ক্যাটাগরি: জাতীয়

যুক্তরাষ্ট্রে ডিবি হারুনের রয়েছে একাধিক বাড়ি-সম্পদ

বহুল আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন-অর-রশীদ। বাংলাদেশ পুলিশের ডিআইজি পদমর্যাদার এই কর্মকর্তা সর্বশেষ ছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি)। সরকারি স্কেল অনুযায়ী তৃতীয় গ্রেডের চাকরিজীবী হিসেবে সর্বসাকুল্যে বেতন ৮০ হাজার টাকারও কম। অথচ সীমাহীন দুর্নীতির মাধ্যমে নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। যুক্তরাষ্ট্রে হারুনের রয়েছে একাধিক বাড়ি ও সম্পদ। এছাড়া সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বও আছে হারুনের।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চাকরি জীবনের শুরু থেকেই হারুন ছিলেন বেপরোয়া। কখনোই চাকরি বিধিমালার তোয়াক্কা করেননি। যখন যেখানে দায়িত্ব পালন করেছেন, সেখানেই নানা অনিয়মে জড়িয়েছেন। প্রতিটি ধাপে প্রতারণা ও উচ্ছৃঙ্খল কর্মকাণ্ডে জড়ালেও তাকে কখনো শাস্তি পেতে হয়নি। বরং পদায়ন করা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সব ইউনিটে। ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, জিম্মি করে অর্থ আদায়, মারধর, জমি দখল, বাড়ি দখল, প্লট দখল, ফ্ল্যাট দখল, গুম, খুন, হত্যা, অর্থ পাচার, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি, আটকে রেখে নির্যাতন, নিয়োগ বাণিজ্য, নারী কেলেঙ্কারিসহ এহেন কোনো অপরাধ নেই, যার সঙ্গে জড়াননি হারুন।

তবুও বছর বছর পদোন্নতি পেয়েছেন। এসব অনিয়ম আর দুর্নীতির মাধ্যমে হাতিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। রাজধানীর উত্তরা, গাজীপুর ও কিশোরগঞ্জ ঘুরে ডিবি হারুনের অন্তত হাজার কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে।

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সম্পত্তি দখল ও দেখাশোনার জন্য আছে তিন সদস্যের স্টিয়ারিং কমিটি। নামে-বেনামে অন্তত তিনটি রিসোর্টের মালিকানা আছে তার। রয়েছে একাধিক আবাসিক হোটেল। আরও অন্তত ১০টি কোম্পানির মালিক তিনি। শুধু ঢাকায়ই আলিশান বাড়ি করেছেন দুই ডজনেরও বেশি। এর বাইরে আছে অগণিত প্লট ও ফ্ল্যাট।

কথিত মামা জাহাঙ্গীর আলমের নামে গড়েছেন এসব সম্পদ। দখল করা সম্পত্তি বিক্রি করে সেই টাকা দেশের বাইরে পাচার ও বিদেশে গড়ে তোলা সম্পদ তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব আলাদা কমিটির। যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্তত ছয়টি দেশে অঢেল টাকার ব্যবসা গড়েছেন হারুন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার সাবেক প্রধান হারুনের দেশে থাকা হাজার হাজার কোটি টাকার সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রক ছিলেন তার কথিত মামা জাহাঙ্গীর হোসেন এবং তার সহযোগী জহির। মূলত মামার মাধ্যমে সব অপকর্ম করতেন হারুন। জায়গা, জমি, ফ্ল্যাট, বাড়ি, রিসোর্ট সব সম্পদই তার মামা জাহাঙ্গীরের নামে করেছেন। আবার এসব সম্পদ দেখিয়ে ব্যাংক থেকে হাতিয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা।

আবার মানুষের সম্পত্তি দখলের পর তা বিক্রি এবং সে টাকা দেশের বাইরে পাঠানোর দায়িত্ব পালন করতেন ডিবির খিলগাঁও জোনের এডিসি সাইফুল। বিদেশে অর্থ পাচারের সুবিধার জন্য গড়ে তোলা হয় নিজস্ব মানি এক্সচেঞ্জ। ঢাকায় এই প্রতিষ্ঠানের অফিস পুরানা পল্টনের আজাদ প্রোডাক্টসের গলিতে। কার্যক্রম পরিচালনায় দুবাইয়ে আছে আরেকটি অফিস। এই মানি এক্সচেঞ্জ পরিচালনা করেন এডিসি সাইফুল ইসলামের দুই ভাই। একজন থাকেন দেশে। আর আরেক ভাই রিফাত অবস্থান করেন দুবাই।

সূত্র বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের নিউ হাইড পার্ক এলাকায় স্ত্রীর নামে পাঁচ মিলিয়ন ডলারের একটি বাড়ি কিনেছেন হারুন। ওই সময় হারুনের স্ত্রীর বিপুল অর্থ লেনদেন শনাক্ত করে এর তদন্ত করেছিল এফবিআই।

রাজধানীর উত্তরায় হারুনের বহুতল একাধিক বাড়ি, ফ্ল্যাট ও প্লটের তথ্য মিলেছে। যার মধ্যে ৩ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর রোডে (লেকপাড়ের রোডে) রয়েছে ৬তলা একটি আলিশান বাড়ি। ‘পার্ক লেক ভিউ’ নামের বাড়িটির হোল্ডিং নম্বর-৩০। এটি গেস্ট হাউস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। একই রোডের মাথায় ৮তলা আরেকটি বাড়ি আছে হারুনের। এই বাড়ির চতুর্থ তলায় সপরিবারে নিয়ে থাকতেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে তিনি আর ওই বাড়িতে যাননি। ৩ নম্বর সেক্টরের ৭ নম্বর রোডের হোল্ডিং নম্বর-৫ এ ১০ কাঠা জায়গার ওপর একটি ১০তলা মার্কেট। এটি হারুনের শ্বশুরের নামে করা হয়েছে। চার রাস্তার মোড়ে জমিসহ এই ভবনটির আনুমানিক বাজারমূল্য শতকোটি টাকার ওপর। ১২ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁও জনপথ রোডের ২১ নম্বরে ৬তলা একটি বাড়ি। এই বাড়িটি বন্ধক রেখে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া হারুন অর রশীদের নামে কিশোরগঞ্জে মিঠামইনে প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট নামে একটি বিলাসবহুল রিসোর্ট রয়েছে। যেটি পরিচালনা করেন হারুনের ভাই ডাক্তার শাহরিয়ার। গাজীপুরে রয়েছে সবুজ পাতা রিসোর্ট এবং ‘গ্রিন টেক’ নামে আরও একটি বিলাসবহুল রিসোর্টের শেয়ার। এ ছাড়া নন্দন পার্কেও শেয়ার আছে হারুনের। আছে আমেরিকান ডেইরি নামে একটি কোম্পানিতে বিনিয়োগ। এই কোম্পানির এমডি হারুনের স্ত্রী। ময়মনসিংহের ত্রিশালের সাবেক এমপি আনিসের সঙ্গে ফিশারিজ এবং রেস্টুরেন্টের যৌথ ব্যবসা আছে হারুনের।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশীদের ব্যক্তিগত নম্বরে টানা কয়েক দিন বারবার ফোন করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।

কথিত মামা জাহাঙ্গীরের মোবাইল নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে। শনিবার (১৭ আগস্ট) উত্তরার জাহাঙ্গীরের অফিস ও বাসায় গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। বাসার নিরাপত্তাকর্মী ইফাতুল বলেন, জাহাঙ্গীর সাহেব এখানে একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন। দুই সপ্তাহ ধরে স্যার এখানে আসেন না। তার পরিবারের কেউ এখানে এখন নেই।

সার্বিক বিষয়ে মন্তব্য চাওয়া হলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, একজন পুলিশ কর্মকর্তা বা সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তার যে বৈধ আয়, তার সঙ্গে সম্পদের পরিমাণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ। দেশে-বিদেশে তিনি যে সম্পদ অর্জন করেছেন, সেটি দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে। গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে তার কাছে যে ক্ষমতা ছিল, সেটির অপব্যবহার করেছেন তিনি। আইন লঙ্ঘন করে তাদের সংবিধানপরিপন্থি অস্বাভাবিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। সেটি ব্যবহার করেই তিনি এই সম্পদ গড়েছেন। আর এই সম্পত্তি যে তিনি একা করেছেন, সেটা কিন্তু ভাবার কোনো সুযোগ নেই। তার সঙ্গে অনেক যোগসাজশকারী ও সহায়তাকারী রয়েছে। এখন এর সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার এবং জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার।

শেয়ার করুন:-
শেয়ার