ক্যাটাগরি: জাতীয়স্বাস্থ্য

বাজারে আসছে বাঙালি বিজ্ঞানীর আবিষ্কৃত কৃত্রিম কিডনি

বাঙালি বিজ্ঞানী শুভ রায়ের আবিষ্কৃত কৃত্রিম কিডনি (বৃক্ক) বাজারে আসছে হয়তো এ বছরই। আকারে মানুষের হাতের মুঠোর সমান। আসল বৃক্কের প্রতিস্থাপনের তুলনায় এই কিডনি বসানোর জন্য রোগীর খরচ হবে অনেক কম। বাংলাদেশি বিজ্ঞানী শুভ রায়ের আবিষ্কার করা এই কৃত্রিম বৃক্ক বিশ্ব বাজারে আসার সম্ভাবনা রয়েছে ২০২৪ এর মধ্যেই।

কেবল ভারতেই প্রতিবছর খুব কম করে হলেও আড়াই লাখ মানুষের মৃত্যু হয় কিডনিজনিত বিভিন্ন অসুখে। এই কৃত্রিম কিডনি বাজারে এলে বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ ও তাঁদের পরিবার-পরিজনদের দুশ্চিন্তার দিন চিরতরে শেষ হবে। সেই স্বপ্নই দেখতেন বিজ্ঞানী শুভ রায়।

ড. শুভ রায় আমেরিকা প্রবাসী এক বাঙালি বিজ্ঞানী। যিনি একজন জৈব প্রকৌশলী (বায়ো-ইঞ্জিনিয়ার)। ইনি বছর কয়েক আগেই প্রথম কৃত্রিম কিডনি আবিষ্কার করে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন।

ঢাকার বিখ্যাত চিকিৎসক অশোক নাথ রায়ের পুত্র শুভ। জন্ম ঢাকায়, ১৯৬৯ সালের ১০ নভেম্বর। আদি বাড়ি ছিল চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি থানার রোসাংগিরিতে। ছোটবেলা থেকেই শুভ ছিলেন কল্পনাপ্রবণ। পাঠ্যপুস্তকের বাইরের বিষয় তাঁকে বেশি আকর্ষণ করতো। ঢাকার একটা নার্সারি স্কুলে ভর্তিও হয়েছিলেন।

কিন্তু যখন শুভ’র বয়স পাঁচ, চিকিৎসক অশোক নাথ রায়কে কর্মসূত্রে চলে যেতে হয়েছিল আফ্রিকার দেশ উগান্ডায়। বাংলাদেশ ছেড়ে ছোট্ট শুভ ভর্তি হয়েছিলেন উগান্ডার জিনজা সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুলে। সেখানেই বিদ্যালয় জীবন শেষ করে, আমেরিকা পাড়ি দেন শুভ।

ওহাইও’র মাউন্ট ইউনিয়ন কলেজ থেকে একই সঙ্গে কম্পিউটার সাইন্স, পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতে স্নাতক হন মেধাবী শুভ।

এরপর ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৯৫ সালে ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্সে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। বৈদ্যুতিক প্রকৌশল ও কম্পিউটার সাইন্সে পিএইচডি সম্পন্ন করেন ২০০১ সালে।

১৯৯৮ সালে ওহাইওর ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের বায়ো মাইক্রো ইলেক্ট্রো মেকানিক্যাল সিস্টেমস ল্যাবরেটরির অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর পদে যোগ দেন ড. শুভ রায়। মানুষের শরীরের অপার রহস্য তাঁকে তখন থেকেই ভাবাতে শুরু করে।

চাকরির সঙ্গে সঙ্গে ড. শুভ রায় বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে শিক্ষকতা করতে থাকেন ক্লিভল্যান্ড স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও কম্পিউটার সাইন্সে শিক্ষকতা করতে থাকেন কেস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ ইউনিভার্সিটিতে।

২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত মলিকুলার মেডিসিনে শিক্ষকতা করেন লার্নার কলেজ অব মেডিসিনে।

এরপর, ২০০৯ সালে তিনি ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের মূত্রনালি (নেফ্রোলজি) বিভাগের দায়িত্বে আসেন। তখনই তিনি নিজের চোখে খুব কাছে থেকে দেখেছেন বৃক্কের অসুখে ভুগতে থাকা মানুষদের। জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা কিছু মানুষের মুখ তাঁকে রাতদিন চিন্তামগ্ন রাখতো। দিন শেষে ঘরে ফিরে কোনো কাজে মন বসাতে পারতেন না তিনি।

সারাক্ষণ ভাবতেন কীভাবে সারা বিশ্বে বৃক্কের অসুখে ভোগা মানুষগুলোর মুখে হাসি ফোটানো যায়। কীভাবে আরও কিছুদিন তাদের আয়ু বাড়িয়ে দেওয়া যায়। রাতের পর রাত জেগে মানুষের বৃক্কের সূক্ষাতিসূক্ষ্ম অংশগুলো ও তাদের কাজ নিয়ে পড়াশোনা করতেন তিনি।

মানুষের কল্যাণে শুরু করেছিলেন এক দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা। বায়ো-ইঞ্জিনিয়ার ড. শুভ রায়, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়াতে জীববিজ্ঞান এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান (বায়োইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড থেরাপিউটিক সায়েন্স) পড়িয়ে আসছিলেন ২০০৮ সাল থেকেই। সেখানেই শুরু করলেন এক দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা।

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০ জন অধ্যাপক ও গবেষককে নিয়ে শুরু করেছিলেন ‘কৃত্রিম বৃক্ক’ বা বায়ো আর্টিফিসিয়াল কিডনি (Bio-artificial Kidney) তৈরির কাজ। আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে। গবেষক দলে ছিলেন বিশিষ্ট মূত্রনালি বিশেষজ্ঞ (নেফ্রোলজিস্ট) উইলিয়াম এফ ফিসেল।

দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলেছিল নিরলস গবেষণা। একদিন ড. শুভ রায় আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন সিলিকন ন্যানোপোর ম্যামব্রেন (Silicon Nanopore Membrane-SNM)। এটি সিলিকন নির্মিত সূক্ষ্ম ছিদ্রযুক্ত একটা পর্দা, যা রক্তকে নিখুঁতভাবে ছেঁকে ফেলতে সক্ষম। বাকিটা ইতিহাস।

৪১ জন নাছোড়বান্দা বিজ্ঞানীর নিরলস পরিশ্রমে তৈরি হয়ে গেল কৃত্রিম বৃক্ক।

আমাদের দু’টো বৃক্ক রক্তস্রোত থেকে দূষিত পদার্থগুলো ছেঁকে (Filter) নেয়। জীবন্ত বৃক্কের কোষ দিয়ে তৈরি বায়ো রিঅ্যাক্টর এবং সূক্ষ্ম পর্দার (এসএনএম) মাধ্যমে কৃত্রিম বৃক্ক একইভাবে রক্ত শোধনের কাজ করতে পারে।

যেভাবে শরীরে বসানো হবে এই কৃত্রিম বৃক্ক

আমাদের তলপেটের পেছন দিকে আমাদের দুটো বৃক্ক থাকে। সেখানেই যে কোনো একদিকে, কফির কাপের মতো দেখতে এই কৃত্রিম বৃক্ক বসিয়ে দেওয়া হবে। হৃৎপিণ্ড থেকে দূষিত রক্ত আসবে কৃত্রিম বৃক্কের মধ্যে। সেই রক্তকে ছেঁকে নিয়ে বিশুদ্ধ করে দেবে কৃত্রিম বৃক্ক।

একইসঙ্গে কৃত্রিম বৃক্ক নজর রাখবে গুরুত্বপূর্ণ হরমোনগুলোর উৎপাদন ও ক্ষরণের উপরেও। আসল বৃক্কের মতোই রক্ত শোধন করা ছাড়াও এই কৃত্রিম বৃক্ক রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও ভিটামিন ডি তৈরি করবে।

কৃত্রিম এই বৃক্ক আমেরিকার কয়েক হাজার রোগীর দেহে পরীক্ষামূলকভাবে বসান হয়েছিল। সে পরীক্ষায় সাফল্যের পথে এগিয়ে চলেছে ড. শুভ রায়ের আবিষ্কৃত কৃত্রিম বৃক্ক (Bio-artificial Kidney)। ড. শুভ ও তাঁর টিম এখন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এফডিএ (Food and Drug Administration- FDA ) এর চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায়।

অনুমোদন আসতে চলেছে কিছুদিনের মধ্যেই। হয়তো এই বছরের শেষেই। তারপর বিশ্ব বাজারে কৃত্রিম বৃক্ক আসতে বেশি সময় নেবে না। কারণ দ্রুত উৎপাদনের পরিকাঠামো তৈরি হয়ে গেছে।

এখন প্রশ্ন একটাই, কতো দাম হতে পারে একটা কৃত্রিম বৃক্কের?

সঠিক দাম এখনো জানা যায়নি। তবে, অসহায় পরিবারদের বৃক্ক রোগীর নিয়মিত ডায়ালাইসিস করাতে, সব শেষে বৃক্ক প্রতিস্থাপনের জন্য বিরাট অঙ্কের টাকা জোগাড় করতে হয়। তার তুলনায় কৃত্রিম বৃক্ক বসানোর খরচ অনেক কম হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন ড. শুভ রায়।

তিনি এখন মগ্ন রয়েছেন কৃত্রিম অগ্ন্যাশয় বা ইমপ্লান্টেবল বায়ো-আর্টিফিসিয়াল প্যানক্রেস-আইবিএপি (Implantable Bio-Artificial Pancreas- IBAP) তৈরিতে।

শেয়ার করুন:-
শেয়ার