ইসলামী ব্যাংকিং কেবল সুদমুক্ত লেনদেনেই সীমাবদ্ধ নয়

ইসলামী ব্যাংকিং কেবল সুদমুক্ত লেনদেনেই সীমাবদ্ধ নয়
চল্লিশ বছরে পা রেখেছে বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং। ১৯৮৩ সালের ৩০ মার্চ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এ দেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের যাত্রা শুরু হয়। চার দশকের পথ চলায় ইসলামী ব্যাংক দেশবাসীকে উপহার দিয়েছে এক ভিন্ন মাত্রার ব্যাংকিং সেবা। আপামর জনসাধারনকে নিরলস সেবা দিয়ে দেশের ব্যাংকিং খাতে সাফল্যের শৗর্ষে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। বিগত বছরগুলিতে ধারাবাহিক এ সফলতায় ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ বেড়েছে বহুগুণ। ইসলামী ব্যাংকিং দীর্ঘ চার দশক অতিক্রম করলেও এ পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা এখনো সাধারণ মানুষের কাছে স্পস্ট নয়।

অনেকেই মনে করেন শুধুমাত্র সুদমুক্ত লেনদেনই হলো ইসলামী ব্যাংকিং। এটি ইসলামী ব্যাংকিং সম্পর্কে একটি আংশিক ধারণা মাত্র; বাস্তবে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের পরিধি ব্যাপক। ইসলামী ব্যাংকের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে ইসলামী ব্যাংক এমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান যার উদ্দেশ্য ও মূলনীতি হলো ইসলামী শরিয়াহ পরিপালন এবং সকল লেনদেনে সুদ বর্জন করা। ইসলামী ব্যাংকিং বলতে শুধুমাত্র মুদারাবা পদ্ধতিকেই অনেকে জানেন। লাভ-ক্ষতি ভাগাভাগির পদ্ধতিই একমাত্র ইসলামী পদ্ধতি নয়। ক্রয় বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্ষতি ভাগাভাগি না করেও বাই মুরাবাহা, বাই মুয়াজ্জাল, বাই সালাম, বাই ইসতিসনা ইত্যাদি পদ্ধতিতে ব্যবসা পরিচালনা করা ইসলামী শরীয়াহ অনুমোদন করে।

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশে আরো ৯টি ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে দেশের মোট ১১ হাজার ব্যাংক শাখার মধ্যে ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকের শাখার সংখ্যা ১৬০০। এছাড়া প্রচলিত ব্যাংকের ইসলামী শাখা ও উইন্ডো রয়েছে আড়াই শতাধিক। আরো অনেক ব্যাংক পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকিংয়ে রূপান্তরের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানা যায়।

মানুষের আমানতের সুরক্ষা ইসলামের নির্দেশ। এ নির্দেশ অনুসরণ করে ইসলামী ব্যাংকগুলো। টাকা-পয়সাসহ মূল্যবান সামগ্রী আমানত সংরক্ষণ করে ইসলামী ব্যাংক পরিণত হয়েছে মানুষের সম্পদের বিশ্বস্ত আমানতদার হিসেবে। ফলে ইসলামী ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ। এককভাবে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এ আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লক্ষ ৩৯ হাজার কোটি টাকা। সামগ্রিকভাবে ইসলামী ব্যাংকগুলো দেশের ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতের ২৭.২৬ শতাংশ, বিনিয়োগের ২৭.৫৫ শতাংশ এবং বৈদেশিক রেমিট্যান্স কার্যক্রমের ৩৮ শতাংশ পরিচালনা করছে। তৈরি পোষাক, আমাদানি-রপ্তানি, কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকগুলো জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রভ‚ত অবদান রাখছে।

বিনিয়োগ কার্যক্রমে ইসলামী ব্যাংক কল্যাণের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তামাকসহ জনস্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর কোন প্রকল্পে বিনিয়োগ করে না ইসলামী ব্যাংক। এখানে হালাল হারাম বিবেচনা করে বিনিয়োগ প্রদান করা হয়। এ ব্যাংকের কর্মকর্তারা গ্রাহকদের বিনিয়োগ প্রদান করার পর তাদের কার্যক্রম তদারকি করে থাকেন। গ্রাহক বিনিয়োগ যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারছেন কিনা তার খোঁজ খবর এবং ব্যবসায়িক উন্নয়নে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ সম্পদভিত্তিক হওয়ায় এতে খেলাপী হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। ফলে ব্যাংকিং খাতের খেলাপী ঋণের পাহাড় চোখে পড়লেও ইসলামী ব্যাংকগুলোতে এখনো খেলাপী বিনিয়োগ সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে।

অধিক সংখ্যক মানুষের কল্যাণ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে ইসলামী ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ প্রদান করে থাকে। বিলাস সামগ্রীতে বিনিয়োগে ইসলামী ব্যাংক নিরুৎসাহিত করে। পরিবেশ উন্নয়নে গ্রীণ ব্যাংকিং এবং বিনিয়োগকৃত প্রকল্পগুলো যেন পরিবেশ বান্ধব হয় সেদিকে গুরুত্ব দেয়া হয়। মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করতে ইসলামী ব্যাংকগুলোর রয়েছে প্রযুক্তিসমৃদ্ধ সেবা।

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “মানুষের প্রয়োজন সামনে রেখে ইসলামী ব্যাংকিং পরিচালিত হয়। একজন ব্যক্তি বা ব্যবসায়ী যে পেশায় থাকেন, তাঁর কী প্রয়োজন সেটা এখানে বিবেচনা করা হয়। ইসলামী ব্যাংকিয়ে কোন টাকার কারবার হয় না, পণ্যের কারবার হয়। ফলে যারা রিয়েল ইকোনমিকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে চান, তাঁদের জন্য ইসলামী ব্যাংকিং সবচেয়ে বেশি উপযোগী। ইসলাম ধর্মে সুদকে হারাম বা নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। ফলে ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকেও ইসলামী ব্যাংকিংয়ে মানুষের আগ্রহ বেশি”।

দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশ উন্নয়নেও ইসলামী ব্যাংকের রয়েছে দৃশ্যমান কার্যক্রম। এ ব্যাংক পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচীর মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করছে। পল্লীর প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জীবনমান উন্নয়নে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন উন্নয়নে নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে এ ব্যাংক।

দরিদ্রদের সাদাকা প্রদানে ইসলাম জোরালো নির্দেশ দিয়েছে। ইসলামী ব্যাংকগুলো তাদের আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠির জীবনমান উন্নয়নে ব্যয় করে। কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রমের আওতায় ইসলামী ব্যাংকগুলো দুর্গত মানুষের দুঃখ দুর করতে কাজ করে যাচ্ছে।

ইসলামী ব্যাংকের প্রসারের সাথে বাড়ছে এ পেশার প্রতি তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ। তবে ইসলামী ব্যাংকিংয়ে যারা আসছেন সবাই ইসলামী জীবনাচারে অভ্যস্ত কিনা তা বিবেচ্য বিষয়। বর্তমানে দেশে ইসলামী ব্যাংকগুলোতে প্রায় অর্ধলক্ষ জনশক্তি কর্মরত রয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের সফলতার জন্য জনশক্তির গুণাবলী অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এ পেশার কর্মরতরা ইসলামী জীবনবিধানে বিশ্বাসী ও পরিপালনে অভ্যস্ত হবেন এটিই ইসলামী ব্যাংকিংয়ের অন্তর্নিহিত দাবি।

গ্রাহকদের সাথে উত্তম আচরণ, তাদের কল্যাণকামীতা, সদাচরণ, সততা, বিনয়, আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, প্রতিষ্ঠানের প্রতি ভালবাসা, ধর্মীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় সকল নিয়ম কানুন যথাযথ পরিপালন করবেন ইসলামী ব্যাংকার এটি ইসলামী ব্যাংকিংয়ের দাবি। অসাধুতা, মেজাজের ভারসাম্যহীনতা, নেশা, ধুমপান, পর্দাহীনতা এসব নেতিবাচক গুণাবলী ইসলামী ব্যাংকের কর্মীদের জন্য অনাকাঙ্খিত। এ ধরণের আচরণ ইসলামী ব্যাংকের প্রতি গ্রাহক ও সাধারণ মানুষের মাঝে নেতিবাচক মানসিকতা তৈরি করতে পারে। তাই ইসলামী ব্যাংকের কর্মীদের প্রতিটি কথা, কাজ ও জীবনাচারে ইসলামী বিধানের প্রতিফলন থাকা বাঞ্ছনীয়।

ইসলামী শরীআহর নীতিমালা ও ব্যাংকিংয়ের নিয়ম-কানুন পরিপালন ইসলামী ব্যাংকিংয়ের পূর্বশর্ত। গ্রাহক ও ব্যাংকার উভয়কেই ইসলামী ব্যংকিংয়ের নিয়মকানুন জানা ও যথাযথ পরিপালনের মাধ্যমেই সফলভাবে এ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

নানান অনিশ্চয়তা নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ ও রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষের সুদক্ষ দিকনির্দেশনা, নির্বাহী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সততা, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা, গ্রাহক ও শুভানুধ্যায়ীদের আস্থা ও ভালবাসায় ইসলামী ব্যাংক সফলতার শীর্ষে আরোহন করতে সক্ষম হয়েছে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও ইসলামী ব্যাংক স্বীকৃতি ও সম্মাননা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এ ব্যাংকের সম্পদমান ও পরিচালনা পদ্ধতি আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হওয়ায় খ্যাতনামা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান স্বীকৃতি দিয়েছে।

বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং যতটা অগ্রসর হয়েছে এ ব্যবস্থা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের জানার পরিধি ততটা প্রসারিত নয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ধারণা সহজবোধ্য করে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে পারলে এ ব্যবস্থার কল্যাণকামীতা ও অন্তর্নিহিত শক্তি মানুষ উপলব্ধি করতে পারবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ক কোর্স এবং এ বিষয়ক পাঠদান এখনো চোখে পড়ে না। দ্রুত বিকাশমান এই নতুন অর্থব্যবস্থা জাতীয় পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা চালু করা এখন সময়ের দাবি।

লেখক: রিয়াজ উদ্দিন, লেখক ও ব্যাংকার

আর্কাইভ থেকে

আরও পড়ুন

বিদেশি ডেবিট কার্ডে অর্থ তোলা বন্ধ করল ইবিএল
এসবিএসি ব্যাংকের নতুন এএমডি নূরুল আজীম
বছরজুড়ে আলোচনায় খেলাপি ঋণ, সুদহার ও বিনিময়হার
বিকাশের প্রধান যোগাযোগ কর্মকর্তা মাহফুজ মারা গেছেন
ন্যাশনাল ব্যাংকের নতুন পর্ষদের ৩ কমিটি গঠন
ব্যাংকে চাকরির আবেদনের বয়সসীমা শিথিল
মাসিক সঞ্চয় হিসাব খোলা যাচ্ছে বিকাশ অ্যাপে
ফের এবিবির চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন
অফিসার পদে ৭৮৭ জনকে নিয়োগ দেবে সরকারি ৫ ব্যাংক
ন্যাশনাল ব্যাংকের নতুন পরিচালক হলেন যারা