তৈরি পোশাক খাতে অস্থিরতার আশঙ্কা

তৈরি পোশাক খাতে অস্থিরতার আশঙ্কা
করোনাভাইরাসের কারণে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই রেমিট্যান্স কমেছে, রপ্তানি আয়ও কমেছে। এই পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় খাত তৈরি পোশাকেও বড় ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ইতোমধ্যে পোশাকশ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ নিয়ে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। অনেক পোশাক কারখানা মার্চ মাসের বেতনই পরিশোধ করেনি। শ্রমিক নেতারা জানিয়েছেন, তিন শতাধিক কারখানার দুই লাখ পোশাকশ্রমিক এখনো মার্চের বেতন পাননি। বেতন পরিশোধ না করা এসব কারখানার মালিককে গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধেরও দাবি জানিয়েছে শ্রমিকরা।

সম্প্রতি গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন বলেন, গাজীপুর, আশুলিয়া, সাভার, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এবং চট্টগ্রামের তিন শতাধিক কারখানার মালিক এখন পর্যন্ত গত মার্চের বেতন-ভাতা পরিশোধ না করায় দুই লাখ পোশাকশ্রমিক না খেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বর্তমানে কোথাও কোনো ওভারটাইম হয় না।

ফলে শ্রমিকরা ওভারটাইম ভাতা পান না। নির্ধারিত মাসিক মজুরি দিয়ে চলা এমনিতেই কষ্টকর। তার ওপর মার্চ ও এপ্রিলের বেতন-ভাতা না পাওয়ায় তাঁরা চরম দুর্ভোগের মুখোমুখি। বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে প্রতিদিন বিভিন্ন স্থানে রাস্তা অবরোধসহ আন্দোলন বিক্ষোভে শামিল হচ্ছেন গার্মেন্ট শ্রমিকরা।

এদিকে দেশের অর্থনীতির এই গুরুত্বপূর্ন খাতকে সহযোগিতা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু জানা গেছে, এই অর্থ কোনো গার্মেন্ট মালিক বা শ্রমিক এখনও পাননি। ইতোমধ্যে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পার হয়েছে। তাই শ্রমিক-কর্মচারীদের সময়মতো বেতন-ভাতা দেয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন বেশির ভাগ শিল্প মালিক। এর মধ্যে বড় সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে সাব-কন্ট্রাক্টে থাকা প্রায় ৪ হাজার কারখানা।

এসব কারখানা বিজিএমইএ সদস্য নয়। ফলে ঋণ প্যাকেজ থেকে এখানে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পাওয়ার সুযোগ নেই। এই যখন অবস্থা তখন ঈদের আগে বেতন-ভাতার দাবিতে শ্রমিকদের চাপা ক্ষোভ ও অসন্তোষ বড় পরিসরে রাস্তায় গড়াতে পারে। এমন শঙ্কার বিষয়টি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গার্মেন্ট সেক্টরের ১০ জন নেতা শ্রমিকদের উসকে দিয়ে রাস্তায় নামানোর চেষ্টা করছেন।

শিল্প পুলিশের তথ্য মতে, দেশে মোট ৭ হাজার ৬০২টি পোশাক কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে বিজিএমইএ’র সদস্যভুক্ত কারখানার সংখ্যা ১ হাজার ৮৮২টি। যদিও বিজিএমইএ’র ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য মতে, সংগঠনটির সদস্য সংখ্যা ৪ হাজার ৩৭৬টি। তবে সংগঠনটি বলছে, এসবের মধ্যে সচল আছে ২ হাজার ২৭৪টি।

অন্যদিকে বিকেএমইএ সদস্যভুক্ত কারখানা রয়েছে এক হাজার ১০১টি, বিটিএমএ’র কারখানা ৩৮৯টি এবং বেপজার ভেতরে রয়েছে ৩৬৪টি। কিন্তু এর বাইরে আরও ৩ হাজার ৮৬৬টি কারখানা রয়েছে। এসব কারখানা সাধারণত বড় কারখানা থেকে অর্ডার নিয়ে সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করে। কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে বিদেশি ক্রেতা ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সাব-কন্ট্রাক্টিং অনুমোদন না করলেও গার্মেন্ট মালিকরা নিজেদের স্বার্থে সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করায়, যা নিয়মবহির্ভূত।

তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বুধবার পর্যন্ত বিজিএমইএ’র ১ হাজার ৮৮২টি কারখানার মধ্যে এক হাজার ২৩২টি কারখানা খুলেছে। কিন্তু সাব-কন্ট্রাক্ট বা বিজিএমইএ-বিকেএমইএ’র সদস্যবহির্ভূত ৩ হাজার ৮৬৬টি কারখানার মধ্যে খুলেছে মাত্র এক হাজার ২৮৭টি।

বাকি আড়াই হাজারের বেশি কারখানা বন্ধ আছে। অর্থাৎ অর্ডার না থাকায় এসব কারখানা খোলেনি মালিকরা, তাই শ্রমিকরাও বেকার বসে আছে। এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ’র জনসংযোগ কমিটির চেয়ারম্যান খান মনিরুল আলম জানান, শুধু সদস্যভুক্ত কারখানাগুলো নিয়ে বিজিএমইএ কাজ করে। এর বাইরে অন্য কারখানার সমস্যা দেখার দায়িত্ব বিজিএমইএ’র নয়।

বিকেএমইএ’র জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেছেন, আমলাতান্ত্রিক মারপ্যাঁচে পড়ে বিজিএমইএ-বিকেএমইএ’র অনেক সদস্যই তহবিল থেকে টাকা পাচ্ছে না। এই দুই সংগঠনের বাইরে যেসব কারখানা আছে তারা শ্রমিকদের নিয়ে বিপদে পড়বে, বেতন দিতে পারবে না। তখন শ্রমিকরা রাস্তায় নামলে সবাই বিজিএমইএ-বিকএমইএ-কে দোষারোপ করবে। তাই তাদের বিষয়টি বিবেচনা করতে সরকারের উচ্চ মহলে জানানো হয়েছে।

করোনার প্রভাব মোকাবেলায় সরকার রফতানিমুখী পোশাক খাতকে ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল দিয়েছে। এ তহবিল থেকে শুধু বিজেএমইএ এবং বিকেএমইএ-র সদস্যরা ঋণ পাবেন, যা দিয়ে শুধু কারখানার শ্রমিকদের বেতন দেয়া হবে। এর বাইরে টেক্সটাইল খাত ও প্রচ্ছন্ন রফতানিকারক এক্সেসরিজ শিল্পও ওই তহবিল থেকে টাকা পাবে না।

অর্থাৎ বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ-র বাইরে অন্য কারখানার শ্রমিকদের জন্য বেতন দেয়া হবে না। প্যাকেজ ঘোষণার সময় রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেয়ার কথা বলা হলেও পরবর্তী সময়ে দফায় দফায় নীতিমালা সংশোধন করে জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়।

জানা গেছে, করোনাভাইরাস সংকটে শ্রমিকদের বেতন দিতে সরকার যে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিল করেছে, সেখান থেকে ঋণ নিতে আবেদন করেছেন ২ হাজার ২০০ কারখানার মালিক। এর মধ্যে বিজিএমইএ সদস্যভুক্ত কারখানার সংখ্যা ১ হাজার ৬১৫টি; বিকেএমইএভুক্ত ৫৫০টি। বাকি ৩৫টি ইপিজেড এলাকায় অবস্থিত পোশাক কারখানা।

৪৬টি ব্যাংকের মাধ্যমে এই কারখানাগুলোর মালিকদের ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা ঋণ পেতে আবেদন জমা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। আবেদনের বিপরীতে ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর হিসাবে ২ হাজার কোটি টাকা বিতরণ করা হযেছে। এখন ব্যাংকগুলো এসব অর্থ শ্রমিক-কর্মচারীদের হিসাবে ছাড় করবে। কিন্তু সব শ্রমিকের অ্যাকাউন্ট না থাকা ও বিভিন্ন ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট থাকায় টাকা ছাড় করা নিয়ে বড় সংকট দেখা দিয়েছে।

তবে গার্মেন্টস মালিকদের অনেকে জানিয়েছেন, কোনো ঋণ এখন পর্যন্ত তারা পাননি। যেহেতু এটি ঋণ এবং দিতে হবে শিল্প মালিককে, তাই এই ঋণের অর্থ তো আগে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের হিসাবে ঢুকতে হবে। তারপর সরকার বা ব্যাংক তার গাইডলাইন অনুযায়ী বিলি-বণ্টন করবে। কিন্তু কোনো কিছুই এখনও দৃশ্যমান নয়। অর্থাৎ মাসের প্রথম সপ্তাহ শেষ। ১০ তারিখ পার হলে তো বেতন না পাওয়ার আন্দোলন রাস্তায় গড়াবে। তখন কী হবে জানি না।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, করোনার প্রাদুর্ভাবে দেশে লকডাউন চলাকালীন গার্মেন্ট শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ না করে কিছু মালিক উল্টো শ্রমিক ছাঁটাই করছেন, যা অনভিপ্রেত। উদাহরণস্বরূপ আশুলিয়ার ইউসুফ মার্কেটে অবস্থিত সিগমা ফ্যাশন লিমিটেড। এখানে মোট শ্রমিক সংখ্যা ১৪০০ জন। ২৫ এপ্রিল ওই কারখানার ৭০৯ জন শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়েছে।

এ নিয়ে কারখানার গেটের সামনে অবস্থান নিয়ে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেন। যদিও বিজিএমইএ, বিকেএমইএ প্রকাশ্যে বলেছে, তারা করোনা পরিস্থিতির মধ্যে কোনো শ্রমিক ছাঁটাই করবে না। শ্রমিক ছাঁটাইকে কেন্দ্র করে গার্মেন্ট সেক্টরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন গোয়েন্দারা।

আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন

পোশাকখাতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে, কমে গেছে চাহিদা
২০২৩ সালে স্বর্ণের দাম বেড়েছে ১৩ শতাংশ
২০২৩ সালে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে ১০ শতাংশ
ইভ্যালিতে বড় অফার আজ, ১০ টাকায় মিলবে পাঞ্জাবি
হিলিতে আদা-সবজিতে স্বস্তি, বাড়তি দামে রসুন
বাংলাদেশে বিনিয়োগের ঐক্যমতে শেষ হলো গ্লোবাল বিজনেস কনফারেন্স
১১ মাসে ৪৩ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি
২০২৪ সালে ৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর
আইসিএবির নতুন সভাপতি ফোরকান উদ্দীণ
বিসিক শিল্পনগরীতে এক হাজার ৯৮ প্লট খালি