গণমুখী বাজেট ও ব্যাংক খাতের উন্নয়ন

গণমুখী বাজেট ও ব্যাংক খাতের উন্নয়ন
একটি সুষম বাজেট প্রণয়নের মাধ্যমে দেশের পুরো বছরের সামগ্রিক আয় ব্যয়ের হিসাব ও পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়। বার্ষিক এই পরিকল্পনার আলোকে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। বাজেটের একটি বড় অংশ ব্যাংক খাতের মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করা হয়। দেশের রাজস্ব আয়ের বড় অংশ ব্যাংকের বিভিন্ন কর ও শুল্ক থেকে আসে। এছাড়া আমদানি - রপ্তানী বাণিজ্য, বৈদেশিক রেমিট্যান্স আহরণ, শিল্পদ্যোক্তা তৈরি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কৃষকদের মাঝে স্বল্প মুনাফায় ঋণ বিতরণ, সরকারঘোষিত প্রণোদনা বিতরণ, দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও পণ্য সরবারহসহ সার্বিক আর্থিক কার্যক্রমে সরকার ও জনগণকে সহায়তার মাধ্যমে ব্যাংকগুলো বাজেট বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

করোনা মহামারির দুর্দিনে ব্যাংকগুলো সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কাজ করেছে অবিরত। সমুখ সারিতে থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্যাংকাররা জনগণের সেবা দিয়েছে। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ব্যাংকগুলোর অবদান অপরিসীম। করোনা মহামারির অভিঘাতের সাথে সাথে ব্যাংকগুলোর উপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেধে দেয়া মুনাফার নতুন হার বাস্তবায়নও বড় একটি চ্যালেঞ্জ ছিল। মুনাফার এই ৯-৬ হার বাস্তবায়নের ফলে বিগত দুই বছরে ব্যাংকগুলোর বছর শেষে মুনাফার উপর বড় রকমের প্রভাব পড়ে। এতসব ত্যাগ তিতীক্ষা সত্ত্বেও ব্যাংকগুলো আইনি জটিলতা ও সহযোগিতার অভাবে ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে।

খেলাপি ঋণের বোঝায় জর্জরিত ব্যাংকিং খাত। ২০২১ সালের শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ যেখানে এক লক্ষ ৩ হাজার কোটি টাকা ছিল দুই থেকে তিন মাসের ব্যবধানে সেটা দাঁড়িয়েছে এক লক্ষ ১৩ হাজার কোটি টাকায়। খেলাপী বিনিয়োগ গ্রহীতাদের বেশিরভাগই বড় বড় প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপী। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা জরুরি।

সম্প্রতি প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর অ্যান্ড সিইও মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বলেন, “খেলাপি ঋণ দেশের ব্যাংক খাতের সমৃদ্ধির প্রতিবন্ধক। আর ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা ব্যাংক খাতের সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্তরায়।” তিনি বলেন, “বাজেটে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপীদের বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা প্রত্যাশা করছি।” (বণিক বার্তা, ৩১ মে ২০২২)।

ঋণখেলাপিদের কারণে ব্যাংকগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কমে যাচ্ছে মুনাফা। বড় অংকের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকারও। ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা জনগণের সম্পদ। ব্যাংকের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সাথে জনগণও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশের উন্নয়নে বাজেট প্রণয়নে তাই খেলাপি ঋণ কমানো সহ ঋণখেলাপীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তথা ডলার সংকট বর্তমানে দেশের অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। রপ্তানি বাণিজ্য এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এই রিজার্ভের প্রধান উৎস। ব্যাংকগুলোতে ডলারের মূল্য প্রত্যাশিত না হওয়ায় প্রবাসীরা অবৈধপথে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠানো বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈদেশিক রেমিট্যান্স অনেক কমেছে বিগত মে মাসে। এছাড়া রপ্তানীকারকরাও ডলারের ভাল দাম না পাওয়া এবং কাঙ্খিত পরিমাণে প্রণোদনা না পাওয়ায় রপ্তানিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বৈধ পথে রেমিট্যান্স আনা এবং রপ্তানী খাতে সরকারি সহযোগিতার পরিমাণ বাড়ালে এই সংকট অনেকটা সমাধান হবে।

ব্যাংকে টাকা জমা ও বিনিয়োগ গ্রহণের ক্ষেত্রে গ্রাহককে ভ্যাট দিতে হয়। ভ্যাট ও ট্যাক্সের কারণে অনেক গ্রাহক টাকা জমা রাখতে নিরুৎসাহিত হন। বিনিয়োগ গ্রাহকগণও একইভাবে বিরক্ত হন। ভ্যাট, ট্যাক্স ও আবগারি শুল্কের চাপে গ্রাহকরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন সেজন্য বাজেট প্রণয়নকালে এ বিষয়টি সহজ করার কথা ভাবতে হবে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ড এতে আরো বেগবান হবে।

বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে ও দেশের রিজার্ভে স্বস্তি ফিরাতে বাজেটে বিলাস দ্রব্য আমদানি নিরুৎসাহিত করার আগাম খবর সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।

সামগ্রিক হিসাবে দেশের মাথাপিছু আয় বাড়লেও ব্যক্তি পর্যায়ে মানুষের আয় সমানভাবে বাড়েনি। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে বেড়েছে সংসার পরিচালনার ব্যায়। ব্যক্তি পর্যায়ের করদাতারা তাই অনেকটা চাপের মধ্যে রয়েছেন। ব্যক্তি পর্যায়ের করের সীমা বাড়ালে সাধারণ করদাতাদের মধ্যে অনেকটা স্বস্তি ফিরবে। অনেক করদাতা রয়েছেন যারা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে কাজ করার কারণে কর দিতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু প্রকৃত কর দেয়ার উপযুক্ত অনেকেই রয়েছেন করজালের বাইরে। তাদের কর নেটওয়ার্কে নিয়ে আসলে দেশের রাজস্ব আয় আরো বেড়ে যাবে। কর প্রদানের পদ্ধতি সহজকরণ, ভীতি দূর করা ও করের হার কমানোর মাধ্যমে এসব করদাতাদের উৎসাহ প্রদানের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে দেশে খাদ্য আমদানীতে ব্যায় বেড়েছে। ফলে খাদ্য দ্রব্যের দাম বেড়েছে কয়েক দফায়। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের আভাস দিচ্ছে। আমাদের বাংলাদেশে খাদ্য শস্য উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত উর্বর ভূমি রয়েছে। আবাদযোগ্য জমিতে খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে ঘনায়মান সংকট মোকাবেলা সহজ হবে। প্রান্তিক পর্যায়ের অনেক চাষী রয়েছে যাদের ভূমি থাকলেও প্রয়োজনীয় পরামর্শ, সার, বীজ ও সেচ সংকটের কারণে ফসল উৎপাদন করতে পারছেন না। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষি খাতে প্রণোদনা বিনিয়োগ বিতরণ করায় ব্যাংকগুলোকে স্বীকৃতি সনদ প্রদান করে। প্রকৃতপক্ষে দরিদ্র চাষীরা যেন সরকারি সহযোগিতা পেতে পারেন সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার।

সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পূরণে একটি গণমুখী বাজেট প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেয়াই সময়ের দাবি।

রিয়াজ উদ্দিন : লেখক ও ব্যাংকার

আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন

খেলাপির ফাঁদে ব্যাংক খাত: সমাধান কোন পথে
বাণিজ্যিক বিবেচনায়  ‘সৌরবিদ্যুৎ’ টেকসই এবং অনেক বেশি লাভজনক
কক্সবাজার: বাংলাদেশে অফুরন্ত পর্যটন সুযোগ উন্মোচন
বাংলাদেশে ঈদ উৎসব ও ব্যাংক ব্যবস্থাপনা
অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত করতে বন্ধ করতে হবে মানিলন্ডারিং
ওএসডি কোন নীতিমালার মধ্যে পড়ে
নেট দুনিয়ার ব্যাংকিং
সর্বজনীন কল্যাণে ইসলামী ব্যাংক: আন্তরিক সেবার ৪০ বছর
সুইডেনের ইনফ্লেশন ১২ শতাংশ, গোল ২ শতাংশ
ব্যাংকের নাম: লিমিটেড থেকে পিএলসি