রপ্তানি বিলে অগ্রণী ব্যাংকে অভিনব আর্থিক জালিয়াতি

রপ্তানি বিলে অগ্রণী ব্যাংকে অভিনব আর্থিক জালিয়াতি
গ্রাহক পাবে ৩৭ কোটি টাকা। ব্যাংক দিলো ৭৫ কোটি টাকা। ধরা খাওয়ার পর ‘ভুল’ বলে চালিয়ে দিচ্ছে। অনুসন্ধান বলছে, ব্যাংকের সে ‘ভুল’ একই সময়ে ১৪ বার ঘটেছে। শুধু তাই নয়, এই ভুল শোধরানোর ছলে গ্রাহকের নামে আরও ৩৭ কোটি টাকা ঋণ সৃষ্টি (ফোর্সড লোন) করে চলে যাওয়া টাকা সমন্বয় করা হয়। প্রায় দেড় বছর আগে ঘটে যাওয়া অভিনব এই জালিয়াতির টাকা আজও ফেরত আসেনি।বিশ্লেষকরা বলছেন এ ধরনের জালিয়াতির কারণে সরকারি ব্যাংক এবং সরকারের ভাবমুর্তি নষ্ট হচ্ছে। এ ঘটনায় জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়নি অগ্রনী ব্যাংক।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, এটা কোনো ভুল নয়, সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত এবং দণ্ডনীয় অপরাধ করা হয়েছে। এ বিষয়গুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর দৃষ্টিতে দেখা উচিত।

অগ্রণী ব্যাংকের নিজস্ব তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ম্যাগপাই গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান মেসার্স ম্যাগপাই নিটওয়্যার লিমিটেডের রপ্তানি বিলের বিপরিতে একবার বা দুইবার নয় ১৪ বার দিগুণ টাকা দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান শাখা। ২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর প্রথম রপ্তানি বিলটির জন্য পরিশোধ করা হয় ৪৬ লাখ ৫৮ হাজার ৩০৮ টাকা। একই বিলের জন্য সমপরিমাণ টাকা দ্বিতীয়বার গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে পাঠানো হয় ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর। বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্বিতীয়বার পাঠানো টাকা ব্যাংক কর্মকর্তাদের সুস্পষ্ট জালিয়াতি।

তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির দ্বিতীয় রপ্তানি বিল হিসেবে ২০১৮ সালের ২২ অক্টোবর জমা হয়েছে ২ কোটি ৭৬ লাখ ৬ হাজার ৮০৪ টাকা। একই বিলের সমপরিমাণ অর্থ গ্রাহকের হিসাবে পাঠানো হয়েছে ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর। তৃতীয় বিলের ৩ কোটি ২১ লাখ ৯৬ হাজার ৬৩৫ টাকা ২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর জমা করা হয়েছে গ্রাহকের হিসাবে। এই বিলের সমপরিমাণ অর্থ আবারও গ্রাহকের হিসাবে পাঠানো হয় ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর। একইভাবে ২০১৮ সালের ৫ নভেম্বর ১ কোটি ১৫ লাখ ১০ হাজার ৪৩৪ টাকার রপ্তানি বিল জমা হলেও একই বিলের সমপরিমাণ অর্থ দ্বিতীয়বারের মতো গ্রাহাকের হিসাবে জমা করা হয় ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর। ৫ম বিল হিসেবে ২ কোটি ১৯ লাখ ৬৯ হাজার ৯৮৫ টাকা ২০১৮ সালের ২২ নভেম্বর গ্রাহকের হিসাবে জমা করলেও সমপরিমাণ অর্থ আবারও ২০১৯ সালের ১৭ নভেম্বর গ্রাহকের হিসাবে পাঠানো হয়। ৬ষ্ঠ বিলটি পরিশোধ করা হয় ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর। যার পরিমাণ ৩ কোটি ৩৬ লাখ ৯২ হাজার ১৭ টাকা। তবে দ্বিতীয়বার একই বিলের সমপরিমাণ অর্থ পাঠানো হয় ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর। বিলগুলো ব্যাংকের ফরেন কারেন্সি অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট ডিভিশন (এফসিএমডি) কর্তৃক সমন্বয় করা হয়েছে ২০১৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর।

প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ৭ম বিলের বিপরিতে ৩ কোটি ২৪ লাখ ১০ হাজার ৮১৯ টাকা দুই বার গ্রাহকের হিসাবে পাঠিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। এর মধ্যে প্রথম তারিখটি হলো ২০১৯ সালের ১৯ জানুয়ারি এবং দ্বিতীয়টি পাঠানো হয় একই বছরের ১৫ ডিসেম্বর। ৮ম বিলের ৩ কোটি ৭৪ লাখ ৯৭ হাজার ৩৪৪ টাকা গ্রাহককে পাঠানো হয় ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৭ তারিখ। দ্বিতীয়বারে বিলটির সমপরিমাণ অর্থ একই বছরের ১৫ ডিসেম্বর গ্রাহকের হিসাবে পাঠায় ব্যাংক। ৭ম ও ৮ম বিল দু’টি সমন্বয় করা হয় ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি।

নবম বিল হিসেবে ২০১৯ সালের মার্চ মাসের ২৮ তারিখ ২ কোটি ৬৮ লাখ ৩৬ হাজার ৯৮৪ টাকা পাঠানো হয় ম্যাগপাই নিটওয়্যারের হিসাবে। তবে একই বিলের জন্য পাঠানো অনিয়মের টাকাটি পাঠানো হয়েছে একই বছরের ১৫ ডিসেম্বর। ১০ নম্বর বিলের বিপরীতে ৩ কোটি ৩৭ লাখ ১৫ হাজার ৫৩১ টাকা পরিশোধ করা হয় ২০১৯ সালের ১৮ মার্চ। সমপরিমাণ টাকা আবারও পাঠানো হয়েছে একই বছরের ১৫ ডিসেম্বর। নবম এবং দশম বিলটি ২০১৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর সমন্বয় করে অগ্রণী ব্যাংকের ফরেন কারেন্সি বিভাগ। ১১ নম্বর রপ্তানি বিলের মূল্য ছিল ১ কোটি ৫৪ লাখ ১৩ হাজার ৪৩০ টাকা। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় টাকাটি গ্রাহকের হিসাবে পাঠানো হয় ২০১৯ সালের ২২ মে। তবে অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় টাকাটি আবারও গ্রাহকের হিসাবে ১৫ ডিসেম্বর পাঠিয়েছে ব্যাংক। ব্যাংকের এফসিএমডি কর্তৃক বিলটি সমন্বয় করা হয় ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি।

এ ১৪টি বিলের মধ্যে এখনও পর্যন্ত অসমন্বিত (১২, ১৩) রয়েছে দুইটি বিল। এর মধ্যে প্রথম বিলের ২ কোটি ৭৭ লাখ ৯৪ হাজার ১১৩ টাকা পরিশোধ করা হয় ২০১৯ সালের ৩০ মার্চ। দ্বিতীয়বার সমপরিমাণ টাকা গ্রাহকের হিসাবে পাঠানো হয় ৩০ ডিসেম্বর। অসমন্বিত দ্বিতীয় বা ১৩ নম্বর বিলের ৩ কোটি ৩৪ লাখ ৮২ হাজার ৬৬২ টাকা পরিশোধ করা হয় ২০১৮ সালের ৫ ডিসেম্বর। একই বিলের সমপরিমাণ টাকা আবারও ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর গ্রাহকের হিসাবে পাঠায় অগ্রণী ব্যাংক। সর্বশেষ এবং ১৪ নম্বর বিলের বিপরীতে ৩ কোটি ৪০ লাখ ৮২ হাজার ৪৪০ টাকা ২০১৯ সালের ২৩ মার্চ গ্রাহকের হিসাবে পাঠানো হয়। সমপরিমাণ টাকা আবারও ৩০ ডিসেম্বর পাঠানো হয়েছে গ্রাহক বরাবর। ব্যাংকের ফরেন কারেন্সি বিভাগ টাকাটি সমন্বয় করে ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি।

অগ্রণী ব্যাংকের যে বিভাগে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন সম্পন্ন হয় তার নাম ফরেন কারেন্সি অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট ডিভিশন (এফসিএমডি)। রপ্তানি বিলের সব টাকা এসে জমা হয় এই বিভাগে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় গ্রাহকের রপ্তানির টাকা পরিশোধের জন্য ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা এমওডিএ বা ডেবিট অ্যাকাউন্ট তৈরি করে এফসিএমডিতে জমা দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে শাখা বরাবর টাকা পাঠায় সংশ্লিষ্ট বিভাগটি। সেই টাকা আবার গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেয় শাখা। কিন্তু একই বিলের বিপরীতে সমপরিমাণ টাকা দ্বিতীয়বার পাঠানোর কোনো নিয়ম বাংলাদেশে নেই।

তদন্ত চলাকালীন সময়ে প্রধান শাখা বরাবর প্রয়োজনীয় নথিপত্র সরবরাহ করার জন্য বিভিন্ন সময়ে মৌখিক এবং তিনবার লিখিতভাবে অনুরোধ করা সত্ত্বেও তা সরবরাহ করা হয়নি। যে সব নথিপত্র, ভাউচার, রিয়েলাইজেশন সিট, সুইফট কপিসহ বিভিন্ন কাগজ সরবরাহ করা হয়েছে তার অধিকাংশই স্বাক্ষরবিহীন এবং নকল।

এ বিষয়ে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ শামস উল ইসলাম জানান, বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ডিএমডি দেখছেন।যেকোন অনিয়মই ব্যাংকের সুনাম নষ্ট করে।বিষয়টি দেখে আমি বলতে পারবো । তবে আমদানি রপ্তানি পর্যালোচনার জন্য একটি বিভাগ রয়েছে যারা সবসময় বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে। একই বিল একাধিকবার রিয়েলাইজেশন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই আমাদের ব্যাংকে। ভুলবশত দুই একটা বিল ডাবল হতে পারে, তবে এটা নিয়মিত নয়। ম্যাগপাই নীটওয়্যার লিঃ আমাদের অনেক পুরনো এবং ভালো কাস্টমার (গ্রাহক)।  আমাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক খুবই ভালো।

 

আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন

বিদেশি ডেবিট কার্ডে অর্থ তোলা বন্ধ করল ইবিএল
এসবিএসি ব্যাংকের নতুন এএমডি নূরুল আজীম
বছরজুড়ে আলোচনায় খেলাপি ঋণ, সুদহার ও বিনিময়হার
বিকাশের প্রধান যোগাযোগ কর্মকর্তা মাহফুজ মারা গেছেন
ন্যাশনাল ব্যাংকের নতুন পর্ষদের ৩ কমিটি গঠন
ব্যাংকে চাকরির আবেদনের বয়সসীমা শিথিল
মাসিক সঞ্চয় হিসাব খোলা যাচ্ছে বিকাশ অ্যাপে
ফের এবিবির চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন
অফিসার পদে ৭৮৭ জনকে নিয়োগ দেবে সরকারি ৫ ব্যাংক
ন্যাশনাল ব্যাংকের নতুন পরিচালক হলেন যারা