ক্যাটাগরি: শিল্প-বাণিজ্য

ব্যবসাবান্ধব ও হয়রানিমুক্ত বাজেট চান ব্যবসায়ীরা

ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধি, ডলার-গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণে ব্যবসা বাণিজ্য এখন হুমকির মুখে। অগ্রিম আয়কর সমন্বয়ের সমস্যা, ইলেকট্রনিক ফিসকাল ডিভাইসের (ইএফডি) মাধ্যমে ভ্যাট সংগ্রহে ধীরগতি ও ব্যবস্থাপনার অভাব, কার্যকর করপোরেট করহার প্রণয়ন, আমদানি-রপ্তানির সকল পর্যায়ে জরিমানার অসহনীয় মাত্রায় চলে যাচ্ছে। এসব সমস্যা ও হয়রানির কথা তুলে ধরে ব্যবসাবান্ধব বাজেট প্রত্যাশা করেছে ব্যবসায়ীরা। একই সঙ্গে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সহায়ক পরিবেশকে আরো সুদৃঢ় করতে শিল্প ও বিনিয়োগ বান্ধব বাজেট চায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)। যাতে দেশের বিনিয়োগ ও উৎপাদনশীল খাত শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়।

বৃহস্পতিবার (৪ এপ্রিল) রাজধানীর প্যানপ্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে অনুষ্ঠিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পরামর্শক কমিটির ৪৪তম সভায় এসব দাবি জানান ব্যবসায়ীরা। এনবিআর ও এফবিসিসিআই’র যৌথ উদ্যোগে এ সভার আয়োজন করে। সভায় ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ের ভোগান্তি ও সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরে তা সমাধানের দাবি করা হয়। সমাধান দিতে না পারলে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের এক্সিট পলিসি (ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়া) করে দেওয়ার দাবি জানানো হয়।

সভায় এফবিসিসিআই’র পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়। প্রস্তাবে মাহবুবুল আলম বলেন, ব্যবসায়ীদের ওপর থেকে করের বোঝা কমানো, আমদানিকৃত কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্যসহ শিল্প উপকরণের ওপর আরোপিত অগ্রিম আয়কর (এআইটি), আগাম কর (এটি) প্রত্যাহার করা উচিত। ব্যাংক ঋণের সুদহার কমাতে হবে। আমদানি পণ্যের যথাযথ শুল্কায়ন এবং পণ্য খালাসের জটিলতা দূর করতে রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। কর হার কমিয়ে আয়কর ও মূসকের আওতা সম্প্রসারণ করে রাজস্ব আয় বাড়ানো, সক্ষম ব্যক্তিদের করের আওতায় আনতে হবে। আর এর মাধ্যমেই ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি সম্ভব। রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে স্থানীয় বাজারের পণ্য, কাঁচামাল ও সেবা ক্রয়কে ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখার দাবি জানাই।

তিনি আরো বলেন, মূল্যস্ফীতি এবং মানুষের প্রকৃত আয় বিবেচনায় রেখে আগামী জাতীয় বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি করে সাড়ে ৪ লক্ষ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব দিচ্ছি। এ ছাড়া কর্মসংস্থানের স্বার্থে বিনিয়োগ, দেশীয় শিল্প, সেবা এবং সিএমএসএমইকে শুল্ক করের যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে হবে। ক্ষেত্র বিশেষে অব্যাহতি বা বন্ড সুবিধা দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক ভিত্তিতে রপ্তানি বৈচিত্রকরণের সুযোগ দিতে হবে। ভোগ্য পণ্যসহ নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের মূল্য ও সরবরাহ স্থিতিশীল রাখা, করনীতি, কর পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন, অটোমেশন ও ইন্টিগ্রেশনের মাধ্যমে নেট বা কর জাল সম্প্রসারণ করতে হবে। শিল্প পরিচালনার ব্যয় কমানোর জন্য আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম আয়করের (এআইটি) হার ধাপে ধাপে কমিয়ে আনা, ক্ষুদ্র ও মাঝারীসহ সকল দেশীয় শিল্পে উৎপাদিত মোড়ক (প্যাকেজিং) পণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে অগ্রিম আয়কর ৭% থেকে হ্রাস করে ২% করার সুপারিশের পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্যকে উৎসে কর কর্তনের আওতা বহির্ভূত রাখার প্রস্তাব করছি।

সভায় রপ্তানিমুখী সকল পণ্যে উৎসে কর হার ১ শতাংশ হতে হ্রাস করে পূর্বের ন্যায় ০ দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণ করা, নগদ সহায়তার ওপর আয়কর কর্তনের হার ৫ শতাংশ নির্ধারণ, মিনিমাম ট্যাক্স ও উইথহোল্ডিং ট্যাক্সকে যৌক্তিকীকরন করা, আমদানিকরা উপকরণের ক্ষেত্রে ৩ শতাংশ ও ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক সংক্রান্ত এরকম ৩৮১টি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

অনুষ্ঠানে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘বাংলাদেশের কর ব্যবস্থা ব্যবসা এবং বিনিয়োগের পরিপন্থী। অগ্রিম আয়কর সমন্বয়ের অভাবে করপোরেট করহার ১২ শতাংশে থাকছে না। সেটা বেড়ে প্রায় ৩০ শতাংশে চলে যাচ্ছে। এআইটি নেওয়া বন্ধ করা অথবা রিটার্ন সমন্বয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া আমদানি-রপ্তানির সকল ক্ষেত্রে জরিমানার মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। জরিমানা করলে কর্মকর্তাদের পুরস্কারের ব্যবস্থা করা হয়। এতে স্বেচ্ছাচারিতা বৃদ্ধি পায়। তাই এই পুরস্কার দেওয়া থেকে সরে আসতে হবে।’

বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ খোকন বলেন, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের পাশাপাশি সুদের হার ডাবল ডিজিটে যাওয়ায় ব্যবসা করা কঠিন হয়ে গেছে। এ অবস্থায় কেউ ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হলে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের এক্সিট পলিসি করে দেন।

দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, ইএফডি মেশিন বিভিন্ন মার্কেটে বসানো হয়েছে। ডিসকাউন্টে বিক্রি করলেও মূল টাকার ওপরই ভ্যাট দিতে হচ্ছে।’ রিহ্যাব সভাপতি ওয়াহিদুজ্জামান ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রেশনের ফি কমানোর দাবি করেন।

সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে বর্তমান সরকার বেসরকারি খাতকে সাথে নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। আপনাদের সুচিন্তিত মতামত ও প্রস্তাবনাগুলো আগামী জাতীয় বাজেটে আমরা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করব।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়চিত্ত নেতৃত্বে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দেশের অর্থনীতি সামনের পথে এগিয়ে চলেছে। কর ন্যায়পাল নিয়োগের বিষয়টি ভেবে দেখা যেতে পারে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সরকার ও ব্যবসায়ী সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে।

সভায় সভাপতির বক্তব্যে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, আগামী জাতীয় বাজেটকে সামনে রেখে ইতিমধ্যে খাতভিত্তিক ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সঙ্গে একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাদের যৌক্তিক প্রস্তাবনাগুলো বাজেটে তুলে ধরতে কাজ করছে এনবিআর। ব্যবসায়ীদের মধ্যে কোনো অসন্তোষ থাকলে সেগুলো সমাধানে এনবিআর কাজ করবে। তবে আমাদের কর দেওয়ার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তা না হলে আমারা মধ্যম আয়ের দেশ হতে পারব না।

শেয়ার করুন:-
শেয়ার