অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত করতে বন্ধ করতে হবে মানিলন্ডারিং

অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত করতে বন্ধ করতে হবে মানিলন্ডারিং
শিকাগোর শীর্ষ মাফিয়া ডন আলফোনসে গ্যাব্রিয়েল কেপন বা আল-কেপনের কথা অনেকেই হয়তো জেনে থাকবেন। ১৯২০ এর দশকে আমেরিকায় মাদক বেচাকেনা নিষিদ্ধকালীন সময়ে তার ছিল মাদকের রমরমা ব্যবসা। পাশাপাশি পতিতালয়সহ অনেকগুলো অনৈতিক ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল অর্থ আয় করত সে। এভাবে সে গড়ে তোলে সম্পদের পাহাড়। অবৈধ উৎস থেকে আহরিত এসব কালো টাকা সাদা করার জন্য লন্ড্রী ব্যবসা শুরু করে আল-কেপন। শহরজুড়ে স্থাপন করে বেশ কয়েকটি লন্ড্রী যেন বাস্তবে মনে হয় এখান থেকেই তার সকল আয় আসে। পরবর্তীতে সরকারের ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার অপরাধে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ধীরে ধীরে তার সকল অপরাধ সামনে চলে আসে। লন্ড্রী ব্যবসার মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার এই অভিনব পদ্ধতিকে মানি লন্ডারিং নামে আখ্যায়িত করা হয়।

কেপনের মতই সারা বিশ্বে অপরাধীরা তাদের অপরাধ থেকে আসা আয় বৈধ দেখাতে বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে থাকে। এ ধরণের অপরাধ প্রতিরোধে বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই আইন রয়েছে। বাংলাদেশেও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে ২০০২ সালে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন প্রণয়ন করা হয়। পরবর্তীতে ২০০৩ সালে আইনটি সংশোধন করা হয়। ২০১২ সালে পূর্বের আইনটি বাতিল করে নতুন মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন প্রণয়ন করা হয় যা ২০১৫ সালে আংশিক সংশোধন করা হয়েছে।

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে ২৭ ধরনের অপরাধ চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব অপরাধের মধ্য রয়েছে দুর্নীতি ও ঘুষের মাধ্যমে সম্পদ অর্জন, মুদ্র জাল করা, দলিল পত্র জাল করা, চাঁদাবাজি, প্রতারণা, জালিয়াতি, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা, অবৈধ মাদক ও নেশাজাতীয় দ্রব্যের ব্যবসা, চোরাই ও অন্যান্য দ্রব্যের অবৈধ ব্যবসা, অপহরণ, অবৈধভাবে আটক রাখা, খুন ও মারাত্মক শারীরিক ক্ষতি, নারী ও শিশু পাচার, চোরাকারবারি, দেশি-বিদেশি মুদ্রা পাচার, চুরি–ডাকাতি দস্যুতা-জলদস্যুতা বা বিমানে দস্যুতা।

এ সংক্রান্ত অপরাধের মধ্যে আরও রয়েছে মানব পাচারের মাধ্যমে সম্পদ অর্জন, যৌতুকের অর্থ, চোরাচালান ও শুল্কসংক্রান্ত অপরাধ, করসংক্রান্ত অপরাধ, মেধাস্বত্ব লঙ্ঘন, সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়ন, ভেজাল বা স্বত্ব লঙ্ঘন করে পণ্য উৎপাদন, পরিবেশগত অপরাধ, যৌন নিপীড়ন, পুঁজিবাজার সম্পর্কিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশের আগে তথ্য কাজে লাগিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা, ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে অর্থ আদায় এবং সংঘবদ্ধ কোনো অপরাধী দলে অংশ নেওয়া।

এ ধরনের অপরাধ প্রমাণিত হলে ব্যক্তির ক্ষেত্রে ৪ থেকে ১২ বছরের কারাদন্ড ও এর পাশাপাশি মানিলন্ডারিংকৃত অর্থের দ্বিগুণ অথবা ১০ লক্ষ টাকা যেটা বেশি এবং প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে নিবন্ধন বাতিল এবং মানিলন্ডারিংকৃত অর্থের দ্বিগুণ অথবা ২০ লক্ষ টাকা যেটা বেশি সে পরিমাণ জরিমানার বিধান রয়েছে। এছাড়া আদালত অপরাধে জড়িত সমুদয় অর্থ রাষ্ট্রের অনুকুলে বাজেয়াপ্ত করতে পারে।

কোন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্ট না করলে আইন অনুযায়ী অনূন্য ৫০ হাজার টাকা থেকে অনুর্ধ ২০ লক্ষ টাকা জরিমানা হতে পারে। অধিকন্তু সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন স্থগিত বা বাতিল হতে পারে।

এ আইন অনুযায়ী, বৈধ অনুমোদন ছাড়া দেশের বাইরে অর্থ-সম্পত্তি প্রেরণ বা পাচার কিংবা দেশের বাইরে উপার্জিত সম্পত্তি, যাতে বাংলাদেশের স্বার্থ রয়েছে, তা ফেরত না আনা কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে বিদেশে অর্জিত অর্থ বা প্রকৃত পাওনা দেশে না আনা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।

অর্থ পাচারের নানামুখী উৎসের মধ্যে রয়েছে বিদেশে বিনিয়োগের আড়ালে অর্থ পাচার, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসাসহ অসদুপায়ে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার, মানব পাচারের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ পাচার, অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির আশঙ্কায় রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যবসায়ী বিদেশে অর্থ পাচার করে থাকেন। এছাড়া মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর ট্রান্সফার মিসপ্রাইসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচারের সম্ভাবনা থাকে।

অপরাধীরা তাদের টাকা ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে বিভিন্ন কর্মকান্ড সম্পাদন করার চেষ্টা করে থাকে। ব্যাংকিং চ্যানেলে যেন মানিলন্ডারিং সংঘটিত হতে না পারে সে লক্ষ্যে ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের বেধে দেয়া নিয়ম কানুন অনুসরণ করে নিয়মিত রিপোর্ট করে থাকে।

সন্দেহজনক লেনদেন হলে সাথে সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকে রিপোর্ট করার নিয়ম রয়েছে। আইন অনুযায়ী, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কাস্টমস, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), পরিবেশ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এ সংক্রান্ত অপরাধের তদন্ত করতে পারবে।

অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ অর্থনীতির মূলধারায় প্রবেশ করাতে প্রথম পর্যায়ে তা ব্যাংকের হিসাবে জমা করা হয়। এরপর ছোটছোট বিভিন্ন লেনদেনের মাধ্যমে ঐ টাকা ছড়িয়ে দেয়া হয়। তৃতীয় ধাপে আপাত দৃষ্টিতে বৈধ মনে হওয়া ঐ অর্থ বিভিন্ন কাজে বিনিয়োগ করা হয়। এভাবে কালো টাকা সাদা করে মানিলন্ডারিং করে থাকে অপরাধীরা।

সরকারের কর ও শুল্ক ফাঁকি দেয়ার লক্ষ্যে মানিলন্ডারিং করে থাকে অনেকে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এক্সপোর্ট ও ইমপোর্ট ব্যবসায় ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমেও মানিলন্ডারিং সংঘটিত হয়। দেশে কি পরিমাণ মানিলন্ডারিং হয় তার কোন পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে দেশে এমন অনেক অফিস রয়েছে যেখানে ঘুষ ছাড়া ফাইল সই করা হয় না। অন্যান্য সম্পৃক্ত অপরাধের তালিকা ধরে হিসাব কষলে মানিলন্ডারিংয়ের অংক মিলানো কঠিন হয়ে পড়বে। তবে গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির রিপোর্ট অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রতি বছর দেশ থেকে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। এছাড়া অন্যান্য উপায়ে দেশ থেকে প্রতি বছর এক লক্ষ কোটি টাকার বেশি পাচার হয়ে থাকে।

মানিলন্ডারিংয়ের কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ডলারের মূল্য বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঘাটতির মাধ্যমে সামিগ্রকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। এত বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশে বিনিয়োগ করা সম্ভব হলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও প্রকৃত উৎপাদন অনেক বেড়ে যেত, সাধারণের নাগালের মধ্যে রাখা যেত দ্রব্যমূল্য, নিশ্চত হতো টেকসই উন্নয়ন, তরান্বিত হতো প্রকৃত উন্নত দেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন।

মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে প্রতিবছর দেশ থেকে বিপুল অর্থ বাইরে চলে গেলেও অপরাধীরা থেকে যাচ্ছে ধরা ছোয়ার বাইরে। স্বল্প সংখ্যক ঘটনায় মামলা হলেও মামলার বিচারকাজে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে তা এক সময় সাধারণ মানুষের দৃষ্টির অগোচরে চলে যায়। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা ও অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করে তা জনসম্মুখে আনার ব্যবস্থা করলে দেশে মানিলন্ডারিংয়ের সাথে সাথে অনেক বড় বড় অপরাধ কমে আসবে বলে আশা করা যায়।

মানিলন্ডারিংয়ের মত অপরাধ দমনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পাশাপাশি আর্থিক খাত সংশ্লিষ্ট সবাইকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। এ ধরণের অপরাধ সংঘটনের সম্ভাবনা দেখা গেলে তা আগে থেকেই প্রতিরোধের চেষ্টা করতে হবে সবাইকে। বাড়াতে হবে সততার চর্চা ও সৎভাবে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা।

লেখক: ব্যাংকার

ই-মেইল: riyazenglish@gmail.com

আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন

খেলাপির ফাঁদে ব্যাংক খাত: সমাধান কোন পথে
বাণিজ্যিক বিবেচনায়  ‘সৌরবিদ্যুৎ’ টেকসই এবং অনেক বেশি লাভজনক
কক্সবাজার: বাংলাদেশে অফুরন্ত পর্যটন সুযোগ উন্মোচন
বাংলাদেশে ঈদ উৎসব ও ব্যাংক ব্যবস্থাপনা
অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত করতে বন্ধ করতে হবে মানিলন্ডারিং
ওএসডি কোন নীতিমালার মধ্যে পড়ে
নেট দুনিয়ার ব্যাংকিং
সর্বজনীন কল্যাণে ইসলামী ব্যাংক: আন্তরিক সেবার ৪০ বছর
সুইডেনের ইনফ্লেশন ১২ শতাংশ, গোল ২ শতাংশ
ব্যাংকের নাম: লিমিটেড থেকে পিএলসি