হজ ও ওমরার প্রধান ফরজগুলোর একটি হলো ইহরাম বাঁধা বা পুরুষের জন্য দুইটি সেলাইবিহীন সাদা কাপড় পরা এবং নারীদের জন্য নিজেরদে স্বাভাবিক পোশাক পড়া।
হজ-ওমরা পালনকারীদের মক্কার উদ্দেশে বের হওয়ার সময় মিকাত (নির্ধারিত স্থান) অতিক্রম করার আগে ইহরামের কাপড় পরে নিতে হয়। ইহরাম না পরে মিকাত অতিক্রম করা জায়েজ নয়।
হজ কিংবা ওমরার ইহরাম অবস্থায় হজ পালনকারীদের জন্য বেশ কিছু কাজ নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ কাজগুলো তিনভাগে বিভক্ত। তাহলো-
১. এমন কিছু কাজ যা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য হারাম।
২. এমন কিছু কাজ যা শুধু পুরুষের জন্য হারাম।
৩. এমন কিছু কাজ যা শুধু নারীর জন্য হারাম।
নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য হারাম
সুগন্ধি ব্যবহার
ইহরামের কাপড়ে বা শরীরে ইহরাম গ্রহণের পর আতর বা সুগন্ধি লাগানো নিষেধ। ইয়ালা ইবনে উমাইয়্যা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুলে (সা.) যখন জিঈররানা নামক স্থানে অবতরণ করলেন, তখন এক ব্যক্তি তার কাছে এলেন, লোকটির পরনে জাফরান মিশ্রিত এক ধরনের সুগন্ধিযুক্ত জুব্বা ছিল। রাসুল (সা.) তাকে বললেন, সুগন্ধির চিহ্ন দূর করো এবং জুব্বা খুলে ফেল। (মুসলিম, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৩৭৩)
ইহরাম অবস্থায় সুগন্ধিযুক্ত তেল, জায়তুন, এমনকি তিলের তেলও লাগানো যাবে না। সুগন্ধি সাবান, পাউডার, স্নো, ক্রীম ইত্যাদি ব্যবহার করা যাবে না। বিখ্যাত তাবেয়ি আতা (রহ.) বলেন, ইহরাম গ্রহণকারী তার শরীরে কিংবা কাপড়ে সুগন্ধিযুক্ত তেল লাগালে তার উপর কাফফারা ওয়াজিব হবে। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং: ১৪৮৩৩)
পৃথকভাবে সুগন্ধি জর্দা খাওয়াও নিষেধ। আর পানের সঙ্গে খাওয়া মাকরূহ। (মানাসিক: ১২১; আহকামে হজ: ৩৪)
বিখ্যাত তাবেয়ি কাসেম (রহ.) মুহরিমের জন্য খাবারের সঙ্গে সুগন্ধি জাফরান খাওয়া অপছন্দ করতেন। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং: ১৩২৭৮)
নখ কাটা, শরীরের কোনো স্থানের চুল, পশম কাটা-উপড়ানো নিষেধ
আতা, তাউস ও মুজাহিদ রাহ. প্রমুখ বিখ্যাত তাবেয়িগণ বলেন, মুহরিম তার বগলের নিচের পশম উপড়ালে বা নখ কাটলে তার উপর ফিদয়া দেওয়া ওয়াজিব হবে। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং: ১৩৬০৪)
স্বামী-স্ত্রীর সহবাস
ইহরাম অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন বা স্ত্রীর সামনে এ সংক্রান্ত কোনো কথা বা কাজ করা নিষেধ। কোরআন মজিদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, হজ্বের মাসগুলি সুবিদিত। অতএব যে ব্যক্তি এ মাসগুলিতে হজ করা সি’র করে অতঃপর হজে না অশ্লীলতা আছে এবং না অসৎ কাজ এবং না ঝগড়া-বিবাদ। (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৯)
এক ব্যক্তি তাওয়াফে জিয়ারতের পূর্বে স্ত্রীর সঙ্গে সহবাসে লিপ্ত হয়ে যায়। তাদের সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হল। তিনি একটি উট জবাই করার নির্দেশ দেন। (মুয়াত্তা মুহাম্মাদ, পৃষ্ঠা: ২৩৮)
যৌন কামনার সঙ্গে চুম্বন দেওয়া, স্পর্শ করা কিংবা জড়িয়ে ধরা
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-কে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন, আমি ইহরাম অবস্থায় কামভাবের সঙ্গে নিজ স্ত্রীকে চুম্বন করেছি। এখন আমার করণীয় কী? তিনি উত্তরে বললেন, তুমি একটি কোরবানি করো। (কিতাবুল আছার, ইমাম মুহাম্মাদ, পৃষ্ঠা নং: ৫৩)
পশু শিকার
বন্য পশু শিকার বা শিকারীকে সহযোগিতা করা নিষিদ্ধ। কোরআন মজিদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, তোমাদের ওপর প্রাণী শিকার করা হারাম করা হয়েছে, যে পর্যন্ত ইহরাম অবস্থায় থাকো। (সুরা মায়িদাহ, আয়াত: ৯৬)
জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ইহরাম অবস্থায় স্থলভাগের শিকারকৃত প্রাণী তোমাদের জন্য হালাল, যদি তা তোমরা নিজেরা শিকার না করো কিংবা তোমাদের উদ্দেশ্যে শিকার করা না হয়। (তিরমিজি, খণ্ড: ১, হাদিস নং: ১৭৩)
মাথার চুল মুণ্ডন করা বা ছোট করা কিংবা উঠিয়ে ফেলা
আল্লাহ বলেন- আর কোরবানি যথাস্থানে না পৌঁছা পর্যন্ত নিজেদের মস্তক মুণ্ডন করো না। আলেমরা, শরীরের সব চুলকে মাথার চুলের ওপর কেয়াস করেছেন। তাই ইহরাম অবস্থায় থাকা ব্যক্তির জন্য শরীরের কোনো চুল দূর করা জায়েয নয়।
ঝগড়া-বিবাদ, সাধারণ সময়েও নিষিদ্ধ
ইহরাম অবস্থায় আরো ভয়াবহ। কোরআন কারিমে বলা হয়েছে, হজের মাসগুলি সুবিদিত। অতএব যে ব্যক্তি এ মাসগুলিতে হজ করা স্থির করে, অতঃপর হজে না অশ্লীলতা আছে এবং না অসৎ কাজ এবং না ঝগড়া-বিবাদ। (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৯৭)
জাবির ইবনে যায়েদ (রহ.) আল্লাহ তাআলার বাণী ‘এবং না ঝগড়া-বিবাদ’ প্রসঙ্গে বলেছেন, তোমার জন্য এই অবকাশ নেই যে, সঙ্গীর সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হবে এবং তাকে রাগান্বিত করবে। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং: ১৩৩৯৪)
ইহরাম অবস্থায় যেসব কাজ নিষিদ্ধ তাতে লিপ্ত হওয়া গুনাহ। এর কারণে হজ অসম্পূর্ণ হয়ে যায়। উপরন্তু কিছু বিষয় এমন রয়েছে যাতে লিপ্ত হলে ‘দম’ ওয়াজিব হয়। ইবরাহিম নাখাঈ (রহ.) বলেন, বলা হতো, যে ব্যক্তি হজে নিষিদ্ধ কোনো কাজ করলো, সে এর জন্য একটি পশু জবাই করবে। ’ মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ১৫১৯১)
সেলাই করা কাপড় পরা
পুরুষের জন্য শরীর বা কোনো অঙ্গের আকার অনুযায়ী তৈরিকৃত বা সেলাইকৃত কাপড় পরা নিষিদ্ধ। যেমন- পাঞ্জাবি, জুব্বা, শার্ট, সেলোয়ার, প্যান্ট, গেঞ্জি, কোট, সোয়েটার, জাঙ্গিয়া ইত্যাদি।
আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করল, মুহরিম (ইহরাম পরিহিত) কী কী কাপড় পরতে পারবে? তখন তিনি বলেন, জামা-পাগড়ি, পাজামা, টুপি ও মোজা পরবে না। তবে জুতা না থাকলে চামড়ার মোজা গিরার নিচ পর্যন্ত কেটে পরতে পারবে। তোমরা এমন কোনো কাপড় পরিধান করো না যাতে ‘জাফরান’ বা ‘ওয়ারছ’ লেগেছে। (মুসলিম, খণ্ড: ০১, হাদিস নং: ৩৭২)
ইহরামের কাপড় ছিঁড়ে গেলে তা সেলাই করে কিংবা জোড়া দিয়ে পরা করা যাবে। তবে ইহরামের কাপড় এ ধরনের সেলাইমুক্ত হওয়াই ভালো। (রদ্দুল মুহতার, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৪৮১; শরহু লুবাবিল মানাসিক: ৯৮)
ইহরাম অবস্থায় সেলাইযুক্ত ব্যাগ ব্যবহার করা ও বেল্ট বাঁধা নিষিদ্ধ নয়। তাবেয়ি উরওয়া (রহ.) মুহরিমের জন্য টাকা-পয়সা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রক্ষার উদ্দেশে ব্যাগ ব্যবহার করা বৈধ মনে করতেন। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং: ১৫৬৯৯)
তাউস (রহ.) বলেন, মুহরিম কোমরবন্দ (বেল্ট) ব্যবহার করতে পারবে। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং: ১৫৬৮৯)
মাথা ও মুখমণ্ডল আবৃত করা
পুরুষের জন্য মাথা ও মুখমণ্ডল আবৃত করা নিষেধ। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, মুখমণ্ডল ও তার উপরের অংশ মাথার অন্তর্ভুক্ত। অতএব ইহরাম গ্রহণকারী থুতনী থেকে উপরের দিকে আবৃত করবে না। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং: ১৪৪৫২)
হাড় ঢেকে যায় এমন জুতা
পুরুষের জন্য পায়ের পাতার উপরের উঁচু হাড় ঢেকে যায় এমন জুতা পরিধান করা নিষেধ। তাই এমন জুতা বা স্যান্ডেল পরতে হবে যা পরলে ওই উচু অংশ খোলা থাকে। (রদ্দুল মুহতার ২/৪৯০)
আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, তোমরা চাদর, লুঙ্গি ও চপ্পল পরে ইহরাম বাঁধবে। যদি চপ্পল না থাকে তবে চামড়ার মোজা গীরার নিচ পর্যন্ত কেটে পরিধান করবে। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং: ৪৮৮১)
নারীদের জন্য নিষিদ্ধ
>> নারীদের জন্য অলঙ্কার ও সাজ-সজ্জা প্রকাশ করা যাবে না।
>> হাত মোজা পরা যাবে না।
>> মুখমণ্ডলের উপর নিকাব (ফাটল বিশিষ্ট পর্দা) পরবে না এবং সামনে কাছে কোনো অপর পুরুষ না থাকলে মুখমণ্ডলও আবৃত করবে না।
কাপড় বা শরীরের উকূন মারা নিষিদ্ধ
বিখ্যাত তাবেয়ি ইকরামা (রহ.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, ইহরাম গ্রহণকারী তার কাপড়ে উকূন দেখতে পেলে কী করবে? উত্তরে তিনি বলেন, আলতোভাবে ধরে জমিনে রেখে দেবে, মেরে ফেলবে না। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং: ১৩২৯৭)