ক্যাটাগরি: জাতীয়

মেট্রো স্টেশন মেরামতে ৩৫০ নয়, ১৩৮ কোটি টাকায় সম্ভব

বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলার সময় হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০ মেট্রো স্টেশন সংস্কার করে পুনরায় চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে কাজীপাড়া স্টেশনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে বলে জানিয়েছেন শীর্ষ কর্মকর্তারা। স্টেশনটি চালুর বিষয়ে সপ্তাহখানেকের মধ্যেই আনুষ্ঠানিক একটি ঘোষণা আসতে পারে বলে জানা গেছে।

একইভাবে, দ্রুত সংস্কারের চেষ্টা চলছে মিরপুর-১০ মেট্রো স্টেশনের। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ওই স্টেশনটিও যাত্রীদের ব্যবহারের জন্য খুলে দেওয়া সম্ভব হবে বলে জানিয়েছে মেট্রোরেল পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।

অথচ গত ১৯ জুলাই হামলার ঘটনার পর আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল যে, ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশন দু’টি সংস্কার করে পুনরায় সচল করতে কমপক্ষে এক বছর সময় লাগবে।

“মেট্রোরেলের কাজীপাড়া ও মিরপুর ১০ স্টেশন ধ্বংসপ্রাপ্ত। এক বছরেও যন্ত্রপাতি এনে সচল করা সম্ভব হবে না বলে এক্সপার্টরা জানিয়েছে,” গত ২৭ জুলাই সাংবাদিকদের বলেন সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

এছাড়া স্টেশন দু’টি মেরামত করতে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার মতো খরচ হবে বলেও তখন সরকারি প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল।

যদিও নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর কর্মকর্তারা এখন জানাচ্ছেন যে, স্টেশন সংস্কারে এত বিপুল অর্থের প্রয়োজন পড়বে না। তাহলে মেট্রোরেলের ক্ষতিগ্রস্ত দুই স্টেশন সংস্কারে শেষমেশ ঠিক কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে? তাছাড়া এত কম সময়ের মধ্যেই-বা স্টেশনগুলো চালু করা সম্ভব হচ্ছে কীভাবে?

কোন স্টেশনে কেমন ক্ষতি?

কোটা আন্দোলন চলাকালে গত ১৮ই জুলাই মিরপুর ১০ নম্বর মেট্রো স্টেশনের নিচে পুলিশ বক্সে ভাঙচুর করে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। ফলে সেদিন বিকেলে অনির্দিষ্টকালের জন্য মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে ডিএমটিসিএল। এর পরের দিন মিরপুর-১০ এবং কাজীপাড়া স্টেশনে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনার পর ক্ষয়-ক্ষতি নিরূপণে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে কর্তৃপক্ষ।

কিন্তু আন্দোলন ও সহিংসতার মুখে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হওয়ায় তখন কমিটির সদস্যরা ঠিকমত কাজ করতে পারেননি। পরে গণআন্দোলনের মুখে গত পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর আটই অগাস্ট ক্ষমতা গ্রহণ করে অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর তদন্ত কাজ শেষ করে ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ সহকারে সম্প্রতি সরকারের কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন কমিটির সদস্যরা।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, হামলায় মেট্রোরেলের দুই স্টেশনে টিকেট কাটার ভেন্ডিং মেশিন থেকে শুরু করে ব্যবহৃত কম্পিউটার, অফিস কক্ষ, দরজা-জানালার কাচ, ম্যাস র‍্যাপিড ট্রানজিট কার্ড, টিকেট পাঞ্চ করার দরজা, ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসিটিভি) ইত্যাদি ক্ষতি হয়েছে।

তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মিরপুর-১০ মেট্রো স্টেশন। সেখানে টিকিট কাটার জন্য রাখা ছয়টি ভেন্ডিং মেশিনের প্রায় সবগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

এছাড়া ডিএমটিসিএলের কর্মীরা সশরীরে যেসব কাউন্টারে টিকিট বিক্রি করতেন, সেগুলোতে ভাঙচুর চালানো হয়েছে। একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, স্টেশনের দু’দিকে থাকা এক ডজনেরও বেশি স্বয়ংক্রিয় দরজা।

সেই তুলনায় বরং কাজীপাড়া স্টেশনে কিছুটা কম ক্ষতি হয়েছে। হামলায় ওই স্টেশনের একপাশের ভেন্ডিং মেশিন, টিকিট কাটার কাউন্টার এবং যাত্রীদের আসা-যাওয়ায় ব্যবহৃত কিছু স্বয়ংক্রিয় দরজা ভাঙচুর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

“তুলনামূলক কম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আমরা কাজীপাড়া স্টেশনটির সংস্কারকাজ শেষ করে দ্রুত চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি,” বলেছেন ডিএমটিসিএলের নবনিযুক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আবদুর রউফ। তবে মিরপুর-১০ মেট্রো স্টেশন চালু করতে বেশ কয়েক মাস সময় লাগবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

গত ১৯শে জুলাইয়ের হামলায় মেট্রোরেলের কাজীপাড়া স্টেশনে অবকাঠামোগত যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেটি পূরণে প্রায় একশ কোটি টাকা খরচ হবে বলে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে জানিয়েছিল ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর এখন জানা যাচ্ছে যে, স্টেশনটি সংস্কারে এক কোটি টাকাও খরচ হচ্ছে না।

“স্টেশনটি ঠিকঠাক করতে আপাতত আমাদের খুব মিনিমাম একটা অর্থ ব্যয় হচ্ছে। তবে সেটা কোটির ঘরে যাবে না, কোটির মধ্যেই থাকবে,” বলছিলেন ডিএমটিসিএলের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা।

অন্যদিকে, মিরপুর ১০ স্টেশনের যেসব যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়েছে, সেগুলো আমদানি করতে হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি আনতে বেশ কয়েক মাস সময় যেমন লাগবে, তেমনি বেশ খরচেরও প্রয়োজন হবে। তবে ঠিক কত টাকা ব্যয় হতে পারে, সেটির চূড়ান্ত হিসাব এখনও নির্ধারিত হয়নি।

“এটা নির্ভর করছে যন্ত্রপাতিগুলোর কোনটি কেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেটির মাত্রার উপর। আমাদের একটি টিম এটি নিয়ে কাজ করছে,” বলেন ডিএমটিসিএলে নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুর রউফ।

“প্রাথমিকভাবে আমরা যে হিসাব করেছি, তাতে মনে হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত দুটো স্টেশন মিলিয়ে সংস্কার কাজ করতে ১৩৮ কোটি টাকার বেশি লাগবে না,” বলছিলেন মি. রউফ। অথচ গত জুলাই মাসে দুই স্টেশন মেরামত করতে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা খরচ হতে পারে বলে ডিএমটিসিএলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল।

তখন কীভাবে হিসাব করা হয়েছিল?

“তখন যারা দায়িত্বে ছিলেন, তারাই সেটি বলতে পারবেন। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রাথমিক যে হিসাব করেছি, সেখানে ১৩৮ কোটির মতোই ব্যয় হতে পারে,” বলেন মি. রউফ।

উল্লেখ্য যে, আওয়ামী লীগ শাসনামলে ২০১৭ সালে ডিএমটিসিএলের এমডি’র দায়িত্ব পেয়েছিলেন এম এ এন ছিদ্দিক। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর গত নয়ই সেপ্টেম্বর তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে সেই জায়গায় মি. রউফকে দায়িত্বে দেয়। নতুন দায়িত্ব পেয়েই মি. রউফ মেট্রোরেলে ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশন সংস্কার করে দ্রুত চালু করার প্রতি জোর দেয়।

ব্যয় কমলো যেভাবে

মূলত আমদানির সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে স্থানীয়ভাবে যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম ও উপকরণ সংগ্রহ করে কাজীপাড়া স্টেশনের সংস্কার কাজ করার কারণে খরচ একেবারে কমে গেছে বলে জানিয়েছেন শীর্ষ কর্মকর্তারা।

“মেট্রোরেলের যাত্রীদের একটি বড় অংশ কাজীপাড়া ও মিরপুর ১০ স্টেশন থেকে উঠতেন। ওইসব যাত্রীদের কথা বিবেচনা করেই আমরা সিস্টেমের কিছু জিনিস আমরা লোকাল প্রকিউরমেন্ট করেছি এবং সেগুলো দিয়েই যতটা সম্ভব দ্রুত কাজীপাড়া স্টেশনটি চালু করছি,” বলেন ডিএমটিসিএলের নতুন এমডি মি. রউফ।

তবে এক্ষেত্রে ডিএমটিসিএলের সংগ্রহে থাকা যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামই বেশিরভাগই ব্যবহৃত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

“আমাদের ডিপোতে কিছু জিনিস ছিল, সেগুলো আমরা ব্যবহার করছি। আবার মিরপুর ১০ স্টেশনে যেসব যন্ত্রপাতি ঠিকঠাক করে ব্যবহার করা সম্ভব, সেগুলো কাজীপাড়ায় কাজে লাগানো হচ্ছে,” বলছিলেন ডিএমটিসিএলে নতুন এমডি।

ফলে খরচ কমলেও যাত্রীসেবার মানে সেটার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলেই আশা করছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ।

এমআই

শেয়ার করুন:-
শেয়ার