শেয়ারবাজারের সংকট উত্তরণের উপায়

শেয়ারবাজারের সংকট উত্তরণের উপায়
অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ পুঁজিবাজার। একটি দেশের শিল্পায়ন ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পুঁজি সরবরাহের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা বজায় রাখতে শক্তিশালী পুঁজিবাজারের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কোনো দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন ব্যাপক বিনিয়োগ। জনগণের ক্ষুদ্র সঞ্চয়গুলো একীভূত করে দেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি সম্ভব। বিনিয়োগের আরেকটি উপায় হচ্ছে বৈদেশিক বিনিয়োগ, দেশের ভেতর বিনিয়োগ সক্রিয় থাকলে বিদেশি বিনিয়োগ সহজে আকৃষ্ট হয়। বিনিয়োগের দুটি ক্ষেত্রেই পুঁজিবাজার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। পুঁজিবাজারকে আমাদের দেশে শেয়ারবাজার বলা হয়। বড় বড় কোম্পানি যেমন তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য মালিকানার কিছু অংশ বিক্রি করে পুঁজিবাজার থেকে পুঁজি সংগ্রহ করে, পরবর্তী সময়ে কোম্পানি সঠিক পরিচালনার মাধ্যমে উপার্জিত আয় লভ্যাংশ আকারে সাধারণ জনগণ পেয়ে থাকে। এভাবেই সাধারণ জনগণ তাদের জমানো অলস অর্থ দিয়ে পুঁজিবাজারের মাধ্যমে তাদের পছন্দমতো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে নিজের ও দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।

সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি হচ্ছে যে ২০১০ এর পর থেকে শেয়ারবাজারে যে ধস নেমেছে তার উত্তরণের কোনো চেষ্টাই গত ১০ বছরে করা হয়নি। গত ১০ বছরে বেশ কিছু পদক্ষেপ বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন নিয়ে থাকলেও তার কার্যকারিতা না দেখার কারণে, আমরা এই পুঁজিবাজারকে একটি শক্তিশালী অবস্থানে দেখতে পাইনি। ২০১০ এর মার্কেট কেন ফুলে-ফেঁপে দশগুণ হয়েছিল সেটা আমরা সবাই জানি। তার একটি মাত্র মূল কারণ ছিল অতিরিক্ত মার্জিন লোন সুবিধা। যার কারণে মার্কেট বাবল আপ হয় এবং পরবর্তীতে মার্জিন লোনের রাশ টেনে ধরার কারনে মার্কেটে ধস নামে। এইটি ছিল একমাত্র কারণ, তার সাথে আরো অনেকগুলো কারণ ছিল তবে আমরা মনে করি এই অতিরিক্ত সুবিধার রাশ টেনে ধরার কারণে মার্কেটের পতন ত্বরান্বিত হয়।

২০১০ এর পরবর্তীতে গত ১০ বছরে সেই মার্কেট আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি। কারণ নিয়ন্ত্রণ সংস্থার সঠিক কোন পদক্ষেপ ছিল না। বর্তমান ২০২০ সালে আমরা দেখতে পাচ্ছি ২০১০ এর মার্কেট এর ঠিক বিপরীত চিত্র। বর্তমানে পুঁজিবাজারের যে সংকট তা তারল্য সংকট কে নির্দেশ করে। ২০১০ সালে যেখানে আমরা দেখেছিলাম অতিরিক্ত মার্জিন লোন সুবিধার কারণে অর্থাৎ অতিরিক্ত তারল্য, বর্তমানে ঠিক তার বিপরীত চিত্র মার্কেটে তারল্য সংকট। মার্কেটে তারল্য সংকট সৃষ্টি হওয়ার পিছনে একমাত্র কারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাব আর কিছু না। এখন অনেকেই হয়তো বলতে পারেন এই বিনিয়োগকারীদের আস্থার সঙ্কট দূর করার জন্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা কি করবেন? নাকি বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে তারল্য প্রবাহ বাড়াবেন। নাকি ইনস্টিটিউশনাল ইনভেসমেন্ট এর মাধ্যমে মার্কেট এর তারল্য সংকটের উত্তরণ ঘটবেন। এর কোনটাই করার দরকার নেই যদি আমরা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে পারে।

এখন কথা হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাব কেন সৃষ্টি হলো? আস্থার অভাব একদিনে সৃষ্টি হয়নি গত ১০ বছরে বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাব একটু একটু করে হয়েছে তার কারণ বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের নেয়া কিছু ভুল সিদ্ধান্ত। যদিও এগুলো কে ভুল সিদ্ধান্ত বলা যায়না সিদ্ধান্তগুলো ছিল বিনিয়োগকারীদের জন্যেই কিন্তু এগুলোর কার্যকারিতা না থাকার কারণে এগুলো বুমেরাং হয়ে যায়। আমরা উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি হয়তো দেখিয়ে দিতে পারব কিন্তু তাতে কোন সমাধান হবে না।

এখন ২০২০ সালের শেয়ার বাজার কে যদি সংকট থেকে আমরা উত্তরণ ঘটাতে চাই তাহলে আমাদের দ্রুত কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যার মধ্য দিয়ে আমরা বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে পারবে এবং মার্কেট কে একটি সঠিক জায়গায় নিয়ে যেতে পারবো।

লিস্টেড কোম্পানি:
প্রথমত আমি মার্কেটে যে সমস্ত লিস্টেড কোম্পানি আছে তাদের ব্যাপারে কিছু বলতে চাই সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন কর্তৃক তাদের জন্য একটা ভালো নিয়ম দেয়া আছে, যে তাদের মোট শেয়ারের 30% ডিরেক্টরস শেয়ার থাকতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে বেশিরভাগ লিস্টেড কোম্পানি সেই নিয়মটা মানছেন না। সেই নিয়ম মানার জন্য তাদেরকে বাধ্য করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের কর্পোরেট টেক্স বেনিফিট বাদ দিতে হবে।

দ্বিতীয়তঃ আরেকটা নিয়ম আছে প্রত্যেক ডিরেক্টর কে মিনিমাম ২ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে হবে কাগজে পত্রে তারা ২ শতাংশ শেয়ার ধারণ করলেও সেই শেয়ারের বিপরীতে শেয়ার লিয়েন করে তারা বিভিন্ন ব্যাংক বা ফাইনান্সিয়াল কোম্পানি থেকে লোন নিয়ে পুঁজিবাজার কে তারল্য সংকটে ফেলছে। অতএব লিয়েন শেয়ার বা ব্লক শেয়ারকে ২ শতাংশ শেয়ার এর ক্যালকুলেশন থেকে বাদ দিতে হবে।

তৃতীয়তঃ গত ১০ বছরে প্রচুর বাজে কোম্পানিকে আইপিও র মাধ্যমে শেয়ারবাজারে অন্তর্ভুক্ত হতে দেখেছি। আমাদের এতে বিন্দুমাত্র আপত্তি থাকত না যদি এই মার্কেটে বাই ব্যাক পলিসি থাকতো। আমরা বারবার বলেছি আইপিওতে যে কোন কোম্পানি আসতে পারে কোন সমস্যা নেই কিন্তু বাই ব্যাক পলিসি থাকলে ফেসভ্যালুর নিচে যদি শেয়ার মূল্য আসে তবে সে কোম্পানিকে তাদের শেয়ার কিনে নিতে হবে। যদি বাই ব্যাক পলিসি থাকতো তাহলে বাজে কোম্পানিগুলো আইপিওর মাধ্যমে শেয়ার মার্কেটে আসার সাহস করত না। শুধু তাই নয় দশ টাকার শেয়ার বিডিং করে আশি টাকা করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদেরকে খাওয়ানোর মতো দুঃসাহস দেখাতো না। অতএব আইপিও র মাধ্যমে বাজে কম্পানি মার্কেটে আসতে চাইলে আমাদের কোন আপত্তি নাই কিন্তু বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন কে বলব দয়া করে যত দ্রুত সম্ভব পারা যায় বাই ব্যাক পলিসি প্রবর্তন করুন। এতে করে বাজে কোম্পানিগুলোর শেয়ার মার্কেটে আসা অটোমেটিক ভাবে বন্ধ হয়ে যাবে।

মিউচুয়াল ফান্ড:
বাংলাদেশের মিউচুয়াল ফান্ড কে ধ্বংস করার জন্য যে দুটো নিয়ম করা হয়েছে তাই যথেষ্ট। একটি নিয়ম হচ্ছে ক্যাশ ডিভিডেন্ড এর বদলে ROI যার ফলশ্রুতিতে মিউচুয়াল ফান্ডে ইনস্টিটিউশনাল ইনভেস্টমেন্ট পুরোপুরি এখন বন্ধ। দ্বিতীয়ত অন্য আরেকটি নিয়ম করা হয়েছে Close End মিউচুয়াল ফান্ডের মেয়াদ যা আগে ছিল ১০ বছর সেটিকে বাড়িয়ে এখন ২০ বছর করা হয়েছে। এই দুইটি নিয়ম কাদের স্বার্থে করা হয়েছে আমরা জানিনা কিন্তু মিউচুয়াল ফান্ডকে মোটামুটি ভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। ইনস্টিটিউশনাল ইনভেস্টর রা মিউচুয়াল ফান্ডে ইনভেস্ট করত কারণ তারা দশ বছর পরে নেট অ্যাসেট ভ্যালু তে একটি ইনভেস্টমেন্ট রিটার্ন পাবে এই আশায়। এবং সেই সাথে প্রতি বছর তারা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্যাশ ডিভিডেন্ট পাবে। কিন্তু মিউচুয়াল ফান্ডের এই দুইটি নিয়মের ফলে তাদের ইনভেস্টমেন্ট থেমে গেছে। যে কারণে আজকে মিউচুয়াল ফান্ডের এই করুন দশা।

মার্জিন লোন:
শেয়ারবাজারের আরেকটি বিষফোঁড়া হচ্ছে ২০১০ এর দেয়া অধিক মার্জিন লোন। যে মার্জিন লোন বর্তমানে নেগেটিভ ইকুইটি নামে পরিচিত। গত ১০ বছরে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো এই নেগেটিভ ইকুইটির হাত থেকে পরিত্রান পায়নি। কারণ মার্জিন রুল এর যথাযথ প্রয়োগের অভাব এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের এই ব্যাপারে পরিষ্কার কোন ধারণা না দেয়ার জন্য। মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো বারবার বলে আসছে একটা পরিষ্কার নির্দেশনা দেয়ার জন্য। কিন্তু বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এখনো পর্যন্ত সেইরকম কোন গাইডলাইন বা নির্দেশনা দেয়নি যে কারণে এই বিষফোঁড়া এখনও শেয়ার মার্কেটের উপর চেপে আছে। এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হচ্ছে force sell এবং এই ব্যাপারে পরিষ্কার একটা নির্দেশনা ,যা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন থেকে দিতে হবে। এতে মার্কেটের আর কোন ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। মার্কেট এখন তলানিতে চলছে। দ্বিতীয়তঃ আরেকটা কাজ করা যায় যদি কেউ মনে করেন এতে করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি হবে তবে ইকুইটি নেগেটিভ এ যে শেয়ার গুলো আছে সেগুলো লিয়েন করে আইসিবি টোটাল funding করতে পারে নো ইন্টারেস্ট রেট এ যাতে করে মার্কেট থেকে মার্জিন লোনের এ বিষফোঁড়া চলে যায়।

ট্যাক্স:
শেয়ার মার্কেটের জন্য ট্যাক্স একটি বিশাল বিষয়। আমরা বারবার বলে আসছি শেয়ার মার্কেটে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ট্যাক্স সুবিধা দিতে হলে তাদের ডিভিডেন্ডের উপর ট্যাক্স কমাতে হবে। মিনিমাম ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ডিভিডেন্ট এর উপর ইনকাম ট্যাক্স ফ্রী করা যায় কিনা দেখা যেতে পারে। যে সমস্ত লিস্টেড কোম্পানি শেয়ার বাজারে আসছে তাদেরকে উৎসাহিত করার জন্য কর্পোরেট ট্যাক্স এর ডিফারেন্স ১০ পার্সেন্ট করতে হবে। এতে করে প্রচুর কম্পানি উৎসাহিত হয়ে এ মার্কেট এ আসবে। শেয়ারবাজারে ব্ল্যাকমানি যদি আসে তাহলে শেয়ার মার্কেটের তারল্য সংকট অনেকখানি কেটে যাবে তবে সেক্ষেত্রে ব্ল্যাকমানি আসার জন্য কোন রকম শর্ত দেয়া যাবে না। এবং তার উপর কোন ট্যাক্স ধার্য করা যাবে না।

উপরোক্ত সমস্যা গুলোর যদি সমাধান করা যায়, আমরা আশা করতে পারি মার্কেট ঘুরে দাঁড়াবে।মার্কেটের তারল্য সংকট কেটে যাবে। এবং সেই সাথে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসবে।

আহমেদ শামীম
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক

আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন

ফু-ওয়াং সিরামিকের লভ্যাংশ অনুমোদন
এক বছরে ডিএসইর বাজার মূলধন বেড়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা
ডিএসইতে মোবাইল গ্রাহক-লেনদেন দুটোই কমেছে
বছরজুড়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির অনুমোদন পেয়েছে ৯ কোম্পানি
পুঁজিবাজারে লেনদেন বন্ধ আজ
বছরের ব্যবধানে পুঁজিবাজারে লেনদেন বেড়েছে ৪০ শতাংশ
রবিবার পুঁজিবাজার বন্ধ থাকলেও চলবে দাপ্তরিক কার্যক্রম
লোকসানে ৮ খাতের বিনিয়োগকারীরা
সাপ্তাহিক রিটার্নে মুনাফায় ১০ খাতের বিনিয়োগকারীরা
খাতভিত্তিক লেনদেনের শীর্ষে প্রকৌশল খাত