জেড ক্যাটাগরির কোম্পানিগুলোর ‘বড় দায়’ বিনিয়োগকারীদের কাঁধে

জেড ক্যাটাগরির কোম্পানিগুলোর ‘বড় দায়’ বিনিয়োগকারীদের কাঁধে

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি শ্যামপুর সুগার মিলস লিমিটেডের শেয়ারদর গত দুই সপ্তাহ ধরে বাড়ছে। দীর্ঘ সময় কোম্পানিটি বড় লোকসানে রয়েছে। তালিকাভুক্তির দুই যুগেরও বেশি সময়ে বিনিয়োগকারীদের দেওয়া হয়নি কিছুই। আবার শেয়ার প্রতি সম্পদও ঋণাত্মক, তবে শেয়াদর ছুটছে ঘোড়ার গতিতে। দুই শতাধিক কোম্পানির ফ্লোর প্রাইসে আটকা পড়ার বিপরীতে লোকসানি কোম্পানির শেয়ারদর বৃদ্ধির পেছনে কারসাজি চক্র জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। বাজারে যখন লেনদেন কিছুটা কম থাকে তখন লোকসানি দুর্বল মৌলভিত্তির কোম্পানিগুলো নিয়ে কারসাজি চক্র কৃত্রিম সংকট তৈরী করে শেয়ারদর বৃদ্ধি করে। জেড ক্যাটাগরিতে থাকা শ্যামপুর সুগার, জিলবাংলা, মেঘনাপেট, ইমাম বাটনসহ বেশ কয়েকটি দুর্বল কোম্পানির শেয়ার নিয়ে বিভিন্ন গুঞ্জন ছড়ানোকে শেয়ারদর বৃদ্ধির হাঁতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে চক্রটি। যেখানে প্রায় শতাধিক ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ারদর ফ্লোর প্রাইসে আটকে রয়েছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সম্পদ ঋণাত্মক থাকা কোম্পানির শেয়ার কেনার অর্থ হচ্ছে, কোম্পানির দায় নিজেদের কাঁধে নেওয়া।


জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের কোম্পানি শ্যামপুর সুগার মিলস লিমিটেড। তালিকাভুক্তির পর দীর্ঘ ২৭ বছরেও কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের কোন লভ্যাংশ দেয়নি। লোকসানে থাকা কোম্পানিটি শেষ কবে মুনাফা করেছে তারও কোন তথ্য নেই। অথচ একটি চক্রের কারসাজিতে শেয়ারটির দর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

সূত্র মতে, গত ১ মার্চ শ্যামপুর সুগার মিলসের শেয়ারদর ছিল ৬৩ টাকা ১০ পয়সা। সোমবার (১৩ মার্চ) শেয়ারটি সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ৯০ টাকা ৮০ পয়সা। অর্থাৎ সাত কার্যদিবসের ব্যবধানে কোম্পানিটির শেয়ারদর ২৭ টাকা ৭০ পয়সা বা ৪০ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেড়েছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে শ্যামপুর সুগার মিলসের যে তথ্য দেওয়া আছে, সে অনুযায়ী কোম্পানিটির কোন সম্পদ নেই। উল্টো বড় দায় রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির কাঁধে। ১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া শ্যামপুর সুগারের পরিশোধিত মূলধন ৫ কোটি টাকা। দীর্ঘ মেয়াদে কোম্পানিটির যে ঋণ রয়েছে তা পরিশোধিত মূলধনের তুলনায় ৪৫ গুণ বেশি। শ্যামপুর সুগার মিলস মুনাফা করেছে এমন কোন তথ্য নেই প্রধান শেয়ারবাজারের ওয়েবসাইটে।

ডিএসইর তথ্য বলছে, সর্বশেষ হিসাববছরে শ্যামপুর সুগার মিলস বড় লোকসান দিয়েছে। ২০২২ সালে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছে ৫৩ টাকা ০৩ পয়সা। এ হিসেবে কোম্পানিটির লোকসানে পরিমাণ ২৬ কোটি ৫১ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

শুধু ২০২২ সালেই নয়, শ্যামপুর সুগার মিলস কবে মুনাফা করেছে এমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। জানা গেছে, ২০১৮ সালে কোম্পানিটি লোকসান করেছে ৪৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা। পরের বছর (২০১৯) কোম্পানিটির লোকসান বেড়ে দাঁড়ায় ৬৩ কোটি ১৪ লাখ ৫০ হাজার টাকায়। এছাড়াও ২০২০ সালে ৬০ কোটি ৬৯ লাখ এবং ২০২১ সালে ৬২ কোটি ৫৭ লাখ করে লোকসান করে শ্যামপুর সুগার।

সর্বশেষ হিসাববছরে শ্যামপুর সুগারের শেয়ার প্রতি সম্পদ মূল্য ঋণাত্মক ছিল। অর্থাৎ হিসাববছর শেষে কোম্পানির কোন সম্পদ ছিল না, উল্টো দায় ছিল। হিসাববছর শেষে শেয়ার প্রতি দায়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ১৬৭ টাকা ৫৭ পয়সায়। এ হিসেবে কোম্পানিটির দায়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৮৩ কোটি ৭৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

জানা গেছে, সোমবার (১২ মার্চ) প্রধান শেয়ারবাজারে দুই শতাধিক কোম্পানির শেয়ারদর অপরিবর্তিত ছিল। এর মধ্যে বেশিরভাগ কোম্পানিই ছিল ফ্লোর প্রাইসে। তবে শ্যামপুর সুগার মিলসের শেয়ারদর আজ ৮ টাকা ২০ পয়সা বা ৯ দশমিক ২৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

শ্যামপুর সুগার মিলসের ৫১ শতাংশ শেয়ার সরকার ধারণ করছে। ০ দশমিক ৮৫ শতাংশ শেয়ার প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এবং ৪৮ দশমিক ১৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে।

শুধু শ্যামপুর সুগার নয়, জিলবাংলা সুগার মিলস, মেঘনাপেট, ইমাম বাটনসহ বেশ কয়েকটি দুর্বল কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, জিলবাংলা সুগার মিলস লিমিটেডও বিনিয়োগকারীদের এখন পর্যন্ত কোন লভ্যাংশ দেয়নি। সর্বশেষ হিসাববছরে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৮৮ টাকা ২৭ পয়সা। এ হিসেবে এক বছরে কোম্পানিটির লোকসান হয়েছে ৫২ কোটি ৯৬ লাখ ২০ হাজার টাকা। এর আগের বছরও (২০২১) সালে ৬৯ কোটি ৫৮ লাখ ২০ হাজার টাকা লোকসান দিয়েছিল।

জানা গেছে, সমাপ্ত হিসাববছরে জিলবাংলা সুগার মিলসের শেয়ার প্রতি সম্পদ মূল্য (এনএভি) ছিল ঋণাত্মক। বছর শেষে দায়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৩৪ কোটি ৪২ লাখ টাকায়। খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের কোম্পানিটির শেয়ারদর ৯ কার্যদিবসে ২৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

১৯৯৬ সালে তালিকাভুক্ত হওয়া জিংলাবাংলা সুগার মিলে সরকারের ৫১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে ১২ দশমিক ৭৬ শতাংশ শেয়ার। বাকি ৩৬ দশমিক ২৪ শতাংশ শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ধারণ করছেন।

মেঘনা পেট ইন্ডাস্ট্রিজ দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ২০০১ সালে। তালিকাভুক্তির পর থেকে এই কোম্পানিটিও বিনিয়োগকারীদের কোন লভ্যাংশ দেয়নি। সর্বশেষ হিসাববছরে (২০২২) কোম্পানিটির লোকসান হয়েছে ৩৭ লাখ ২০ হাজার টাকা। ২০২১ সালেও ৩৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা লোকসান ছিল কোম্পানিটির। সমাপ্ত হিসাববছরে কোম্পানিটির দায় দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৮২ লাখ টাকায়। অথচ গত ৮ কার্যদিবসে মেঘনা পেটের শেয়ারদর ৩০ দশমিক ৬৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

১২ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের মেঘনা পেটের বর্তমানে ১৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ রয়েছে। কোম্পানিটির ৫০ শতাংশ শেয়ার উদ্যোক্তাদের হাতে এবং বাকি ৫০ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ধারণ করছেন।

ওষুধ ও রসায়ন খাতের কোম্পানি ইমাম বাটন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ১৯৯৬ সালে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। এর মধ্যে শুধুমাত্র ২০১০ সালে কোম্পানিটি ১০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছিল। এছাড়া আর কোন বছরই বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেয়নি কোম্পানিটি। ২০১৮ সালের পর কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে ডিএসইতে কোন তথ্য নেই। ২০১৮ সালে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি ৪০ পয়সা করে লোকসান করেছিল। গত ৮ কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছে ৫ টাকা ৭০ পয়সা বা ৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ।

৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের ইমাম বাটনে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৬০ দশমিক ৯১ শতাংশ শেয়ার ছিল। উদ্যোক্তাদের হাতে রয়েছে ৩০ দশমিক ০৮ শতাংশ শেয়ার। আর বাকি ৯ দশমিক ০১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ অর্থসংবাদকে বলেন, দীর্ঘদিন লভ্যাংশ না দেওয়া,লোকসানে থাকা কোম্পানিগুলো নিয়ে মূলত একটি চক্র কারসাজি করে। এর সাথে কোম্পানির ম্যানেজমেন্টও কখনও কখনও জড়িত থাকে। তবে সরকারি কোম্পানির ক্ষেত্রে তো আর সরকার কিছু করে না, বিভিন্ন চক্র কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারের দাম বাড়ায়।

অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, আবার এসব শেয়ারকে অনেকে বিটকয়েন মনে করে। তারা মনে করে, আমি যে দামে কিনছি, অন্য কেউ আরও বেশি দামে কিনবে। এসব কারণে এসব শেয়ারের দাম বৃদ্ধি পায়।

অধ্যাপক আবু আহমেদ মনে করেন, এ ধরণের কোম্পানিগুলোর শেয়ার কেনা মানে হচ্ছে কোম্পানির দায় কিনে নেওয়া। তিনি বলেন, ভালো কোম্পানির শেয়ার কিনে আটকে গেলেও বছর শেষে লভ্যাংশ পাওয়া যায়। তবে লোকসানি বা দুর্বল কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে এ ধরণের সুযোগ থাকে না।

জানতে চাইলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম অর্থসংবাদকে বলেন, কোন কোম্পানির শেয়ারদর কত হবে তা বিএসইসির দেখার বিষয় নয়। তবে কোম্পানির শেয়ার ইনসাইড ট্রেডিং হচ্ছে কি না, সেটি বিএসইসি দেখবে। বিনিয়োগকারীরা যদি বেশি দামে শেয়ার কেনে সেটি তাদের বিষয়।

বিএসইসি মুখপাত্র বলেন, যেসব কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ৩০ কোটির কম, তাদেরকে কমিশন থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন

ফু-ওয়াং সিরামিকের লভ্যাংশ অনুমোদন
এক বছরে ডিএসইর বাজার মূলধন বেড়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা
ডিএসইতে মোবাইল গ্রাহক-লেনদেন দুটোই কমেছে
বছরজুড়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির অনুমোদন পেয়েছে ৯ কোম্পানি
পুঁজিবাজারে লেনদেন বন্ধ আজ
বছরের ব্যবধানে পুঁজিবাজারে লেনদেন বেড়েছে ৪০ শতাংশ
রবিবার পুঁজিবাজার বন্ধ থাকলেও চলবে দাপ্তরিক কার্যক্রম
লোকসানে ৮ খাতের বিনিয়োগকারীরা
সাপ্তাহিক রিটার্নে মুনাফায় ১০ খাতের বিনিয়োগকারীরা
খাতভিত্তিক লেনদেনের শীর্ষে প্রকৌশল খাত