খাবার স্যালাইনের মতো আইসিডিডিআরবি’র আরেকটি যুগান্তকারী উদ্ভাবন

খাবার স্যালাইনের মতো আইসিডিডিআরবি’র আরেকটি যুগান্তকারী উদ্ভাবন
পুষ্টিহীনতার শিকার অথবা স্বাভাবিক এবং পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর পরও যদি অপুষ্টিতে ভোগে, তাহলে তার জন্য সুসংবাদ এসে গেছে। রাজধানীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) একদল বিজ্ঞানী বলেছেন, পেটে উপকারী মাইক্রোবায়োটা বা ব্যাকটেরিয়ার অপরিপক্কতার কারণে এই সমস্যা হয়ে থাকে। আর কলা, সয়া, চাইনিজ বাদাম এবং ছোলা দিয়ে অল্প খরচের সহজলভ্য একটি খাদ্য পরিপূরক শিশুদের খাওয়ালে এই অপুষ্টিজনিত সমস্যা কাটতে পারে।

তারা বলছেন, বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ জীবন বাঁচানো খাবার স্যালাইনের মতোই এই খাদ্য পরিপূরকটিও ঘরে বসেই তৈরি করা যাবে।

এক দশকের দীর্ঘ গবেষণা এবং ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন যে, শিশুদের নির্দিষ্ট কিছু সহজলভ্য খাবারের বিশেষ মিশ্রণ খাওয়ালে সেই অপরিণত ব্যাকটেরিয়া পরিণত হয়। আর সেগুলো শিশুদের শারীরবৃত্তীয় কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক রাখতে ও ঘাটতি পূরণে সাহায্য করে। ফলে শিশুদের অপুষ্টি দূর হয়।

এভাবে শিশুদের ঠিক মতো বেড়ে না ওঠা, মস্তিষ্কের বিকাশ না হওয়া, উচ্চতা অনুযায়ী যথাযথ ওজন না হওয়ার মত সমস্যা কটিয়ে উঠতে পারে বলে তারা জানিয়েছেন।

অপরিণত ব্যাকটেরিয়াই যে অপুষ্টিজনিত সমস্যার জন্য দায়ী- এটি একটি নতুন উদ্ভাবন, যেটা ভবিষ্যতে প্রচলিত অপুষ্টি দূর করার কার্যক্রমগুলোকে আমূল বদলে দিতে পারে।

এই উদ্ভাবনটি আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্স (এএএএস) জার্নালের ‘ব্রেকথ্রু অফ দ্য ইয়ার-২০১৯’ পুরস্কার অর্জন করেছে। গত বছর দশটি উল্লেখযোগ্য বৈজ্ঞানিক গবেষণার মধ্যে এই উদ্ভাবনটিও ছিলো।

আইসিডিডিআর,বির পুষ্টি ও ক্লিনিকাল সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ এই গবেষক দলের প্রধান অনুসন্ধানকারী। এই দলে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত গবেষক অধ্যাপক জেফরি গর্ডনও রয়েছেন।

ড. তাহমিদ আহমেদ বলেন, খাবারের এই বিশেষ মিশ্রণের প্রয়োগ স্বল্প পরিসরের পরীক্ষায় ভালো ফল দিয়েছে। আইসিডিডিআরবি’তে এখন বড় পরিসরে ক্লিনিকাল পরীক্ষা চলছে।

আইসিডিডিআরবি’র ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছেন। এর মধ্যে তীব্র অপুষ্টির শিকার সারে চার লাখ শিশু এবং প্রায় দুই কোটি শিশু মাঝারি মাত্রার অপুষ্টির শিকার।

নারীদের মধ্যে প্রায় এক চতুর্থাংশের ওজন কম হয় এবং প্রায় ১৫ শতাংশের উচ্চতা কম হয়। যা প্রসবকালীন ঝুঁকি এবং কম ওজনের শিশু জন্ম দেওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

ওয়েবসাইটটিতে আরও বলা হয়েছে, অপুষ্টির কারণে বাংলাদেশের বার্ষিক আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় একশ কোটি ডলার। সারা বিশ্বে প্রায় দুইশ কোটিরও বেশি মানুষ অপুষ্টিতে ভোগেন।

কীভাবে কাজ শুরু হয়েছে তা জানতে চাইলে ড. তাহমিদ বলেন, “আমরা এই ধারণা নিয়ে গবেষণা শুরু করেছি যে, যদি বিশেষ মাইক্রোবায়োটা স্থূলতার জন্য দায়ী হয়, তাহলে চিকন স্বাস্থ্যের জন্যও নির্দিষ্ট মাইক্রোবায়োটা দায়ী থাকতে পারে।

এই ধারণা থেকে আইসিডিডিআরবি দুটি জায়গা থেকে শিশুদের অন্ত্রের মাইক্রোবায়োটা সংগ্রহ করে এবং বিশ্লেষণ করে। তারা মিরপুরের বস্তিতে সু-স্বাস্থ্যের অধিকারী শিশু এবং আইসিডিডিআর,বিতে ভর্তি হওয়া অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুদের থেকে এই নমুনা সংগ্রহ করেন।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, অপুষ্টির শিকার শিশুদের পেটের মাইক্রোবায়োটা অপরিণত এবং কম বৈচিত্র্যপূর্ণ।

ড. তাহমিদ জানান, তারা ১২ থেকে ১৮ মাসের শিশুদের বেছে নেন এই পরীক্ষার জন্য। কারণ, এই বয়সের শিশুরা সবচেয়ে বেশি অপুষ্টিজনিত ঝুঁকিতে থাকে। তবে গবেষণার ফলাফল সব বয়সের শিশুদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

দলটি বাচ্চাদের পেটে মোট ১৫ ধরণের উপকারী ব্যাকটেরিয়া চিহ্নিত করে। এছাড়া প্রোটিনসহ রক্তের আরও কিছু নির্দেশকের গুণাগুণ পরীক্ষা করে- যেগুলো অপুষ্টির প্রভাব কেটেছে কী না, তা নির্দেশ করে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সহজেই পাওয়া যায় এমন খাদ্যে ব্যাকটেরিয়াগুলো কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, তা দেখতে তারা বিভিন্ন প্রাণীর উপর পরীক্ষা করেন। পরীক্ষাগুলি প্রথমে ইঁদুর, পরে শূকর এবং সবশেষে অপুষ্ট শিশুদের একটি ছোট গ্রুপের ওপর করা হয়।

এতে দেখা যায়, দুধের গুঁড়া এবং ভাত মেশানো পরিপূরক খাবারগুলোর চাইতে ছোলা, কলা, সয়া এবং চিনাবাদামের গুঁড়ার তৈরি খাবারের মিশ্রণ ব্যাকটেরিয়াগুলোকে পরিণত হতে বেশি সাহায্য করছে।

ড. তাহমিদ বলেন, প্রায় আট বছর ধরে আমরা এই খাদ্য পরিপূরক ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পরীক্ষাগারে প্রাণীর ওপর প্রয়োগ করেছি। আমরা প্রচলিত পরিপূরক খাবারের (গুঁড়া দুধ বা অন্যান্য) কার্যকারিতা নাকচ করছি না। আমাদের পরীক্ষা প্রমাণ করেছে যে, নির্দিষ্ট বিশেষ ধরণের খাবারের সংমিশ্রণ আরও বেশি কার্যকর।”

ক্লিনিকাল পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে এই পরিপূরক প্রাপ্ত শিশুদের রক্তের প্রোটিন এবং বিপাকের পরিমাণও বাড়ায়।

বর্তমানে বড় পরিসরে ১২৮ জন শিশুর ওপর এই উদ্ভাবনটি প্রয়োগ করা হচ্ছে ঢাকার আইসিডিডিআর,বি-তে। যেটা আরও এক থেকে দেড় বছর চলবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এরপর এটি সাধারণ মানুষের মাঝে চালু করা হবে।

ড. তাহমিদ বলেন, আমরা আশা করি অদূর ভবিষ্যতে অপুষ্টির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সবার কাছে এই হাতিয়ার তুলে দেওয়া সম্ভব হবে। যেমনটি হয়েছিলো খাবার স্যালাইনের ক্ষেত্রে।

আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন

পা-বিহীন টিকটিকিসহ শতাধিক নতুন প্রজাতির আবিষ্কারের বছর ২০২৩
গলাব্যথা সারাতে কেন লবণ-পানি পান করবেন
থার্টিফার্স্টে মেট্রোরেলের আশপাশে ফানুস না ওড়ানোর অনুরোধ
মাশরাফির দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড ভাঙলেন সোহান
ঢাবির অধীনে এডুকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে ভর্তির সুযোগ
আজ পীরগঞ্জ যাচ্ছেন শেখ হাসিনা
প্রকৃতি ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে পরিবেশবান্ধব বাংলাদেশ গড়তে হবে
দুই বাংলাদেশির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করলো সৌদি
প্রথম দিনেই ‘সালার’ আয় ১৭৫ কোটি
টানা তিন বছর মুনাফা না থাকলে ব্যাংকাস্যুরেন্স সেবা নয়