ে নেন সালমান, তারপর থেকেই বেক্সিমকোর সেই অত্যাশ্চর্য পারফরম্যান্সও যেন উবে যায়। এমনকি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সালমানের পুরো দুনিয়া উল্টে যাওয়ার আগে থেকেই কোম্পানিটির বিক্রি ও মুনাফায় ধস নেমেছিল।

২০২২-২৩ অর্থবছরে বিক্রি বা রাজস্ব সামান্য হ্রাসের কথা জানালেও, পরের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসেই তা ৬৩ শতাংশ কমার কথা জানায় বেক্সিমকো লিমিটেড। আর মুনাফায় পতন হয় ৯০ শতাংশ। ফলে যে শেয়ারদর মাত্র ২৬ মাসেই ১৪ টাকা থেকে বেড়ে ১৮০ টাকা ছাড়িয়েছিল– এখন তা ১১৫ টাকা ৬০ পয়সা দরে রয়েছে ফ্লোর প্রাইসের কৃত্রিম বাধার কারণে। ফ্লোর প্রাইস বা মূল্যসীমা উঠে যাওয়া মাত্রই শেয়ারদরও ধস নামার অপেক্ষায় রয়েছে।

অতিরঞ্জন ও কারসাজি

২০২০-২২ সময়ে শেয়ারধারীদের উদ্দেশ্যে দেওয়া বিবৃতিতে বেক্সিমকো লিমিটেডের চেয়ারম্যান বারবার কোম্পানির রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধিসহ অন্যান্য নানান অগ্রগতির কথা বলেছেন, পিপিই’র সম্ভাবনাকে যা আরো বাড়াবে। এসবই বলা হয় বিনিয়োগকারীদের প্রলুদ্ধ করতে।

তবে এসব বিবৃতিতে টেক্সটাইল, তথ্যপ্রযুক্তি, প্রকৌশল বা অন্যান্য কোন খাত থেকে কত বিক্রি বা রাজস্ব আসছে তা প্রকাশ করা হয়নি। দেওয়া হয়নি কোম্পানির রপ্তানি বা স্থানীয় বিক্রির (রাজস্বের) পৃথক পরিসংখ্যান। অথচ এসিআই লিমিটেডসহ পুঁজিবাজারের পাবলিক ট্রেডিংয়ে থাকা সব শিল্পগোষ্ঠী এসব বিবরণ প্রকাশ করে থাকে।

বছরে ৪০ থেকে ৫০ কোটি ডলারের রপ্তানি করার যে দাবি সালমান এফ রহমান করেছিলেন– সেটির স্বপক্ষে কোনো স্পষ্ট ও বিস্তারিত তথ্যপ্রকাশ করেনি বেক্সিমকো লিমিটেড, যা করা হলে প্রবৃদ্ধির বানোয়াট কাহিনির আড়ালে প্রকৃতপক্ষে তারা কতটুকু লাভবান হবেন– তা বিনিয়োগকারীরা জানতে পারতেন। তবে বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীরা এসব কাহিনিকে বরাবরই সন্দেহের চোখে দেখেছেন।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং চার্টার্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালিস্ট মো. মনিরুজ্জমান বলেন, বছরের পর বছর ধরে অনেক কোম্পানি একত্রিত করে বেক্সিমকো লিমিটেড একটি জটিল কাঠামো পেয়েছে, এবং সেগমেন্টাল ব্রেকডাউন (খাতভিত্তিক ব্যাখ্যা) ছাড়া এর রিপোর্টিং স্বচ্ছ নয়।

তিনি বলেন, “আমরা, বিশ্লেষক হিসাবে, তালিকাভুক্ত সেইসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা দিতে শিখেছি– যাদের একই ধরনের ব্যবসার জন্য স্পন্সর-পরিচালকদের একাধিক সত্তা রয়েছে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এসব প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের খেয়ালখুশির ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হন। তখন সাধারণ বিনিয়োগকারী ঠকবেন না জিতবেন– সেটা নির্ভর করে উদ্যোক্তাদের মর্জির ওপর।”

২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বেক্সিমকো লিমিটেডের রপ্তানির কাস্টমস মূল্যায়ন ছিল মাত্র ৪০ কোটি টাকা। ফলে রপ্তানির বিষয়ে কোম্পানির চেয়ারম্যানের দেওয়া ইতিবাচক বিবৃতি যেসব বিনিয়োগকারী পড়েছেন– তাঁদের ভ্রু-কুঞ্চিত হওয়ারই কথা।

গ্রুপের হাজার হাজার রপ্তানি চালানের মধ্যে মাত্র ৫৭টি ছিল বেক্সিমকো লিমিটেডের। এক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, গোপনে রপ্তানি আয় নিজেদের পকেটে ভরতে সালমান ও তার সহযোগীদের মালিকানায় ছিল অন্তত ৩১টি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান, যারা বিজিএমইএ’র সদস্য।

এরমধ্যে ৩০টি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে সারাবো, কাশিমপুর, গাজীপুরে তাদের কারখানার ঠিকানা থেকে, যেখানে বেক্সিমকো শিল্প পার্ক অবস্থিত।

গত ১৮ সেপ্টেম্বরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এধরনের ১৭টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৮৩ মিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগে সালমান এফ রহমানসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে ১৭টি মামলা করেছে। তবে বেক্সিমকোর কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, আর্থিক দুরবস্থায় থাকা বিদেশি বায়ারদের কাছে এসব প্রতিষ্ঠানের ১৩৫ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় আটকে ছিল, তবে বায়াররা এরমধ্যেই কিস্তিতে ৫০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে।

এবিষয়ে জানার জন্য বেক্সিমকো লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওসমান কায়সার চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বেক্সিমকো লিমিটেডের মালিকানায় আছে মূলত গ্রুপের টেক্সটাইল উইং, পোশাক উৎপাদনকারী অংশটা নয়– যারা তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। আমাদের টেক্সটাইল বিভাগের রপ্তানিকে ‘ডিমড এক্সপোর্ট’ বা প্রচ্ছন্ন রপ্তানি হিসেবে গণ্য করা হয়।

তিনি বলেন, রপ্তানিখাতের সাফল্য নির্ধারণ করে দেয় বস্ত্র উৎপাদনকারীদের মতো ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প। বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে ভালোই করছিল। করোনা মহামারীর সময়েও ভালোই করেছে। তবে বিদেশি ক্রেতাদের ওপর মহামারির বড় প্রভাব ছিল, তারপরেই আবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু হলে যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়– তার মিলিত প্রভাব পরে বিদেশি ক্রেতাদের ওপর, যা বেক্সিমকোর ব্যবসাকেও টেনে নামায়।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) জানিয়েছিল, বাংলাদেশ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে পোশাক রপ্তানিতে ২.৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। পরে জানা যায়, ইপিবি রপ্তানির তথ্য বাড়িয়ে দেখিয়েছে, ফলে বছরওয়ারি হিসেবে প্রকৃতপক্ষে রপ্তানি কিছুটা কমেছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।

নতুন চালু হওয়া সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে কয়েকশ কোটি টাকা আয়ের পরেও – বেক্সিমকোর রাজস্ব ৬৩ শতাংশ ছিল – তাদের বিনিয়োগকারীদের জন্য সবচেয়ে বড় ধাক্কা।

বেক্সিমকোর কোম্পানি সচিব আসাদ উল্লাহ এরজন্য করোনা মহামারি পরবর্তী সময় ও ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করেন। এসব সংকট তাদের ব্যবসা কমার পেছনে দাবি করে তিনি বলেন, ‘কঠিন সময়ে প্রবৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করা হলে তাতে হিতে-বিপরীত হতে পারে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং ও ইনফরমেশন সায়েন্সের সহযোগী অধ্যাপক ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ আল আমিন বলেন, “ওই সময়ে বেক্সিমকোর একটি উজ্জ্বল চিত্র সবার সামনে তুলতে সালমানের আপ্রাণ চেষ্টা এবং পুঁজিবাজারে দর উত্থানের পুরো বিষয়টি এখন স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে।”

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সার্ভেইল্যান্স রিপোর্ট উঠে এসেছিল, কীভাবে সালমান ও তার গোপন কোম্পানিগুলো এবং সহযোগীদের মাধ্যমে কারসাজি করে বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারদরের ব্যাপক উল্লম্ফন ঘটান, আবার বিক্রিতে ব্যাপক মুনাফা করেন।

আল আমিন বলেন, কোম্পানির শেয়ারদর উচ্চ থাকা সালমানের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ এটা দেখিয়েই তিনি তার সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের সুকুক বন্ডে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করেন। হাসিনার সরকার এই প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ কেনার দাম সর্বোচ্চ রেখে প্রতি মেগাওয়াটে ১৫ সেন্ট নির্ধারণ করেছিল।

“একই ধরনের অন্য প্রকল্প থেকে সরকার যখন মাত্র ১০ সেন্টেই বিদ্যুৎ কিনেছে, তখন কেন এই প্রকল্পের বিদ্যুৎ এমন আকাশচুম্বী দরে কিনতে হবে– আমি তার কোনো যুক্তি খুঁজে পাই না। এমনকী বাংলাদেশের সমকক্ষ অন্যান্য অর্থনীতির সৌরবিদ্যুতের চেয়ে এই দাম অনেক বেশি।”

দশকের পর দশক ধরে একই নিরীক্ষক

এম জে আবেদিন অ্যান্ড কোম্পানি নামের কেবল একটি নিরীক্ষক সংস্থাকেই দশকের পর দশক ধরে টানা ব্যবহার করে এসেছে বেক্সিমকো লিমিটেড। অথচ বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) টানা তিন বছর একই নিরীক্ষকের সই করা বার্ষিক বিবৃতির ক্ষেত্রে নিষেধ রয়েছে।

বেক্সিমকোর কোম্পানি সচিব আসাদ উল্লাহ বলেন, এবিষয়ে একটি রিট আবেদন করে অনেক আগেই আদালত থেকে স্থগিতাদেশ পেয়েছিল বেক্সিমকো।

বেক্সিমকো লিমিটেডের অ্যাকাউন্ট যাচাই করা চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হাসান মাহমুদ বলেন, “স্থগিতাদেশের ফলে আমরা দীর্ঘসময় ধরে একটি মক্কেলের সেবা করতে পেরেছি। কেন আমাদের একটা পুরনো মক্কেলের সঙ্গে সম্পর্ক হারাতে হবে?

কোম্পানিটি যেমনটা চেয়েছে, সেভাবেই অডিট হয়েছে এমন অভিযোগের কোনো জবাব না দিয়ে তিনি পাল্টা প্রশ্ন রাখেন, “তাহলে বিএসইসি আদালতে কেন যথেষ্ট তৎপর হয়নি?

এবিষয়ে বিএসইসি’র পরিচালক ও মুখপাত্র ফারহানা ফারুকী জানান, নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির সাম্প্রতিক সময়ের পরিবর্তিত নেতৃত্ব এসব বিষয়ে কাজ করছে।

সালমানের পেশির জোর

আর্থিক বাজারে সালমানের স্বেচ্ছাচারিতা দেখে– সতর্ক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বেক্সিমকোর ফুলেফেঁপে বাড়তে থাকা শেয়ারে বিনিয়োগের বিষয়ে ইতস্তত করছিলেন, একইভাবে অতি উচ্চ মুনাফার সুকুক বন্ডের বিষয়েও দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। তবে অভিযোগ আছে, এসব বিনিয়োগকারীদের অনেককেই সুকুক কিনতে চাপ দিয়ে বাধ্য করানো হয়, এছাড়া তাদের সামনে অন্য বিকল্পও ছিল না।

জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে চাপ দিয়ে সুকুক বন্ড কিনতে বাধ্য করেন সালমান। হাসিনার সরকার পতনের পরে– সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন বলেছিলেন, ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার ব্যাংককে ৩০০ কোটি টাকার সুকুক বন্ড কিনতে বাধ্য করা হয়েছিল। আরো অনেক প্রতিষ্ঠানেরও একই অভিযোগ রয়েছে।

শীর্ষস্থানীয় একটি ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানের একজন প্রধান নির্বাহী বলেন, কম-মূল্যায়িত মনে করে প্রথমে তারা প্রায় ২০ টাকায় বেক্সিমকোর প্রতিটি শেয়ার কিনেছিলেন। কিন্তু মাত্র এক বছরের কম সময়ে শেয়ারদর যখন ১০০ টাকায় পৌঁছায়, তখন তারা বিক্রির চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু, সালমান ও বিএসইসির কর্মকর্তাদের চাপের মুখে সেগুলো তারা ধরে রাখতে বাধ্য হন।

নাম না প্রকাশের শর্তে তিনি বলেন, “কিছু শেয়ার আমাদের বাইব্যাক (বিক্রির পর আবারো কিনে নিতে) করতে হয়। কথিত রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার ধুয়া তুলে আমার কোম্পানিকে হয়রানি করা হয়।” এখন তার প্রতিষ্ঠান ও তাদের গ্রাহকদের অনেকেই বিপুল সংখ্যক বেক্সিমকোর শেয়ার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন, কারণ ফ্লোরপ্রাইসের কারণে বিক্রি করে বেরিয়েও যেতে পারছেন না।

বিনিয়োগকারীদের দুর্ভাগ্য

বিশ্লেষকরা মনে করেন, পাঁচ বছর মেয়াদি সুকুক বন্ডের স্কিম এমনভাবে করা হয়– যাতে সালমান এফ রহমান লাভবান হন, অন্যদিকে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে এতে বিনিয়োগকারীরা।

সুকুকের শর্ত অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো এক মাসের গড় বাজার মূল্যের ২৫ শতাংশ ছাড়ে বার্ষিক তাদের মূলধনের ২০ শতাংশ বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারে রূপান্তর করতে পারবে। অর্থাৎ, বেক্সিমকো শেয়ারের গড় মূল্য ১০০ টাকা হলে বিনিয়োগকারীরা সেগুলো ৭৫ টাকায় কিনতে পারবে।

শেয়ারে রুপান্তরের এই অপশনের সাথেই সম্পর্কিত এই স্কিম বিক্রি ও শেয়ারদর ব্যাপকভাবে বাড়ার ঘটনা। রুপান্তরের সময় শেয়ারদর চড়া থাকলে– বিদ্যমান শেয়ারগুলো ততোটা মূল্য হারাতো না। তবে দাম কমলে, বিনিয়োগকারীরা আরো শেয়ার পেতেন, এতে স্পন্সর-পরিচালকদের নিয়ন্ত্রণ কমে যেত– কারণ নিজ কোম্পানির মাত্র ৩০ শতাংশ শেয়ার ছিল বেক্সিমকোর স্পন্সরদের হাতে।

এদিকে কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে ফ্লোরপ্রাইসের কারণে বেশিরভাগ বিনিয়োগকারীই তাদের কাছে থাকা সুকুক শেয়ারে রুপান্তরের বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, কারণ তারা মনে করেছিলেন এটা বেক্সিমকোর প্রকৃত মূল্যায়ন নয়। ফলে তাদের আশঙ্কা ছিল, একবার ফ্লোরপ্রাইস উঠিয়ে নিলেই– রুপান্তরের ক্ষেত্রে যে ২৫ শতাংশ ছাড় দেওয়া হচ্ছে, শেয়ারদর তার চেয়েও কমে যাবে।

চালুর সময় সুকুক খুবই আকর্ষণীয় সুযোগ অফার করে, যেখানে কুপন পেমেন্ট ছিল ন্যূনতম ৯ শতাংশ। আর বেক্সিমকো যদি কখনো ৯ শতাংশের বেশি ডিভিডেন্ট বা লভ্যাংশ দেয়– তাহলে কুপনের সাথে ১০ শতাংশ ডিফারেন্সিয়াল যোগ হবে।

তবে ফ্লোর প্রাইস আরোপের কারণে সুকুকের পুরো ধারণাটি ভেঙে যায়, যার ফলে বিনিয়োগকারীদের জন্য বন্ডটি অকার্যকর হয়ে পড়ে।

বেক্সিমকো গ্রিন সুকুকের আল ইসতিসনা ইউনিট শুরুতে ১০০ টাকা মূল্যায়িত হয়েছিল, জুলাইয়ের শেষে যা ৭৫ টাকায় নেমে আসে, আর এখন নেমেছে ৪০ থেকে ৫৩ টাকায়। শিল্পের অভ্যন্তরীণরা দাবি করেন, সালমান ও শিবলী মিলে ইস্যু ম্যানেজার, ট্রাস্টি ও বিনিয়োগকারীদের চাপ দিয়ে এই বন্ড চালুর পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেছেন। এবছরের শুরুর দিকে, আরেকটি জিরো কুপন বন্ডের মাধ্যমে বেক্সিমকোকে ১ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের অনুমোদনও দেয় বিএসইসি।

রাজধানীর একটি কলেজের শিক্ষক ইফতেখার আহমেদ। সুকুক বন্ড কিনে তিনিও বেক্সিমকোর শেয়ার রুপান্তর করেছিলেন। এখন সেই সিদ্ধান্তের জন্য অনুতাপ করছেন। কারণ তার আশঙ্কা ফ্লোরপ্রাইস উঠে যাওয়া মাত্রই শেয়ারের দরপতনের ফলে– হারাবেন তার বিনিয়োগ করা মূলধনের বেশিরভাগই।

ইফতেখারের মতো বিনিয়োগকারীরা এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না, ১০০ টাকা ফেসভ্যালুর বেক্সিমকোর গ্রিন সুকুক আল ইসতিসনা ইউনিট মাত্র ৪০ থেকে ৫৩ টাকার আওতায় নেমেছে, জুলাইয়ের সেশেও যেটা ছিল ৭৫ টাকা।

বিনিয়োগকারীদের রক্ষার উপায়

সুকুকের ট্রাস্টি– ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)-র চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত বেক্সিমকো লিমিটেডে আংশিক মালিকানা রয়েছে সালমান ও তার পরিবারের সদস্যদের। বেশিরভাগ মালিকানায় হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীর। তাই এ কোম্পানি বা সুকুকধারীদের সম্পদকে নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না।

শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর পঞ্চগড়ে নির্মাণাধীন ৩০ মেগাওয়াটের সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বেক্সিমকোর কয়েকটি শিল্প পার্ক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের শিকার হয়েছে। এতে কোম্পানিটির কয়েকশ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বেক্সিমকোর কর্মকর্তারা।

আবু আহমেদ বলেন, “আমি সবাইকে অনুরোধ করছি, যারা দোষী তাদের প্রত্যেককে বিচার করতে হবে, কিন্তু তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করবেন না।”

বেক্সিমকোর ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল্যায়ন করা হয়েছিল ২ হাজার কোটি টাকা, ডলার ও জমির দাম বাড়ার কারণে এখন তা আরো বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জমির মালিক কোম্পানি। আবার স্পেশাল পারপাস ভেহিকেলের (এসপিভি) ভিত্তিতে সুকুকের মাধ্যমে কেনা টেক্সটাইলের যন্ত্রপাতির মালিক সুকুকের বিনিয়োগকারীরা।

আবু আহমেদ বলেন, সরকারের থেকে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের যে বিল পাওয়া যাবে, তা কুপনের অর্থ পরিশোধের জন্য যথেষ্ট হবে। এখন এই বিল গ্রহণ করছে ট্রাস্টি।

বেক্সিমকো যাতের জমির মালিকানা এসপিভিকে দেয় ট্রাস্টি সেই চেষ্টা করছে, তারা সব অর্থ পরিশোধ করলে জমি আবার ফেরত দেওয়া হবে। তবে সেটা যদি তারা না করতে পারে, সেক্ষেত্রে এসপিভির মালিকানাধীন সম্পদ বিক্রি করতে পারে ট্রাস্টি।

সূত্রগুলো জানিয়েছে, ট্রাস্টির নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিপূরক তহবিলে প্রতি মাসে ৫ কোটি টাকা না দিয়ে ট্রাস্টের চুক্তি লঙ্ঘন করেছে বেক্সিমকো।

কোনো বন্ড বা দেনা পরিশোধের জন্য যে অর্থ আলাদা করে বা সঞ্চিত রাখা হয় সেটাই হলো প্রতিপূরক তহবিল বা সিঙ্কিং ফান্ড। কারণ যে কোম্পানি বন্ড জারি করে মূলধন সংগ্রহের মাধ্যমে দায় সৃষ্টি করে, সেটা তাঁদের ভবিষ্যতে পরিশোধও করতে হয়। প্রতিপূরক তহবিল সেক্ষেত্রে সহায়ক হয়।

আবু আহমেদ জানান, ট্রাস্টিও এই তহবিলে নিয়মিত পেমেন্টের চেষ্টা করছে।

এমআই

শেয়ার করুন:-
শেয়ার