দেশে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে প্রতি মাসেই সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে ভাঙানোর প্রবণতা বাড়ছে। ফলে কমে আসছে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি। সর্বশেষ ফেব্রুয়ারিতে নিট বিক্রি কমেছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকারও বেশি। সব মিলে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) নিট বিক্রি ঋণাত্মকের পরিমাণ ৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আবার, সঞ্চয়পত্রে গ্রাহকদের বিনিয়োগ কমে আসলেও ব্যাংক আমানতে জমার পরিমাণ বাড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নানা কড়াকড়ির কারণে সঞ্চয়পত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে মানুষ। সম্প্রতি ব্যাংকগুলোতে আমানতের সুদ বাড়ানোও এর অন্যতম কারণ। এ ছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণেও সঞ্চয়পত্র ভেঙে ফেলছেন। ব্যাংকঋণের সুদের হার বাড়ছে। কোনো কোনো ব্যাংকে ঋণের সুদের হার ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এর প্রভাবে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহারও বাড়াতে শুরু করেছে।
ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, বেসরকারি খাতের কিছু ব্যাংক এখন আমানতের সুদ হার বাড়াচ্ছে। অনেকে আমানতে ১৩ দশমিক ৪০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে এক বছরের জন্যও স্থায়ী আমানত হিসাব খোলা যায়। সেগুলো থেকে মাসে মাসে মুনাফা পাওয়ার সুবিধা আছে। এক বছরের স্থায়ী আমানতে কয়েকটি ব্যাংক ১১ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে। আবার কিছু ব্যাংক ছয় বছরের জন্য টাকা জমা রাখলে ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ সুদ দিচ্ছে। ফলে সঞ্চয়পত্র ছেড়ে ব্যাংক আমানতে ঝুঁকছে গ্রাহক।
এদিকে চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের প্রতিবেদন বলছে, সর্বশেষ ফেব্রুয়ারিতে নিট বিক্রি ঋণাত্মক হয়েছে ১ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা। আগের মাসে নিট বিক্রি ঋণাত্মকের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) নিট বিক্রি ঋণাত্মক হওয়ার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়েও নিট বিক্রি ঋণাত্মক ধারায় ছিল। তবে ঐ সময় এর পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা।
গত অর্থবছরের সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। তবে বিক্রি কমতে থাকায় সংশোধিত বাজেটে এ লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ধরা হয় ৩২ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছর শেষে নিট বিক্রি দাঁড়ায় ঋণাত্মক প্রায় ৩ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছরের পুরো সময়ে সঞ্চয়পত্রের মোট বিক্রি হয় ৮০ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। একই সময়ে সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর পরিমাণ ছিল ৮৪ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। এর মানে, পুরো অর্থবছরে এ খাত থেকে সরকার এক টাকারও ঋণ পায়নি। মূলত ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে সঞ্চয়পত্র বিক্রির চেয়ে বেশি ভাঙানোর প্রবণতা বাড়তে থাকে।
আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্র থেকে ভাঙানো বাবদ (নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে বা মেয়াদান্তের আগে) আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে নিট বিক্রি বলা হয়। নিট বিক্রিকে সরকারের ধার বা ঋণ হিসেবে গণ্য করা হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরেও সঞ্চয়পত্র থেকে তুলনামূলক কম ঋণ পেয়েছিল সরকার। পুরো অর্থবছরে ৩২ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে নিট ঋণ আসে ১৯ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা। অথচ করোনার পরও ২০২০-২১ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগ হয়েছিল প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা। এটি তার আগের অর্থবছরে ছিল মাত্র ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা।
সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে হয় তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য। মেয়াদপূর্তির আগে সঞ্চয়পত্র ভাঙানো হলে মুনাফার হার সর্বনিম্ন ৭ দশমিক ৭১ শতাংশ। মেয়াদ ও টাকার পরিমাণের ওপর নির্ভর করে সঞ্চয়পত্রে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ মুনাফা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে যাদের এ খাতে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ রয়েছে, তাদের মুনাফা কমে যায়।
এখন ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থাকলে রিটার্নের সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ ছাড়া গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব রকম সঞ্চয়পত্রের সুদহার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার। তার আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ সীমা কমিয়ে আনা হয়। এ ছাড়া ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎস করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়।
বর্তমানে চার ধরনের সঞ্চয়পত্র রয়েছে। পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১ দশমিক ৫২, পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনের সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ৭৬, পাঁচ বছর মেয়াদি মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ২৮, তিন বছর মেয়াদি ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১১ দশমিক ৪ শতাংশ।
এমআই