বাংলাদেশ আজ গভীর রাজনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত। সরকার বিরোধী দলের ওপর নানা চাপ প্রয়োগ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু এভাবে আসল সমস্যাগুলো থেকে কতদিন দৃষ্টি ফেরানো সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। গত প্রায় এক মাস ধরে ছাত্রসমাজ কোটা আন্দোলনে সক্রিয় হয়েছে। তাদের অসন্তোষ ক্রমেই বাড়ছে, এবং তারা রাস্তায় নেমেছে মানুষের নিরাপত্তা, দুর্নীতি, ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দাবিতে।
এখন ছাত্রসমাজের একটিই দাবি: “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ এই সরকারের পতন ও ফ্যাসিবাদের বিলোপ।” তাদের মতে, এই সরকার ক্ষমতায় থাকার অধিকার হারিয়েছে, এবং খুন-লুটপাট ও দুর্নীতির জন্য বিচার হওয়া উচিত। চলমান ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা চিরতরে বিলোপ করা প্রয়োজন।
সরকারের বিবৃতিতে প্রায়শই বিএনপি ও জামাতকে বিভিন্ন সমস্যার জন্য দায়ী করা হয়। বিরোধী দলকে দোষারোপ করে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার প্রবণতা নতুন নয়। কিন্তু এভাবে আসল সমস্যাগুলো থেকে কতদিন চোখ ফিরিয়ে রাখা সম্ভব?
সম্প্রতি ছাত্রসমাজ সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। তারা নিজেদের দাবি ও অভিযোগ নিয়ে সোচ্চার। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, শিক্ষা ব্যবস্থা, ও ভবিষ্যতের বিষয়ে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের অভাব দৃশ্যমান। কতজন শিক্ষার্থীকে হারালে সরকার তাদের দাবির প্রতি সঠিক গুরুত্ব দেবে? পুলিশ ও মিলিটারি রাস্তা দখল করে অস্ত্র দিয়ে নতুন প্রজন্মকে হত্যা করছে।
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষা করা সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। কিন্তু অনেকের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে যে, বাংলাদেশ কি সত্যিই স্বাধীনভাবে চলতে পারছে, নাকি কোনো বৃহত্তর শক্তির প্রভাবাধীন হয়ে পড়েছে।
সরকারি কার্যক্রমে স্বচ্ছতার অভাব জনগণের আস্থার ঘাটতি তৈরি করেছে। প্রকৃত তথ্য গোপন করে শুধুমাত্র বিরোধী দলকে দোষারোপ করা একটি অকার্যকর কৌশল। এতে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না, বরং আরও জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থার দায়িত্বহীনতার কারণে সমস্যাগুলো আরও প্রকট হয়ে উঠছে। ছাত্রসমাজের দাবি-দাওয়া, তাদের নিরাপত্তা, ও শিক্ষার মান উন্নয়ন নিশ্চিত করা এখন জরুরি। কিন্তু এই ক্ষেত্রে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের অভাব স্পষ্ট। রাজনৈতিক স্বার্থে বিরোধী দলকে দোষারোপ করে সমস্যাগুলো থেকে দৃষ্টি সরানোর প্রবণতা দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর। জনগণের প্রকৃত সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও কার্যকর পদক্ষেপ।
দেশের সকল স্তরের সরকারি কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রকৃত তথ্য জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে এবং সমস্যা সমাধানের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য স্বচ্ছতা অপরিহার্য। ছাত্রসমাজের দাবির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে তাদের নিরাপত্তা ও শিক্ষার মান উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষার ক্ষেত্রের সমস্যাগুলো সমাধান করা দেশের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীদের প্রতি উদাসীনতা দেশের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। দেশের সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। অন্য কোনো দেশের প্রভাবমুক্ত থেকে নিজেদের স্বার্থে কাজ করতে হবে। এর মাধ্যমে দেশকে বহিঃশক্তির প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা সম্ভব।
একটি সংসার বা একটি দেশ যত গরিবই হোক, সাজানো-গোছানো অবস্থায় থাকলে বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠলে মনের মধ্যে একটি পবিত্র অনুভূতি কাজ করে। উন্নতির ধাপগুলো দেখে গর্ব হয়। কিন্তু হঠাৎ অন্ধকার ঘনিয়ে এলে বা বিপদে পড়ে সেটি ভেঙে-চুরে তচনচ হয়ে গেলে হতাশা কাজ করে, নতুন উদ্দীপনা বা অনুভূতি দেহে ও মনে আসে না।
বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে দেখা যায়, কোটা সংক্রান্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে জাতি কীভাবে সক্ষম হবে? কীভাবে নতুন বিশ্বাসে গড়ে উঠবে দেশ? কীভাবে পরস্পর পরস্পরকে বিশ্বাস করবে এবং প্রিয়জন হারাবার বেদনা কখন বিলীন হবে? এসব প্রশ্ন আজ প্রতিটি সচেতন নাগরিকের মনে জেগে উঠছে।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে জনগণের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বাড়ছে। সমস্যার সমাধান করতে হলে স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও কার্যকর পদক্ষেপের প্রয়োজন। ছাত্রসমাজের নিরাপত্তা ও শিক্ষার মান উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেশের স্বার্থ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এর মাধ্যমে দেশের জনগণকে আশ্বস্ত করা সম্ভব হবে এবং একটি সুস্থ, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে দুর্নীতির চিরতরে বিনাশ করতে হবে।
বর্তমান সংকট মোকাবেলায় সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে প্রয়োজন সকলের সচেতনতা, আন্তরিকতা, ও সমন্বিত প্রচেষ্টা। কেবলমাত্র সঠিক পথে এগিয়ে গিয়ে আমরা একটি উন্নত, শান্তিপূর্ণ ও স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব।
আমি শেষে বলতে চাই, যদি সরকার সত্যিকার অর্থে দেশকে ভালোবেসে থাকে তবে ব্যক্তি স্বার্থ ছেড়ে দেশের স্বার্থে সঠিক নেতৃত্বধীনের কাছে দেশকে হস্তান্তর করবে। সরকার যদি অহংকার, লোভ, ও রাগের কারণে সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ হয়, তবে দেশের কৃষক, মজুর সহ কোটি কোটি মানুষ মহাসঙ্কটে পড়বে। একই সাথে যদি মিলিটারি প্রতিনিয়ত কার্ফিউ জারি করে ব্যক্তি বিশেষকে রক্ষা করার জন্য এবং দেশকে জলাঞ্জলি দিতে চায় তবে এ যুদ্ধ ৭১ সালের থেকে ভয়ঙ্কর রূপ নিবে। সেক্ষেত্রে আমার দাবি, শিক্ষার্থীদের কাছে রাস্তায় যখন নেমেছো তখন জনগণকে মুক্ত না করে ঘরে ফিরবে না এবং শুধু দুই কোটি কোটা সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে নয়, দেশের সব কোটি মানুষের জীবনের নিরাপত্তা, দুর্নীতির চিরতরে বিনাশ ঘটিয়ে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেই ঘরে ফিরবে।
আমি তোমাদের একদফা সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। একই সাথে বলতে চাই, যে খুন-লুটপাট, দুর্নীতি এই দেশে হয়েছে, তার বিচার হতে হবে এবং চলমান ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা চিরতরে বিলোপ করতে হবে। এর শতভাগ নিশ্চয়তা না করে তোমরা ঘরে ফিরো না, কারণ তোমরা যদি ব্যর্থ হও তবে দেশ পৃথিবীর মানচিত্র থেকে বিলীন হয়ে যাবে এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নামও শেষ হয়ে যাবে।
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। rahman.mridha@gmail.com