ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও অর্থনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতির কারণে গত বছর রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছিল বৈশ্বিক স্বর্ণের চাহিদা। চলতি বছরও একই পথে হাঁটছে মূল্যবান ধাতুটির বাজার। বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) এর চাহিদা (ওটিসিসহ) গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ৩ শতাংশ। সম্প্রতি চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকের গোল্ড ডিমান্ড ট্রেন্ডস শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল (ডব্লিউজিসি)।
ডব্লিউজিসি জানায়, জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ওটিসিসহ সব খাত মিলিয়ে স্বর্ণের বৈশ্বিক চাহিদা বেড়ে ১ হাজার ২৩৮ টনে দাঁড়িয়েছে। তবে ওটিসি বাদে চাহিদা ৫ শতাংশ কমে ১ হাজার ১০২ টনে নেমেছে।
ওটিসি বা ওভার দ্য কাউন্টার মার্কেট বলতে মূলত এমন বিকেন্দ্রীকৃত বাজারকে বোঝায়, যেখানে অংশগ্রহণকারীরা নির্দিষ্ট কোনো এক্সচেঞ্জের পরিবর্তে সরাসরি নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য সম্পাদন করে। বিশ্ববাজারে স্বর্ণ কেনাবেচার ক্ষেত্রে ওটিসি বাজারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
ডব্লিউজিসির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, স্বর্ণের চাহিদা বাড়ার পেছনে বেশকিছু বিষয় শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ওটিসি বাজারে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোয় ক্রয় বেড়ে যাওয়া ও এশিয়ার বাজারে ঊর্ধ্বমুখী চাহিদা। এদিকে চাহিদা বাড়ায় প্রথম প্রান্তিকে আন্তর্জাতিক বাজারে ধাতুটির গড় দাম রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছে। প্রতি আউন্সের মূল্য স্থির হয় ২ হাজার ৭০ ডলারে। এক বছরের ব্যবধানে দাম ১০ শতাংশ ও এক প্রান্তিকের ব্যবধানে ৫ শতাংশ বেড়েছে।
বাজারের অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিপুল পরিমাণে স্বর্ণ কিনেছে। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে ২৯০ টন স্বর্ণ কিনেছে ব্যাংকগুলো।
এছাড়া গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে বিশ্বব্যাপী স্বর্ণের বার ও কয়েনে বিনিয়োগের পরিমাণও আগের প্রান্তিকের তুলনায় ৩ শতাংশ বেড়েছে। বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩১২ টনে। যদিও গত বছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় বিনিয়োগের পরিমাণ একই রয়েছে।
স্বর্ণের দাম রেকর্ড পরিমাণে বাড়লেও প্রথম প্রান্তিকে বিশ্বব্যাপী গহনার চাহিদা মোটামুটি স্থিতিশীল আছে। গত বছরের তুলনায় গহনার চাহিদা মাত্র ২ শতাংশ কমেছে বলে জানিয়েছে ডব্লিউজিসি। অন্যদিকে ইলেকট্রনিকস খাতে স্বর্ণের বিনিয়োগ চাহিদা গত বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেড়েছে।
চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে খনি থেকে বৈশ্বিক স্বর্ণ উত্তোলন আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ শতাংশ বেড়ে ৯৮৩ টনে দাঁড়িয়েছে। রিসাইক্লিংও গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১২ শতাংশ বেড়ে ৩৫১ টনে পৌঁছেছে, যা ২০২০ সালের প্রথম প্রন্তিকের পর থেকে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।
এ বিষয়ে ডাব্লিউজিসির সিনিয়র মার্কেট বিশ্লেষক লুইস স্ট্রিট বলেন, স্বর্ণের দাম অব্যাহত বাড়ছে। গত মার্চে ধাতুটির দাম সর্বকালের সর্বোচ্চে পৌঁছে। মূল্যবৃদ্ধির পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে ভূরাজনৈতিক ও চলমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোয় ক্রয় বেড়ে যাওয়া এবং ওটিসি বাজারে বিনিয়োগ বৃদ্ধিও স্বর্ণের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছে বলে জানান তিনি।
বাজার পর্যবেক্ষকরা জানান, বিশ্বজুড়ে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে চলতি বছরের শুরু থেকেই আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে স্বর্ণের দাম। নতুন করে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাত ধাতুটির বাজারকে আরো ঊর্ধ্বমুখী করে তুলেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্রমাগত বাড়ছে ঝুঁকি। এমন বাস্তবতায় নিরাপদ বিনিয়োগমাধ্যম হিসেবে বাড়ছে স্বর্ণের চাহিদা।
বাজার বিশ্লেষক কার্লো আলবার্টো দে কাসা বলেন, এশিয়ার দেশগুলোয় স্বর্ণের চাহিদা বাড়ছে। বিশেষ করে চীনে চাহিদা বাড়ার হার অনেক বেশি। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোয়ও ধাতুটির ব্যাপক চাহিদা লক্ষ করা যাচ্ছে। বাজারে ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি যেমন রয়েছে, তেমনি বিশ্বজুড়ে সুদহার কমানোর সম্ভাবনাও বাড়ছে। এসব কারণেই মূলত স্বর্ণের দাম বেড়ে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।