লোকসানি ন্যাশনাল ব্যাংকে নিয়োগের হিড়িক!

লোকসানি ন্যাশনাল ব্যাংকে নিয়োগের হিড়িক!

দেশের সবচেয়ে বড় মূলধনী আর্থিক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও ২০২২ সালে মুনাফা করতে পারেনি ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড। লোকসান করায় প্রতিষ্ঠানটি গত বছরের আর্থিক বিবরণীও প্রকাশ্যে আনেনি। অথচ এই সংকটের মধ্যেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ব্যাংকটিতে ব্যাপক নিয়োগ চলছে। এসব নিয়োগকে ঘিরে ব্যাংকখাতে নানা প্রশ্ন উঠেছে।


দেশের সবচেয়ে বড় মূলধনী আর্থিক প্রতিষ্ঠান হলেও ২০২২ সালে লোকসান করেছে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড। কমেছে প্রতিষ্ঠানটির সম্পদমূল্যও। তবে সংকটের মধ্যেও কর্মী নিয়োগ দিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এসব নিয়োগ প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, সম্প্রতি ট্রেইনি এসিস্ট্যান্ট থেকে শুরু করে এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট (ইভিপি) পর্যন্ত পদে নিয়োগ দিয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক। বৈশ্বিক সংকটের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শ অনুযায়ী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে পরিচালন ব্যয় কমাচ্ছে, সেখানে গত চার মাসে ৩টি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে ব্যাংক খাতের এই প্রতিষ্ঠানটি। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে পদ সংখ্যাও ছিল অনির্ধারিত।

মূলত নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যাংকটির সদ্যবিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. মেহমুদ হোসেন ও মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান শেখ আকতার উদ্দিন আহমেদ সিন্ডিকেট তৈরি করে বেশকিছু প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগ দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। নিজেদের লোক নিয়োগ দেওয়ার সুবিধার্থে ব্যাংকটিতে নতুন-নতুন বিভাগও খুলেছেন তারা। এমনকি পরীক্ষার মাধ্যমে যেসব নিয়োগ হয়েছে- সেগুলো নিয়েও বড় প্রশ্ন তৈরি হয়েছে ব্যাংক খাতে।

ন্যাশনাল ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনগুলো ঘেটে দেখা গেছে, ব্যাংকটি বর্তমানে মারাত্মক দুরাবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মূলত ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা ও ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ায় ২০২২ সালে অধিকাংশ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা বাড়লেও উল্টো লোকসানে গেছে ন্যাশনাল ব্যাংক। ব্যবসা ও রিকভারিতে মনোযোগ না দিয়ে উল্টো উচ্চবেতনে বিপুল নিয়োগের মাধ্যমে পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি করার কারণে বড় লোকসানে গেছে ব্যাংকটি।

সূত্র জানায়, গত বছরের ২৭ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার জারি করে ব্যাংকগুলোকে পরিচালন ব্যয় কমানোর নির্দেশ দিয়েছিল। সংকোচনের মাধ্যমে সাশ্রয় হওয়া অর্থ অন্য কোন খাতেও ব্যয় করা যাবে না। মূলত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দেশের ব্যয় সংকোচনের প্রক্রিয়া হিসেবেই ব্যাংক খাতে ব্যয় সংকোচনের নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অথচ রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা অমান্য করে দেশের স্বার্থের দিকে না তাকিয়ে নিজস্ব স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রভাবশালী এই সিন্ডিকেট। পরিচালনা পর্ষদের অগোচরেই মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান সদ্য বিদায়ী এমডিকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন পদে জনবল নিয়োগ দিয়েছে।

জানা গেছে, ১৯৮৪ সালে দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ন্যাশনাল ব্যাংক। তালিকাভুক্ত হওয়ার পর থেকে শুধুমাত্র ২০১৯ সালে বিনিয়োগকারীদের জন্য নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল ২ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের প্রতিষ্ঠানটি। কোম্পানিটির সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের তিন প্রান্তিকে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ন্যাশনাল ব্যাংকের লোকসান হয়েছে ৩৫৭ কোটি টাকা। অথচ ২০২১ সালের একই সময়ে ১৩৪ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছিল ব্যাংকটি। আর ২০২০ সালে ৯ মাসে নিট মুনাফার পরিমাণ ছিল ৩৪৮ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত সর্বশেষ হিসাববছরের (২০২২) আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি ন্যাশনাল ব্যাংক। ২০২১ সালের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যাংকটি মুনাফা করেছিল ২৪৮ কোটি টাকা এবং এর আগের বছরের (২০১৯) মুনাফা ছিল ৯২০ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১১ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। এক বছর আগে যা ছিল ৪ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা। এক বছরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬ হাজার ৭৪৭ কোটি টাকা। এখন ব্যাংকটির ২৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ ঋণই খেলাপি।

এদিকে ব্যাংকটি তারল্য-সংকটেও পড়েছে। অনেক শাখায় আমানত কমেছে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকে আমানতের বিপরীতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ এসএলআর (বিধিবদ্ধ জমা) জমা রাখতে পারছে না। এ জন্য প্রতিনিয়ত জরিমানা গুনতে হচ্ছে ন্যাশনাল ব্যাংককে। এরপরও ব্যাংকটির আর্থিক পরিস্থিতির উন্নতিতে মনোযোগ না দিয়ে মানবসম্পদ বিভাগের প্রধানকে সঙ্গে নিয়ে নতুন-নতুন নিয়োগে মনোযোগ দিতে দেখা গেছে সদ্যবিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালককে। যে কারণে ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির আর্থিক সূচক আরও শোচনীয় অবস্থায় গেছে।

এই পরিস্থিতির মধ্যেও গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত চার মাসে ৩টি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে ব্যাংকটি। গত ২৭ অক্টোবর এভিপি, এসএভিপি ও ভিপি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয় ন্যাশনাল ব্যাংক। ২৯ নভেম্বরে জুনিয়র অফিসার থেকে এসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি ব্রাঞ্চ ম্যানেজার পদের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয় ব্যাংকটি। তিনটি বিজ্ঞপ্তিতেই পদ সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি। সংশ্লিষ্টদের মতে , মূলত নিজেদের মতো করে লোক নেওয়ার সুবিধার্থেই পদ সংখ্যা উন্মুক্ত রেখেছেন সিন্ডিকেটের হোতারা।

এ বিষয়ে জানার জন্য ন্যাশনাল ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর হোসাইন আখতার চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তাঁর মুঠোফোনে সংযোগ পাওয়া যায়নি।

আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন

বিদেশি ডেবিট কার্ডে অর্থ তোলা বন্ধ করল ইবিএল
এসবিএসি ব্যাংকের নতুন এএমডি নূরুল আজীম
বছরজুড়ে আলোচনায় খেলাপি ঋণ, সুদহার ও বিনিময়হার
বিকাশের প্রধান যোগাযোগ কর্মকর্তা মাহফুজ মারা গেছেন
ন্যাশনাল ব্যাংকের নতুন পর্ষদের ৩ কমিটি গঠন
ব্যাংকে চাকরির আবেদনের বয়সসীমা শিথিল
মাসিক সঞ্চয় হিসাব খোলা যাচ্ছে বিকাশ অ্যাপে
ফের এবিবির চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন
অফিসার পদে ৭৮৭ জনকে নিয়োগ দেবে সরকারি ৫ ব্যাংক
ন্যাশনাল ব্যাংকের নতুন পরিচালক হলেন যারা