উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকারকে টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেওয়া বন্ধ রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। উল্টো ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আগের দেনা শোধ করতে হচ্ছে। ডলার বেচে বাজার থেকে টাকা তোলা অব্যাহত আছে। আবার মূল্যস্ফীতি সামলাতে মানুষ সঞ্চয় করছে কম। সব মিলিয়ে সরকারি-বেসরকারি খাতের সুদহার দ্রুত বাড়ছে। গত মঙ্গলবার ট্রেজারি বন্ডের সুদ বেড়ে সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ১৭ শতাংশে উঠেছে। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারির পর বা প্রায় ১০ বছরের মধ্যে যা সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার ২০ বছর মেয়াদি বন্ডে সুদহার বেড়ে ১২ দশমিক ১৭ শতাংশে উঠেছে। এ রকম সুদে ৫৩০ কোটি টাকা নিয়েছে সরকার। গত মাসে ২০ বছর মেয়াদি বন্ডে সুদ ওঠে ১১ দশমিক ১৬ শতাংশে। আর মঙ্গলবার ১৫ বছর মেয়াদি বন্ডে সুদ উঠেছে ১২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। এ পরিমাণ সুদে সরকার নিয়েছে ৩৬২ কোটি টাকা। গত মাসে এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুদ ছিল ১১ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে বন্ডে সর্বোচ্চ সুদ ওঠে ৯ জানুয়ারি। ওই দিন পাঁচ বছর মেয়াদি বন্ডে সরকার ১১ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদে টাকা নেয়। গত মাসে বিল ও বন্ড মিলে সর্বোচ্চ সাড়ে ১১ শতাংশ সুদে উঠেছিল ৩৬৪ দিন মেয়াদি বিলে।
বাংলাদেশ ব্যাংক এখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রধান অগ্রাধিকার দিয়ে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির পথ অনুসরণ করছে। সুদহার বাড়িয়ে একদিকে মানুষের হাতের টাকা ব্যাংকে ফেরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, অন্যদিকে খরচ বাড়িয়ে চাহিদা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হচ্ছে। এ সময়ে বাজারে তারল্য কমাতে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সরকারের ঋণ কমানো হয়েছে ৩৪ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা। একই সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ৩১ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা নিয়েছে সরকার। এতে করে প্রথম ছয় মাসে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ ৩ হাজার ১১ কোটি টাকা কমেছে।
সঞ্চয়পত্রেও গত নভেম্বর পর্যন্ত সরকারের ঋণ কমেছে ৩ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা। গত অর্থবছরও কমেছিল ৩ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। গত অর্থবছর সঞ্চয়পত্রে কমলেও ব্যাংক থেকে সরকার রেকর্ড ১ লাখ ২২ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি দিয়েছিল ৯৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। আর বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেয় ২৫ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। এসবের বাইরে ডলার সংকট মেটানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে বিক্রি অব্যাহত রেখেছে।
চলতি অর্থবছরের এ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে প্রায় ৭৭৫ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। এর বিপরীতে বাজার থেকে ৮৫ হাজার কোটি টাকার মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে উঠে এসেছে। আর ২০২১ সালের আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২৯ বিলিয়ন ডলার বিক্রির বিপরীতে বাজার থেকে উঠে এসেছে ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকার মতো। পাশাপাশি আস্থাহীনতার কারণে কয়েকটি ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে মানুষ। এসব কারণে অনেক ব্যাংক এখন টাকার সংকটে ভুগছে। ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেপো, স্পেশাল রেপোসহ বিভিন্ন উপায়ে নিয়মিতভাবে ধার দিচ্ছে।
২০২০ সালের এপ্রিল থেকে গত জুন পর্যন্ত গ্রাহক পর্যায়ে সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা ৯ শতাংশ নির্ধারিত ছিল। তবে আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে গত জুলাই থেকে সুদহারের নতুন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। বর্তমানে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের গড় সুদের (স্মার্ট) সঙ্গে ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ যোগ করে সর্বোচ্চ সুদহার নির্ধারিত হচ্ছে। এ ব্যবস্থায় জানুয়ারি মাসে সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশ। ট্রেজারি বিলের সুদহার যত দ্রুত বাড়ছে, তাতে আগামী মাসে ১২ শতাংশ ছাড়াতে পারে।
বর্তমানে ৯১, ১৮২ ও ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিল রয়েছে। আর ২, ৫, ১০, ১৫ ও ২০ বছর মেয়াদি বন্ড রয়েছে। ২ জানুয়ারি দুই বছর মেয়াদি বন্ডের সুদহার প্রথমবারের মতো ১১ শতাংশ ছাড়িয়েছিল। ওই দিন এ ক্ষেত্রে সুদহার উঠেছিল ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ। ২০১৩ সালের মে মাসে প্রথমবারের মতো দুই বছর মেয়াদি বন্ড চালুর পর যা ছিল সর্বোচ্চ। বিল ও বন্ডে সুদহার দ্রুত বৃদ্ধির প্রভাবে গ্রাহক পর্যায়েও ঋণের খরচ বাড়ছে।
অর্থসংবাদ/এমআই