মূল্যস্ফীতি ঠেকাতে নতুন মুদ্রানীতি, ঘোষণা শিগগিরই

মূল্যস্ফীতি ঠেকাতে নতুন মুদ্রানীতি, ঘোষণা শিগগিরই
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাধিকার দিয়ে ইতোমধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একাধিকবার নীতি সুদহার বৃদ্ধিও করা হয়। কিন্তু এতেও নিত্যপণ্যসহ জিনিসপত্রের লাগাতার মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করার কথা ভাবছে বলে জানা গেছে। আগামী ১৫ জানুয়ারি এই মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হতে পারে।

জানা গেছে, কাল সাবেক গভর্নর ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে রাজধানীর একটি হোটেলে এই মুদ্রানীতির বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সর্বশেষ বৈঠক করবে। ওই বৈঠকের পর চূড়ান্ত হবে নতুন মুদ্রানীতি। মুদ্রানীতি বিষয়ক যে খসড়া বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যেই প্রস্তুত করেছে, তা উপস্থাপন করা হবে ওই সভায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, কোন পদ্ধতিতে বা কী করণীয় নির্ধারণ করলে জিনিসপত্রের দাম কমে আসবে, আসন্ন মুদ্রানীতিতে এই বিষয়টিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বৈদেশিক মুদ্রাকে স্থিতিশীল করতে বিশেষ গুরুত্ব থাকবে নতুন মুদ্রানীতিতে।

জানা গেছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের অবশিষ্ট ছয় মাসের জন্য নতুন মুদ্রানীতি আগামী ১৫ জানুয়ারি ঘোষণা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে উৎপাদন খাতে তারল্য সাপ্লাই বৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রার রেটকে স্থিতিশীল করতে এক্সপোর্ট প্রসিড ও রেমিট্যান্স রেট সমন্বয়ের জন্য মুদ্রানীতিতে বিশেষ গুরুত্ব দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, নতুন মুদ্রানীতি নিয়ে গত ১ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্বিতীয় সমন্বয় সভা করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব নির্বাহী পরিচালক ও ডেপুটি গভর্নররা ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভায় কয়েকজন নির্বাহী পরিচালক মূল্যস্ফীতি কমাতে রেপো ও ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। এর আগে ৫ ডিসেম্বর দেশের কয়েকজন অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে এ বিষয়ে বৈঠক করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা।

করোনা মহামারির আগে ছয় মাসের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হতো। কোভিডের কারণে ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরের মুদ্রানীতি এক বছরের জন্য ঘোষণা করা হয়েছিল।

তবে এবার আগের মতো বছরে দুইবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করার পরামর্শ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধি দল। বাংলাদেশ ব্যাংকও তাতে সম্মতি দিয়ে ছয় মাসের মুদ্রানীতি ঘোষণার কথা বলেছিল। এর আলোকে আগামী জানুয়ারি-জুন মাস পর্যন্ত নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা হবে। সাধারণত, মুদ্রার গতিবিধি প্রক্ষেপণ করে এই মুদ্রানীতি। মুদ্রানীতির অন্যতম কাজ হচ্ছে- মুদ্রাস্ফীতি-মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করা, ঋণের প্রক্ষেপণের মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি ঋণের জোগান ধার্য করা এবং মুদ্রার প্রচলন নিয়ন্ত্রণ করা।

অন্যদিকে, নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই অন্তত তিনবার নীতি-সুদহার বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বরে রেপো সুদহার ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে। ফলে রেপো সুদহার বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যতম লক্ষ্য। এ জন্য রেপো সুদহার বাড়ানো হয়েছে।’

মূলত, ঋণের প্রাপ্যতা, মুদ্রাস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বল্প মেয়াদে ব্যাংকগুলোকে অর্থ ধার দেয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ পতনের পরে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সত্ত্বেও, বিশ্বব্যাপী চাহিদা এবং সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা এখনও বিদ্যমান। কারণ, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরবরাহ চেইন সমস্যা আরও খারাপ হয়েছে। ফলে ২০২১ সালের শুরু থেকে বিশ্ববাজারে বেশিরভাগ পণ্যের দাম বেড়েছে। বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতিগত সুদের হার বাড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকও একই পথে হাঁটছে।

সাধারণত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিভিন্ন ব্যাংক যে টাকা ধার নেয়, তাই রেপো নামে পরিচিত। এই রেপো সুদহার বাড়ানোর ফলে ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে বেশি সুদ গুনতে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে মূলত টাকার প্রবাহ কমাতে। যাতে ব্যাংকগুলো বেশি সুদের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কম টাকা ধার করে, এটাই এ সিদ্ধান্তের মূল কারণ।

তবে ব্যাংকগুলো ৯ শতাংশ সুদে যে ঋণ দিচ্ছে, সেটির বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে ব্যাংকগুলো বেশি সুদে টাকা ধার করলেও ঋণের সুদ বাড়াতে পারবে না। ফলে ব্যাংক টাকা ধার নেওয়া কমাবে, ঋণও কম দেবে। এ কারণে এ সিদ্ধান্ত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে গত বছরের ২৯ জুন রেপো সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। আর ২৯ মে বাড়ানো হয়েছিল ৫০ বেসিস পয়েন্ট। রেপো সুদহার বাড়লেও রিভার্স রেপোর সুদহার ৪ শতাংশ অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। রিভার্স রেপো হলো ব্যাংকের কাছ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা তুলে নেওয়ার সুদহার।

এদিকে গত ২০ ডিসেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল হয়েছে। সেখানে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি ৫.৬% থেকে বাড়িয়ে ৭.৫% নির্ধারণ করেছে। একইসঙ্গে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে ৭.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬.৫% করা হয়েছে। নতুন মুদ্রানীতিতে বিষয়টি তুলে ধরা হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় ঋণের প্রবৃদ্ধির তুলনায় আমানতের প্রবৃদ্ধি অনেক কমে গেছে।

গত বছরের অক্টোবরে ব্যাংকে আমানত বেড়েছে ৭.৩৫। যদিও একইসময়ে ব্যাংক ঋণ বেড়েছে ১৪%।

ফলে দেশের ব্যাংকগুলোতে ব্যাপক তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্য মাত্র তিন মাসে ৩৩,০০০ কোটি টাকা কমে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ১.৭০ লাখ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।

অর্থসংবাদ/এসএম

আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন

নতুন সুদহার নির্ধারণ করল বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাগেজ রুলের অপব্যবহারে ধ্বংস হচ্ছে জুয়েলারি শিল্প
বছর ঘুরলেও প্রবাসী আয়ে গতি ফিরেনি
বাংলাদেশি টাকায় আজকের মুদ্রা বিনিময় হার
গ্রাহক সংখ্যায় দেশসেরা প্রতিষ্ঠান নগদ
বছরজুড়ে আলোচনায় খেলাপি ঋণ, সুদহার ও বিনিময়হার
প্রথম দিনেই ২ লাখের বেশি পণ্যের অর্ডার পেলো ইভ্যালি
তিন মাসের মধ্যে সব দেনা পরিশোধ শুরু করবো
পোশাকশিল্পকে রাজনৈতিক হাতিয়ার না বানানোর অনুরোধ
এক মাসের ব্যবধানে আলুর দাম বেড়েছে ৪৪ শতাংশ